অক্সিজেন। পর্ব ৩। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

2

গত পর্বের পর

স্বপ্ন নিয়ে

শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে এমাসের টিউশানির পয়সা থেকে সবাইকে বাচ্চু সিঙারা চা খাওয়াবে। আজ সেই দিন।কলেজে যাবার পথেই একবার ইলেকট্রিকের অফিস ঘুরে যাবে কুহু। এমাসে অনেক বিল এসেছে। কেন, কীজন্য, জানতে হবে। মা, আর এসব পারেনা। বাবা অসুস্থ হবার পর থেকেই মা বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া সবসময়েই বাবার জন্য কিছু না কিছু করছে। তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছিল কুহু। একটু আগেই বেরোতে হবে আজ।

রান্নাঘর অগোছালো হয়ে আছে। জলের বোতল ভরা হয়েছে। তাকে সাজানো  হয়নি। গ্যাসের ওপরে চাটু বসানো। তাতে পাঁউরুটির গুঁড়ো ভর্তি। এমনকি ডিমসেদ্ধর খোলাগুলো যেমনকে তেমন বাটির চারপাশে ছড়ানো। বাবার আর মায়ের আটটার ব্রেকফাস্ট তৈরির নমুনা এসব। মা সবটাই করেছে, কিন্তু গুছোতে পারেনি। দ্রুত হাত চালিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে নিল ও।তারপর গ্যাসের পাশের কালো পাথরের স্ল্যাবে পাতল গতমাসের ‘মুখবন্ধ’ সাময়িকীটা। একটা ধারাবাহিক বার হচ্ছে। উপন্যাস, কিন্তু পাহাড়ের পটভূমিকায়। ওর প্রিয় লেখা। লেখকের নাম ‘উজান’। ছদ্মনাম হবে। ওর নীচেই আছে বাংলা কাগজ। এখন ও বই, তারপরে কাগজ পড়তে পড়তে রুটি বানাবে। রোজ রোজ পাঁউরুটি খেতে ভাল লাগেনা। মার পক্ষে রুটি করা সম্ভব নয়। কিন্তু ছোটবেলার মত দুধ গুড় দিয়ে রুটি মেখে খাবার প্রবল ইচ্ছে হয়েছে ওর। তাছাড়া পাশের বাড়ির মীরা কাকিমার করোনা হয়েছে। একদম একা আছেন। ওনাকেও দুটো রুটি দিয়ে আসবে। গ্যাসে দুধ বসিয়ে আটা মাখার পাত্রটা বার করল ও। জল নিয়ে আটা ঠেসতে ঠেসতেই সাময়িকীটায় বাঁ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে  চোখ বোলাল ।

এর পরের সংখ্যায় অনুর কবিতাটা থাকবে। মেলে পোস্ট করেছে ও। বর্ষার জলধারা তীব্র গতিতে এসে একটি মেয়ের চুল ভিজিয়েছে, গাল গলা সব ভিজিয়ে আদর করেছে। কিন্তু তার ব্যাগের চিঠিটি স্পর্শ করেনি। জানতে চায়নি চিঠিটা কার লেখা।কবিতার বিষয়বস্তু অভিনব। ছন্দ,ভাষা সবই সুন্দর! ওর খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু অনুর হয়নি। সমানে ঘ্যান্‌ঘ্যান্‌ করছিল।

“ভাল হলনা। আর একটু ভাবলে হত। এটা জমা দেব না।”

ও ধমকে থামিয়েছে। তারপর অনুর মেল আইডিতে ঢুকে ‘বাংলা মুখবন্ধের’ ঠিকানায় পোস্ট করে দিয়েছে লেখাটা। ও জানে বার হবার পরেও লেখাটা নিয়ে অনু অসন্তোষ দেখিয়েই যাবে। ওর অবশ্য তাতে কিছু যাবে আসবে না।

কুহু খুব একটা বাইরের বইপত্র পড়েনা বলে অনু রেগে যায়। ও বোঝেনা, সবাই কী একরকম হয়? কুহুর স্বপ্ন আলাদা। ও চায় অনেক উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে। একা থাকলেই ওই চিন্তাটা করে ও। সেখানকার সব খুঁটিনাটি এমনকি পুঁতে আসা পতাকাটার ছবিও ওর দেখা হয়ে গিয়েছে।

আসলে ওর এই পাহাড়ে ওঠার স্বপ্নের পেছনে দু’দুটো কারণ আছে। ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন তেনজিং নোরগের এডমন্ড হিলারির ওপরে লেখা একটা বই পড়েছিল ও। ওই বইতে এভারেষ্ট অভিযানের কথা ছিল।তখন ওর খুব হিমালয় দেখার ইচ্ছে হয়।বাবার কাছে বায়না করে দার্জিলিং গিয়েছিল ও, মা,বাবা আর দিদি। সেসময় থেকেই পাহাড় চূড়োয় ওঠার একটা বাসনা মনে পুষে রেখেছে। স্কুল থেকে দেওঘর বেড়াতে গিয়ে ক্লাস এইটে বন্ধুরা মিলে টিলায় চড়েছিল। তাতে ওর তেমন তৃপ্তি হয়নি।

অনুকে বলেনি, কথাবার্তা চলছে, সামনের মাসেই ও একটা মাউন্টেয়ারিং ট্রেনিং ক্লাবের সঙ্গে পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিতে পুরুলিয়া যাবে। টিউশানির টাকা জমিয়েছে।দেখা যাক খরচখরচা বাবদ কত লাগে।

ভেবেছিল মা আপত্তি করবে। করেনি। শান্ত গলায় বলল, “তোর ইচ্ছে হলে চলে যা। আমাদের নিয়ে ভাবিসনি। আমি চালিয়ে নেব।বিপদের ভয় আমি পাইনা। ও নিজের ইচ্ছে মত আসে। তোর বাবার এই এ্যাটাকটা  আমাকে জোর শিক্ষা দিয়েছে।”

মা যেটা বলেনি সেটা মায়ের কাছে আরো দুর্বিষহ! দিদির বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। ও জানে ওই দুঃখটা মা সবসময় লুকিয়ে রাখতে চায়। কান্না পেলে বাথরুমে জল ঝরিয়ে আসে।

কুহু ভাবছিল আজই ও একবার দিদির কাছে যাবে। ও যে দিদির কাছে মাঝেমধ্যে যায় মাকে বলেনি। মা জানেনা। কুহু ভেবে নিয়েছে নানা রঙের সম্পর্ক গুলো নানা তুলিতে আঁকাই ভাল। নাহলেই রঙ গুলো মিলেমিশে ছবিটাই বিদ্ঘুটে হয়ে যাবে। তাই অনুকে ও পাহাড়ের কথা বলেনা। এমনকি বাংলার মুখবন্ধ সাময়িকীটায় পাহাড়ের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাসটাতে যে ওর বেশ নেশা হয়েছে সেকথাও অনু জানেনা। মাকে ও বলেনা  মায়ের বড় মেয়ে্র বাড়ি ওর নিয়মিত যাতায়াতের কথা।

ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে দিদির গুরুত্ব ছিল ওর থেকে অনেক বেশি। ও থাকত দিদির আড়ালে। বাবা ছাড়া তেমন করে ওর মনের কথা জানতে চাইত না কেউ। এমনকি দিদির ছোট হয়ে যাওয়া কালো কোটটা যে ওর একেবারেই পরতে ভাল লাগত না সেকথাও কেউ জানতে পারেনি। দিদিকে লাল নতুন কোট কিনে দেবার পর ওর যে ওরকম একটা লাল কোট পাবার ইচ্ছে হয়েছিল, সেকথাও ও বেমালুম গিলে ফেলেছে ।

একমাত্র বাবার কাছে কিছু কিছু সামান্য জিনিসের বায়না করত ও। তার একটা ছিল বেড়ানো সংক্রান্ত। সবসময় বেড়ানোর জায়গা পছন্দের সময় ওর ইচ্ছে মেনে যাওয়া হত পাহাড়ে বা পাহাড় তলিতে।আর এখন সেই মানুষটাই একেবারে অচল পয়সা। পাহাড়ের পথে চলতে গিয়ে ও দৌড়ত আর দিদি হাঁফাত। আর ছোট ছোট টিলায় উঠতে ওর সঙ্গী হত বাবা। জম্মুতে বৈষ্ণোদেবীর পথে, কেদারের পথে,একটানা হেঁটেছে ও। একটুও ক্লান্ত হয়নি।

কুহুর এই পাহাড়ে ওঠার টান দেখে বাবা বলত, “দেখো,আমার এই মেয়ে বড় হয়ে পাহাড়ে উঠেই সবাইকে অবাক করে দেবে।” কথাটা সত্যি হবে কিনা জানেনা ও। এখন ওর একটাই স্বপ্ন এভারেস্ট না হোক কোন একটা বড় পাহাড়ের চূড়োয় উঠবে ও। আর ভারতের পতাকা পুঁতে, পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলবে। ব্যাস্, তাহলেই আপাততঃ ওর বাসনার শান্তি।

চুলের খোঁপাটা খুলে গিয়ে চুলগুলো মুখে ঘাড়ে পড়ছে। সামলানো যাচ্ছে না। চাটুতে রুটি ওল্টাতে ওল্টাতে ছবির কুহুকে স্পষ্ট দেখতে চাইছিল ও। পারছিল না। ছবিটা বারবার সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছিল।

(ক্রমশ)

Author

2 thoughts on “অক্সিজেন। পর্ব ৩। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *