পুনর্ভবাপুত্র। সপ্তম পর্ব। লিখছেন আহমেদ খান হীরক

0
সে প্রথম প্রেম আমার…
না, নীলাঞ্জনা না।
কিন্তু নীলাঞ্জনা তখন ঢুকে গেছে রক্তের ভেতর। নচিকেতার এই বেশ ভালো আছি ক্যাসেটটা তখন বাজারে শুধু না—রহনপুরকে মাত করে আমার হৃদয়কেও ভয়ানকভাবে আছড়ে ফেলেছে।
স্কুল শেষ করে, ঢা ঢা রোদ্রের দুপুরে, এই নীলাঞ্জনা শুনতে যেতাম চাচার বাড়িতে। বেশি দূরে তো না। আমাদের বাড়ি, পরে একটা গলি নব্বই ডিগ্রি করে দুইবারে চতুর্ভুজ করে ফেললেই চাচার বাড়ি। বাড়ির বাইরে থেকে পাওয়া যায় তামাকের গন্ধ। চাচার সিগারেট খাওয়া ছিল প্রবাদের মতো। মানে ওই যে বলে না চেইন স্মোকার—চাচা ছিলেন তা-ই।
দেখতাম একটা ইজি চেয়ারে শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট উঠিয়ে নিচ্ছেন হাতে। টেনে যাচ্ছেন ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছেন আর কোন সে ভাবের নগরে হারিয়ে আছেন। সাদা লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিতে চাচাকে সাধক সাধক লাগত। বাধা ছিল ওই সিগারেট। এত খায় কেউ? সাধকেরা কি এত খায় কোনো কিছু নাকি? চাচার মধ্যে দার্শনিকদের মতো এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততাও ছিল। বড় হয়ে মনে হয়েছিল চাচা বোধহয় দার্শনিকও ছিলেন। তখন বুঝিনি। হয়তো ছিলেন।
তো, চাচাকে একপাশে রেখে ঢুকে যেতাম চাচাত ভাইয়ের ঘরে। চাচাত ভাই তখন হয়তো বাইরে বেরোবে, নাহয় ঘুমে। ঘুমে থাকলে মুস্কিল…কারণ তখন যে আমি গানটা শুনতে ঢুকেছি। সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা…
এই গান শোনার অন্য কোনো উপায় তো তখন ছিল না। একে তখন মোবাইল ইউটিউবের জন্ম হয় নি, তার ওপর আমার বাড়িতে টেপ-রেকোর্ডার ছিল না। সবে ধন একটা রেডিও ছিল। টিভি-যুগ প্রচলনের পর যা মুমুর্ষু অবস্থায় ঠাঁই পেয়েছিল ভাঁড়ার ঘরে—আমরা যেটাকে ভান্ডার ঘর বলতাম। ফলে নীলাঞ্জনাকে শুনতে আমার চাচাত ভাইয়ের ঘুমকেও উপেক্ষা করতে হতো।
কাঁপা কাঁপা হাতে নচিকেতার ক্যাসেটটা দিয়ে দিতাম প্লেয়ারে। চাপ দিতাম বোতামে। বেজে উঠত মিউজিক। চাচাত ভাই তখন হয়তো চোখ খুলে তাকাতো। কিন্তু তারও তো অপছন্দের গান ছিল না ওটা…
লাল ফিতে সাদা মোজা সু স্কুলের ইউনিফর্ম…
লাইনটা বুঝতে বুঝতেই আমার অনেক দিন চলে গেছে। কিন্তু বোঝার আগেই লাইনটা আমার ভেতর প্রবল তোলপাড় শুরু করে দিয়েছিল।
কিন্তু কেন?
ওই যে ইউনিফর্ম! ওই শব্দটা!
বয়সটা তখন ঝুঁকিপূর্ণ। মানে প্রেমের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর ইউনিফর্ম! আর তারও ওপরের শব্দটা হলো প্রথম প্রেম!
তখন আমার প্রথম প্রেম স্কুলের ইউনিফর্মই তো পরত…যেমন আমিও পরতাম খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্ট। আমার প্রেমের সাথে দেখা হয়ে যেত সদ্য হওয়া চিকন পৌর-রাস্তায়। দুই পাশে বেনি…লাল ফিতে কি? নাহ! সাদা ফিতে চুলে আর নীল সে গার্লস হাই স্কুলের ড্রেস। হ্যাঁ, আমরা তো আর ইউনিফর্ম বলতাম না। বলতাম স্কুল-ড্রেস। নীল সেই কামিজের সাথে সাদা ওড়না আর সালোয়ার। সাদা জুতা। যেন নচিকেতার বলা নীলাঞ্জনাই হেঁটে আসছে। আর বুকটা ধড়াস ধড়াস করে উঠছে। তাকাবে কি সে আমার দিকে? হাসবে কি তার বান্ধবীদের নিয়ে?
ক্লাসের হিসাবে সে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। প্রেমের তো তখন এই রকমই নিয়ম। আমরা আমাদের ক্লাসের বা সমবয়সী মেয়েদের দিকে প্রেমের নজরে ঠিক তাকাতে পারতাম না। দুয়েক বছরের জুনিয়র হলেই ঠিক। নচিকেতা বা আমার নালাঞ্জনা তাই সব দিক থেকেই পারফেক্ট ছিল। শুধু কোনোভাবেই বলতে পারছিলাম না মনের কথাটা। তখন বোধহয় যায়ও না।
নীলাঞ্জনা…এই নামটাই থাক। আমার প্রথম প্রেমের আসল নাম বলেই বা আর লাভ কী? নীলাঞ্জনা তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে রাস্তায় হাসতে হাসতে চলে যেত। আমার ক্রিকেট ব্যাট শূন্যে উঠে আর নামত না। আমি বোল্ড হয়ে যেতাম লহমায়—কিন্তু তাতে আমার কোনো আফসোস কি ছিল? আমি কবেই বোল্ড হয়ে গেছি নীলাঞ্জনার হাসিতে। কবেই কট বিহাইন্ড হয়েছি তার চাহনিতে। কিন্তু আমি কখনো ভাবি নি যে প্রথম প্রেমে আমি রান আউট হয়ে যাবো!
হুমায়ূন আহমেদ তখন খুব চলে। আমার হাতেও তখন তিনি। বুকের ভেতর ধম ধম করে হাতুড়ি পেটাচ্ছেন প্রেমদেবী—চলেছি নীলাঞ্জনার বাড়ি।
কীভাবে?
তার আগেই নীলাঞ্জনার সাথে বহুবার চোখাচোখি শেষ করেছি। সে হেঁটে আসে যে পথে সে পথে দাঁড়িয়ে থেকেছি। সে তার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে মৃদুপায়ে আমাকে উপেক্ষা করে চলে যায়…আর আমি সেসবের তোয়াক্কা না করে দৌড় দিচ্ছি আরেকটা রাস্তায়। ছুটছি শর্টকাট ধরে। মসজিদকে একপাশে রেখে, কাপড়পট্টিকে ধাক্কা মেরে ফেলে, ছোট ইঁদারার সামনে যখন থামছি আমার বুকে তখন দম নেয়ার এতটুকু বাতাস অবশিষ্ট নেই। আর তখন দেখছি হেঁটে আসছে সখীসহ নীলাঞ্জনা। আহা! আবারও তাকে দেখা! এক ঝলকই হোক…তবু! দিনটা যেন সোনাঝরা হয়ে ওঠে! আর তার বান্ধবীরা মুখ টিপে হাসে। দ্বিতীয়বার একইভাবে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের যে কৌতুহল ও আনন্দ তা কিন্তু নীলাঞ্জনাকে স্পর্শ করে না। সে যেন বিরক্ত। আমার সামনে সে একটু দাঁড়িয়ে বলল, শোনো, তোমার কাছে হুমায়ূন আহমেদের ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’ আছে?
আমার গলা ও জিভ সিরিষ কাগজ। আমি খুবই বিস্মিত এবং আমার সঙ্গে নীলাঞ্জনার সহজ কথা বলার সক্ষমতা দেখে কিছুটা আহতও। আমি কথা বলছি না দেখে নীলাঞ্জনা আরো বিরক্ত। বলল, আরে, তুমি আমাকে চেনো না নাকি? আমরা তো ছোট্টবেলায় ফ্রেন্ড ছিলাম!
কী বলে এই মেয়ে? ফ্রেন্ড ছিলাম মানে কী?
নীলাঞ্জনা বলল, শোনো, ছোট্টতে আমি তোমাদের ঘাটে যেতাম কাকুর সাথে…আর তুমিও তখন এত্তটুকু গুলুগুলু বাবু…তুমিও আসতে গোসল করতে। তখন আমরা ফ্রেন্ড হয়েছিলাম! তুমি দেখি আমাকে মনেও রাখো নি!
— না মানে…আসলে…অনেক ছোটতে তো!
— তো অনেক ছোট হলেও তুমি আমাকে ভুলে গেলে?
বান্ধবীরা হাসে। আমার ঘাম হয়। দৌড়ে এসেছি এজন্যই বোধহয়, নাকি?
নীলাঞ্জনা বলল, বললে না?
— কী?
— বইটা আছে কিনা?
আমার কাছে বইটা ছিল না। কিন্তু ‘নেই’ এটা কোনোভাবেই বলতে পারলাম না তাকে। বললাম, আছে। বাড়িতেই আছে।
নীলাঞ্জনা তখন ভয়ংকর কথাটা বলল, আমিই আসব তোমার বাড়িতে নাকি তুমি আসবে?
— জ্বি?
বিস্ময়ের চূড়ান্তে যাওয়ায় মুখে ‘জ্বি’ পর্যন্ত চলে এল। বান্ধবীরা আরেকবার হেসে গড়াগড়ি গেল। নীলাঞ্জনা বলল, তুমিই তাহলে নিয়ে আসো বিকালে…তোমাকে গুড়ের চা খাওয়াব!
নীলাঞ্জনা হেসে চলে গেল। খটখটে দুপুরটা হঠাৎই সন্ধ্যায় বদলে গেল যেন। নীলাঞ্জনা চলে যাচ্ছে। গান বাজছে বাতাসে—লাল ফিতে সাদা মোজা সু স্কুলের ইউনিফর্ম…নটার সাইরেন সংকেতে মনোযোগ কম…
নীলাঞ্জনা চলে যাচ্ছে। বাতাস জড়িয়ে ধরছে আমাকে। নীলাঞ্জনা আর আমি…আমরা কি তাহলে এখনো ফ্রেন্ড?
স্বর্গছেঁড়ার তখন বিখ্যাত বইয়ের দোকান রানু বুক ডিপো।
পকেটে একটা টাকাও নেই। কিন্তু কোন ভরসায় বুক ডিপোতে এসে উঁকি দিচ্ছি কে জানে! বই কিনতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’। কিনতে হবে কেননা নীলাঞ্জনা আমায় ডেকেছে গুড়ের চায়ের নিমন্ত্রণে!
রানু বুক ডিপোর ছেলে আমাদের সমবয়সী। তাকে কিছুটা খুলে কিছুটা ঢেকে বলায় সে বইটা বের করে দিলো। এক সপ্তাহের মধ্যে আশি টাকা শোধের আশ্বাস দিয়ে ছুটলাম নীলাঞ্জনার বাড়ি। হাতে বই, বুকে প্রেম…এই নিয়ে দাঁড়ালেম তাহার দরজায়!
কড়া কি নাড়ব? নাড়ব না? তার মা-বাবা কী জানি মনে করে?
আমি কড়া নাড়বার আগেই পেছন থেকে হাঁক। আরে হীরক? বইটা নিয়েছ?
পেছনে নীলাঞ্জনা আর তার মা দাঁড়িয়ে। বাইরে কোথাও গিয়েছিল হয়তো। মা নীলাঞ্জনাকে একটু ধমকালো—ওকে তুমি করে বলছিস কেন? তোর চেয়ে বড় না?
নীলাঞ্জনা ঠোঁট ওল্টালো। যেই বড়! মাত্র এক বছরের! আর তারচেয়েও বড় কথা হীরক আর আমি ছোট্টবেলার বন্ধু!
নীলাঞ্জনা বিতং করে পাথর ঘাটে আমাদের গোসলের গল্প শোনাতে লাগল। মা একটু হেসে আমাকে বলল, কিছু মনে করো না বাবা…আমার মেয়েটা একটু পাগলী আছে! আসো, ভেতরে আসো…
আমি আমার প্রথম প্রেমের বাড়িতে প্রথমবারের মতো ঢুকলাম। চৌকো উঠান। একপাশে একটা ডালিম গাছ। গাছে একটা মৌচাক। মা মোড়া টেনে বসতে দিলেন। আর নীলাঞ্জনা আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, এতো একেবারে নতুন বই?
আমি একটু ভড়কে গেলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, কয়েকদিন আগেই কিনেছিলাম!
নীলাঞ্জনা আমার দিকে তাকালো। অন্তর্ভেদী সে দৃষ্টি। কিন্তু কিছুই বলল না। কেমন একটু হাসল শুধু। বলল, চলো, তোমাকে আমার বইয়ের কালেকশন দেখাই!
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা বললেন, যাও। আমি চা পাঠাচ্ছি। ওর কতগুলো ট্রফি আছে তাও দেখ…এত ভালো গান ওর গলায়,,,কিন্তু গায় না! সারাদিন গল্পের বই পড়ে পড়ে চোখ দুটো ঢুকিয়ে দিয়েছে দেখছ না?
আমি নীলাঞ্জনার চোখের দিকে তাকালাম। চোখ ঢুকে গেছে? এই চোখ যেন চড়ুইয়ের মতো চঞ্চল…দেখলেই বুকে কাঁপন লাগে! কিন্তু মাকে আর এসব কথা কীভাবে বলি? আমি তাই নীলাঞ্জনার ফ্রকের পেছন পেছন ওর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম!
একটা প্রায় অন্ধকার ঘর।
একপাশে একটা বুক সেল্ফ। তাতে নীলাঞ্জনার বই আর ট্রফি। কিন্তু সেসব কে দেখে? আমি দেখছি নীলাঞ্জনাকে। সে আমার খুব কাছে। তাকিয়ে আছে। বলল, এই বই তুমি আজকেই কিনেছ, না?
আমি বললাম, না তো।
সে বলল, ইশ! ঢং! বলো কিনেছ?
— হ্যাঁ কিনেছি।
— তুমি আমাকে গিফট করছ বইটা?
— হুম।
— তাহলে আমার নাম লিখ বইটাতে।
সে বইটা খুলে দেয়। বাড়িয়ে দেয় একটা কলম। আমি লিখি নীলাঞ্জনা…নাহ! নীলাঞ্জনা তো লিখি নি। লিখেছিলাম তার আসল নাম। সে বলেছিল আমি দীর্ঘ-ই দিই না! আমি তাই কেটে আবার লিখেছিলাম তার নামটা—হ্রস্ব-ই দিয়ে। সে হেসে বইটা নিয়েছিল। আর নিতে গিয়ে তার আঙুল ছুঁয়ে গিয়েছিল আঙুলে। একটু লম্বা সময় আমরা বইটা ধরে ছিলাম! ঘরটা কেমন কোমল ছিল! কেমন কোমল ছিল?
চাচাত ভাইয়ের ঘরে বসে বসে সে প্রথম নীলাঞ্জনা গানটা শুনতে শুনতে আমার সেই কোমল ঘরে কোমল নীলাঞ্জনার আরো কোমল আঙুলের স্পর্শ অনুভব করতে করতে কেমন যেন একটা হাহাকার অনুভব করতাম।
নীলাঞ্জনা তখন নিজেতে ছিল মগন…
নীলাঞ্জনা তার কানের পাশের খুচরো চুল সরিয়ে বলেছিল, তুমি একটা বোকা!
বলেই বইটা নিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল উঠানে। হয়তো গুড়ের চা আনতে। আর আমি বুঝেছিলাম প্রথম প্রেমের দ্বিতীয়বারের প্রেমে আমি আসলে এইমাত্র পড়লাম!
অথচ চাচাতো ভাইয়ের ঘরে নচিকেতা তখন গেয়ে যাচ্ছে—হাজার কবিতা বেকার সবই তা তার কথা কেউ বলে না… সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা!
(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *