অক্সিজেন। পর্ব ২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

3

(গত পর্বের পর)

ডাক  আসে

ধূসর আকাশের গায়ে ঠেস দিয়ে থাকা পাহাড়ের চূড়োগুলো কেমন ঝিম হয়ে এ ওর পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একা, একদম একা একা  দাঁড়িয়ে আছে।পেছনে হলুদ আলো ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ওঠা সূর্যের আলোয় একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে চূড়োগুলো।ওই শিখরের দিকে এগিয়ে চলেছে ,ওরা কারা?দূরবীনে  ওদের দূর থেকে কালো কালো সচল বিন্দু মনে হচ্ছে।ওই সারি সারি বিন্দুর একটা  কুহু।একদম মাঝে চলেছে ও।ওরা কি পারবে শিখরে পৌঁছতে?

এই অবধি দেখতে দেখতেই ঘোরটা কেটে গেল কলিংবেলের আওয়াজে।চোখটা কেমন বুজে গিয়েছিল।রাত জাগার ফল।টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।কাগজ গুটিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে  দরজা খুলে দিল কুহু। আটটা বাজে।রতুর মা কাজে এলো।আসলে কাগজটাই যত নষ্টের গোড়া।ওটা দেখতে দেখতেই দিবা স্বপ্নে ডুবে গিয়েছিল ও।

এখন রতুর মাকে যা যা দরকার সব বলতে হবে।রতুর মা এলে কোন ভাবনা চিন্তা করা যায়না।ও বাড়িতে পা দিয়েই নানান ধারাবিবরণী শুরু করে।রান্নাঘরের সিঙ্কে বাসন মাজতে মাজতে  রতুর মা বলল, “দিদি শুনেছ,তালিবানরা এসে গেছে।”

ডাইনিং টেবিলে কাগজ ছড়িয়ে, সামনের চেয়ার টেনে আবার বসেছিল ও।কিন্তু কাগজ পড়া গেল না। চমকে উঠল। কাগজটা সরিয়ে চায়ের কাপটা টেনে তাকাল রতুর মার দিকে, “কীসব ছাইপাঁশ বকছ?তালিবানরা আবার কোথায় এলো ?”

“ওই যে কাশ্মীরে।সেই যে গো যেখেনে অরুণা বৌদিরা বেড়াতে গেছিল। খুব ঠান্ডা!রাস্তায় বরফ জমে…।”

“বুঝেছি।তা তোমায় বলল কে?”

“রতুর বাবা। মাছের পাইকিরি ঠেকে মাছ  আনতে আলতাড়া গেছিল না, সেখেনে সবাই বলাবলি করছিল।”

“যতসব ভুলভাল।ওরা এলে রতুর আর ইস্কুলে যাওয়া হবে না,তুমি আর কাজে বেরোতে পারবে না।আর আমি যেই বোরখা না পরে বাইরে যাব, বন্দুকের গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকব বুঝলে।ওরা আসেনি, তবে কোনদিন আসবেনা যে সেকথাও বলতে পারিনা।”

রতুর মা হাত থামিয়ে ফেলেছিল।আবার ঘস্‌ঘস্‌ করে বাসনে হাত চালাতে চালাতে বলল, “না বাবা ,এসে কাজ নেই।একে করোনা, এর ওপর যদি তালিবান আসে, এখন তো আমার মেয়ের ইস্কুল বন্ধ হয়ে রয়েছে।পরে খুলবে বলছে।তালিবানরা এলে…।না বাবা…।ওদের আর আসতে হবেনি।”

“তবে? রতুর বাবাকে বলে দিও, তালিবান আসেনি।”

কাগজটা আবার টেনে নেয় ও।রতুর বাবা মাছের ব্যবসা করে।একবার মাছ কিনেছিল ওর কাছ থেকে।মাছ ভালো।তবে লোকটার মুখে ভক্‌ভক্‌ করে চোলাইএর গন্ধ।তার সঙ্গে বিড়ির গন্ধ মিলেমিশে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।গা গুলিয়ে উঠেছিল। ওর কাছ থেকে আর মাছ না কেনার প্রতিজ্ঞা করেছিল সেদিনই।

রতুর মা বাসন মাজতে মাজতে নিজের মনে বিড়বিড় করে কিসব বকছে।হয়ত তালিবানদের, কিংবা নিজের বরকে গালাগালি করছে । ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছবিটা আবার মন দিয়ে দেখে ও। গতকাল এভারেস্টে উঠেছে একটি মেয়ে।আসামের মেয়ে,ধরিত্রী ভারালি।ভারতীয় পতাকার পাশে তার ছবি ছেপেছে সব কাগজে।সারা কাগজে আফগানিস্থানে তালিবান অত্যাচারিত মানুষের ছবি।তার মাঝে একমাত্র ধরিত্রীর ছবিটাই জ্বলজ্বল করছে।

ধরিত্রীর পেছন পেছন আর একটা মেয়েও পাহাড়ের চূড়োয় উঠেছে।দাঁড়িয়ে আছে ধরিত্রীর পাশে।কুহু চ্যাটার্জী।অনেকটা চড়াই পার করে মেয়েটা উঠেছে।তারপর ছবিতে সোজা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।এবারেও ঘোরটা কেটে গিয়ে নিজেকে নিজেই জিভ ভ্যাংচাল ও।জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছে।অনু ঠিকই বলে,ও একটা পাগল।

কাগজটা রেখে দিয়ে একহাতে মাথার খোঁপাটা জড়াতে জড়াতে, না পেরে, “ধুস্‌” বলে ছেড়ে দিল কুহু।অন্য হাতে বেজে থাকা মোবাইলটা ধরে ছিল। সেই এক গান বাজছে।“এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই।”

“সুমন চাটুয্যের এ গানের অনেক বয়স হল।এটা ছাড়া অন্য কিছু লাগা।” কতবার ও বলেছে অনুকে। শোনেনা। বলে “এই গানটাই আমার ফার্স্ট চয়েস। এটা চালালে আমার দিন ভাল যায়।”

ভীষণ জেদ ।ওই জেদটুকু  ছাড়া অনু লেটার পাওয়ার মত ভালো মেয়ে।

অনুর সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ক্লাস ফাইভ থেকে।প্রাইমারীর পর ফাইভে নতুন বড় স্কুলে ভর্তি হয়ে কেমন যেন দিশাহারা লাগছিল।সেই সময় অনুও ভর্তি হয়।ওর পাশেই বসত অনু।কারণে অকারণে কান্নাকাটি করত ও।ওকে সামলাতে গিয়ে নিজের অবস্থা ভুলে গিয়েছিল কুহু। অনুর নাম অনুরাধা।আর ও কুহু।

ওদের সবসময় জুড়ে থাকা দেখে কলেজে বন্ধুরা খ্যাপাত কবিতা বলে, “কুহু কুহু,  কোকিল ডাকে, রাধার কাননে।”

ফোনে পাওয়া গেল না অনুকে।ওটা বন্ধ করে দ্রুত হাত চালাচ্ছিল ও। সকালে একটু তাড়াতাড়ি ওঠাই স্বভাব কুহুর। উঠে ব্রাশ করেই একটু আদা ছোলা খেয়ে ও দৌড়তে যায়।বাড়ি ফিরে লেবু সমেত লিকার চা আর একবাটি মুড়ি বাদাম খেতে খেতে সকালের কাগজের হেডলাইন গুলো উলটে পালটে দেখে।আজ রুটিন একটু এলোমেলো হয়েছে।দৌড়নোর সময় শিপ্রাদির সঙ্গে দেখা।উনি বাজারের ব্যাগ হাতে মর্নিংওয়াকে যাচ্ছিলেন।দৌড় থামিয়ে দুটো কথা বলতে হল।

মায়ের ইচ্ছের মান রাখতে ওদের গান শিখতে যাওয়া।দিদি ভাল গাইত,নিয়মিত অভ্যাসও করত।ওর তেমন ভাল লাগা না থাকলেও ক্লাস নাইন অবধি নিয়মিত শিখে যেতে হয়েছে। ছোটবেলায় শিপ্রাদির বাড়িতে যেতে ভাল লাগত একটাই কারণে।শিপ্রাদির গান শেখানোর ঘরে একটা বড় এ্যাকোরিয়াম ছিল।সেখানে অনেক রঙিন মাছ খেলা করত। প্লাস্টিকের কচ্ছপ, প্লাস্টিকের অক্টোপাস দিয়ে সাজানো ওই কাঁচের বাক্সে মাথা দোলানো সবুজ শ্যাওলার মাঝখান দিয়ে সাঁতার কেটে যেত ছোট বড় রঙিন মাছেরা।হাঁ করে দেখত ও।

তবে শিপ্রাদি ছিলেন কড়া দিদিমনি।গানে ফাঁকি দেওয়া যেতনা। ওর নিজের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভিত বলে কিছু থাকলে সেটা ওনার তৈ্রি করে দেওয়া। ও শুনেছিল উনি বিয়ে করেননি।সারাজীবন ভাই বোন ভাইপো ভাইঝি নিয়েই কাটিয়ে গেলেন। তবে এখনও খুবই হাসিখুশি।ওনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল ও।

উনি বকে উঠলেন।“যা দৌড়ো।কেবল ফাঁকিবাজি।তুই আর পাল্টালি না।”ওনার কাছ থেকে চলে যেতে যেতে ও ভাবছিল,উনি দিদির কথা একবারও জানতে চাইলেন না তো।তাহলে কী উনি সবটাই জানেন?

বাড়ি ফিরে চা বিস্কুট  খেতে খেতে কাগজ ওল্টাচ্ছিল। তালিবানদের মধ্যিখানে ধরিত্রী এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছিল।মাঝের পাতার ছোট বিজ্ঞাপনটা প্রথমে দেখতে পায়নি। তারপরেই নজরে এলো অনুর নাম এসেছে ‘বাংলার মুখবন্ধ’ সাময়িকীর বিজ্ঞাপনে। লেখক সূচীতে অনুর নাম দেখে উথলে উঠে ফোন করতে গিয়েছিল অনুকে।“এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই” বারদুয়েক বেজে থেমে গেল।নির্ঘাৎ কাল রাতেও অনেকক্ষণ জেগেছে মেয়েটা। আর সকালে উঠতে পারেনি। কুহু আবার ফিরে যাচ্ছিল রান্নাঘরে। সকালের রুটি বানাতে হবে।মা এখন বাবার ঘরে।সেরিব্রাল স্ট্রোকের পর থেকে বাবার দেখা শোনার জন্য একটি মেয়ে আসে।কিন্তু বাবা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়লে মাকেই হাত লাগাতে হয়। এখন বাবাকে রেডি করে মা স্কুলে যাবে।

আবার পত্রিকাটার কথা মাথায় এল কুহুর।অনুর লেখাটা নির্ঘাৎ ভালই হয়েছে। নাহলে ওরা ছাপে?ওদের কি লেখকের অভাব? ওই সাময়িকীটাই এখন বাংলা বাজারে সবচেয়ে ভাল চলছে । কিন্তু নামটা নিয়ে হাসাহাসি করে ওরা।পত্রিকার নাম ‘বাংলার মুখবন্ধ’ কী করে হয়?মুখ বন্ধ রেখে কাগজে খবর দেবে কি করে?

পাপু অবশ্য গম্ভীর ভাবে বলেছিল, “সাময়িকীর কর্তা ব্যক্তিদের ভাল বুদ্ধি আছে।পত্রিকার ভবিষ্যৎএর কথা ভেবে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিয়েছে।”

“কীরকম?” অনু জানতে চেয়েছিল।

“আরে এরা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে। কোন খবরে কর্ত্তৃপক্ষ মুখবন্ধ করতে বললে বলবে আমরা তো মুখ বন্ধ করেই আছি।”

বাচ্চু আরো সেয়ানা।বলেছিল,“আরে ওসব নয়।স্রেফ অক্ষরের খেলা।একটা সিনেমার নাম ‘ক’ দিয়ে রেখে হিট করলে,ওই পরিচালকের পরের সবকটা সিনেমার নাম ‘ক’ দিয়ে রাখা হয়,জানিস নিশ্চয়ই।”

“তাতে কি?” অনু ভ্রু কুঁচকেছিল।

“তুই না একটা ফিউজড ল্যাম্প আছিস। কিকরে যে পত্রপত্রিকায় তোর পদ্য ছাপা হয় কে জানে? তাতে অনেককিছু।কুহু ঠিক জানে। কুহু বল তো।”

“পত্রিকার মালিকের বউ তার কর্তাকে বলেছে হয়ত, ‘গুরুদেব বলেছেন,এই এই অক্ষরগুলো এই এই ভাবে সাজিয়ে নাম রাখলে পত্রিকা হিট করবে।শেষে দন্ত্য ন আর ধ এর যুক্তাক্ষর চাই।’”কুহু কথা শেষ করে মিটিমিটি হাসে।

“এই তো, তুই মাইরি গুরুদেব লোক!” বলে ওকে জড়িয়ে ধরতে এসেছিল বাচ্চু।

এক ঝটকা দিয়ে সরে যায় কুহু।

বাচ্চু দুকানে হাত দিয়ে বলে, “স্যরি মাইরি, মাঝে মাঝে মনে থাকে না তোরা ফিমেল।ঠিক আছে। তোর একটা বিড়ি পাওনা হল।”

কুহু বলেছিল, “এক থাপ্পর খাবি।দেখ অনেকদিন ধরে বলছি, বারবার ওই মা দিয়ে  বিচ্ছিরি শব্দটা বলা বন্ধ কর।আর আমি বিড়ি খাই?কিপটে একটা!খাওয়াবি না বলে দিলেই পারিস।”

(ক্রমশ)

Author

3 thoughts on “অক্সিজেন। পর্ব ২। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *