সেকালের রথযাত্রা। পর্ব ৪। দীনেন্দ্রকুমার রায়
রথতলার একপাশে ‘মালামো’ করিবার আখড়া। অনেকখানি জায়গা বাঁশ দিয়ে ঘেরা ; ঘাসগুলা চাঁচিয়া ফেলিয়া আখড়াটি পরিষ্কার করা হইয়াছে। গোবিন্দপুর ও তাহার নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহে যে সকল চাষার শারীরিক বল অধিক, ও যাহাদের কুস্তী করিবার অভ্যাস আছে, তাহারা আজ পূর্ণ উৎসাহে লড়িতে আসিয়াছে। কারণ, ‘দশের মাঝে’ তাহাদের কেরামতি দেখাইবার আজ উৎকৃষ্ট অবসর। এই সকল এমেচিয়োর পালোয়ানদের প্রত্যেকের পশ্চাতে চারি পাঁচ জন পৃষ্ঠচর। গ্রামস্থ ভদ্রলোকেরা কুস্তি দেখিতে আখড়ার ‘ঘেরে’র নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন। চারিদিকে অসংখ্য চাষা। দুইজন বলিষ্ঠ যুবক কুস্তির জন্য প্রস্তুত হইয়া আখড়ার মধ্যে প্রবেশ করিল। তাহারা মশলা চিবাইতে ও ‘ধুলোপড়া’ দিয়া বাহুদ্বয় ডলিতে ডলিতে সমগ্র দর্শকবৃন্দের উপর এমন সগর্ব্ব দৃষ্টি নিক্ষেপপূর্ব্বক ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল যে, বোধ হইল, আজ তাহারা বিশ্বসংসারে কাহারও কিছুমাত্র তোয়াক্কা রাখিতেছে না।
যুবকদ্বয় তাল ঠুকিয়া ঘাড় ঈষৎ নোয়াইয়া উরুদেশে দুই চারিবার চপেটাঘাত পূর্ব্বক পরস্পরকে আক্রমণ করিবার চেষ্টায় আখড়ার মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল ; অবসর বুঝিয়া এক জন অপরের বামহাত-খানি হঠাৎ চাপিয়া ধরিতেই সে দক্ষিণ হস্তে প্রতিদ্বন্দ্বীর ঘাড় ধরিয়া তাহার এক পায়ে নিজের পা বাধাইয়া দিল। তখন উভয়ের হস্তে হস্তে, পদে পদে, বক্ষে বক্ষে প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হইল ; দর্শকগণ নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া বিস্ফারিত নেত্রে শেষ ফলের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। অনেক চেষ্টার পর একজন অপরকে শূন্যে তুলিয়া চিৎ করিয়া ফেলিয়া দিল ; আর চারিদিক হইতে অমনি চটাপট করতালি পড়িয়া গেল, এবং অনেকে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “বাহা তুষ্টু বেশ বলিহারি ওস্তাদী!” দর্শকবৃন্দের মধ্যে তুষ্টুর বল ও কৌশলের সমালোচনা-কোলাহল উথ্থিত হইল। কেহ বলিল, “আরে আমি বরাবরই জানি তুষ্টুর সঙ্গে ঝড়ু পারবে না ; তুষ্টু জোয়ানডা কি কম!” আর একজন বলিল, “ঝড়ু খামেকা পারবে? তুষ্টুর কত ‘গুণ-জ্ঞান’ জানা আছে, তার কিছু খবর রাখিস? তুষ্টুর চাচাতো ভাই আর্জান শেখ সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল ; সে চক্ষু ঘুরাইয়া বলিল, “আরে ও মালতের পো! তুমি কও কী? এ বাঙ্গালা মুল্লুকে ভাইয়ের ওস্তাদের মতন ওস্তাদ কডা আছে? এমনি ওষুধ ও ঠাঁই আছে যে, মালামোর সময় হেঁসো দিয়ে কোপালেও ওর গায়ে আঁচড় বসবে না!” যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া তুষ্টু বাঁড়ুয্যেদের মেজবাবুর নিকট হইতে একখানা চাদর শিরোপা পাইল ; সে তৎক্ষণাৎ তাহা মাথায় বাঁধিয়া নতমস্তকে শিরোপাদাতাকে অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিল।
কিন্তু হঠাৎ একটা গোল বাধিয়া উঠিল। ঝড়ু দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত হইবার পর তাহারা পৃষ্ঠপোষকগণ ও স্বগ্রামবাসী চাষার দল বলিতে লাগিল, তুষ্টু অন্যায় করিয়া ঝড়ুকে ফেলিয়া দিয়াছে ; অতএব তুষ্টুর এ জিত জয় বলিয়া মঞ্জুর হইতে পারে না । তুষ্টুর সেই চাচাতো ভাইটি তাহার শারীরিক বলের অভাব কণ্ঠস্বরেই পোষাইয়া লইয়াছিল ; সে আকাশে গলা চড়াইয়া বলিল, “আরে ঝড়ু আগে ভাইয়ের সাকরেদ ন্যাপলার সঙ্গে কুস্তি লড়ুক, তারপর যেন বড়ডার কাছে আসে! চাঁদপুরে আবার মরদ আছে কেডা?”– নিজের গ্রামের উপর কটাক্ষ! চাঁদপুরের চাষার দল তুষ্টু ও তাহার বাচাল চাচাতো ভাইটির ওপর রুখিয়া আসিল। অতঃপর কী ঘটে, দেখিবার জন্য সকলে উদগ্রীবভাবে অপেক্ষা করিতে লাগিল। তখন তুষ্টু মন্দরমন্থিত সমুদ্রের ন্যায় চঞ্চল সেই জনস্রোতকে লক্ষ্য করিয়া তাল ঠুকিয়া বলিল, “জোয়ানের বেটা জোয়ান কে আছে আসুক ; কুস্তিতে মীর মহম্মদের সাকরেদ কারেও ডরায় না।” মাথার বাবরি কাটা ঝাঁকড়া চুল নাড়া দিয়া, বুক ফুলাইয়া, রক্তবর্ণ চক্ষু দুটি কপালে তুলিয়া তুষ্টু তখন বীরমদে রঙ্গভূমিতে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, তখন তাহাকে দেখিয়া একটা জীবন্ত মানুষ বলিয়াই বোধ হইল ; চতুর্দ্দিকস্থ সমবেত মনুবংশীয়েরা তাহার তুলনায় কতকগুলা নির্জীব পুত্তলিকার ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল!
ঝড়ু আবার তুষ্টুর সঙ্গে কুস্তি আরম্ভ করিল। প্রায় পাঁচ মিনিটকাল উভয়ে স্ব স্ব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভূমিস্যাৎ করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিল ; কিন্তু বিজয়লক্ষ্মী আজ তুষ্টুর প্রতিই প্রসন্না, তুষ্টু ঝড়ুকে সহসা মাথার উপর তুলিয়া তিন হাত দূরে ফেলিয়া দিল। তুষ্টুর দলস্থ লোকেরা সোৎসাহে ছুটিয়া গিয়া তাহার বিজয়গর্ব্বস্ফীত শ্রমচঞ্চল বক্ষে করাঘাতপূর্ব্বক ধন্য ধন্য করিতে লাগিল ; চারিদিকে ঘাের কলরোল উথ্থিত হইল।
কিন্তু চাঁদপুরের চাষারা আজ জোট বাঁধিয়া আসিয়াছে, ঝড়ুর পরাজয়কে আজ তাহারা চাঁদপুর গ্রামখানিরই পরাজয় বলিয়া মনে করিল ; সুতরাং গ্রামের মানরক্ষার জন্য সকলেই তুষ্টুর উপর ঝুঁকিয়া পড়িল। তুষ্টুর দল নিকটেই ছিল। দুই পক্ষে প্রথমটা খুব কথা কাটাকাটি চলিল ; কিন্তু চাষারা রাগিলে শুধু গর্জ্জনেই বিবাদ শেষ হয় না, বর্ষণ পর্যন্ত হইয়া থাকে! অবিলম্বে দুই পক্ষ হইতেই লাঠিবর্ষণ আরম্ভ হইল । কয়েকজন ভদ্রলোক গোল মিটাইতে আখড়ায় প্রবেশ করিলেন, কিন্তু লাঠির সঘন আস্ফালন দেখিয়া সভয়ে সরিয়া আসিলেন। পাকা বাঁশের মোটা মোটা, লম্বা লম্বা, তৈলরঞ্জিত, গাঁটবিশিষ্ট লাঠি উঠিতেছে, ঘুরিতেছে পড়িতেছে! দেখিয়া মনে হইল, সত্যই আজও বাঙ্গালীর প্রাণ আছে। যাহারা এমন লাঠি চালাইতে পারে, উদ্যত লাঠির মুখে বুক পাতিয়া যাহারা এমন অদ্ভুত কৌশলে সেই আঘাত ফিরাইতে পারে, তাহারা নীল-কর চা-করের বেত ও তাহাদের দেওয়ান গোমস্তার ‘শামচাঁদ’ নতমস্তকে সহ্য করে কেন ?
অকস্মাৎ লাল পাগড়ি-বাঁধা জন পাঁচ-সাত কনস্টেবল হস্তস্থিত অনতিদীর্ঘ রুল উদ্যত করিয়া হাঙ্গামার মধ্যে প্রবেশ করিল ; দেখিতে দেখিতে বিবাদ থামিয়া গেল, এবং যাহারা লাঠি চালাইতেছিল, তাহারা দলাদলি ভুলিয়া একযোগে চম্পট দিল! কয়েকজন নির্ব্বিরোধ চাষাকে লইয়া কনস্টেবল সাহেবেরা টানাটানি করিতে লাগিল।– বিষম সমস্যার মীমাংসা হইয়া গেল ; দর্শকগণ নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, হায় রে রুলের ভয়!