অক্সিজেন। পর্ব ২৪। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

2

গত পর্বের পর

হারানো দিন, বিস্কুটের টিন

অনেকদিন বাদে আবার বাড়িতে রোদ উঠেছে যেন।বড় বিস্কুটের টিনটা মেঝেতে রেখে একটা বেঁটে টুল টেনে নানা ধরণের বিস্কুট কৌটোয় ভাগ করে করে রাখছে কুহু। আর ওপরে বিছানায় বসে সেই ভাগাভাগি চাক্ষুষ করছে কুহুর বাবা মা । বাবার সেবার জোর শরীর খারাপ হওয়ায় মা সংসার থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নেয়।তখন থেকেই পুরো সংসার চালনার ভার কুহুর ওপরে পড়ে।তাই সুযোগ পেয়ে  সংসারের টাকা বাঁচিয়ে ভাঙা আর আস্ত বিস্কুটে ভর্তি বড় টিন কেনার কথা ভেবেছিল ও। সেটাই কিনেছে। ওদের ছোটবেলায় পুজোর ঠিক আগে আগে এরকম একটা টিন বাড়িতে আসত তো।

বাড়ি ঢুকেই টিনটার রহস্য ফাঁক করেনি, ওদের পড়ার ঘরের টেবিলের তলায় রেখে দিয়েছিল কুহু।একটু আগে বার করে এঘরে এনেছে। তবে ভাবতে পারেনি, বাবা মা  বিস্কুটের টিন দেখে  এতটাই খুশি হবে!

ওই টিন থেকে বিকেলের চায়ের সঙ্গে খাবার মত দু’একরকমের স্ন্যাক্স্‌ বিস্কুট রেখেছিল প্লেটে।ওরা বেশ ছেলেমানুষের মত চেয়ে চেয়ে খেয়েছে।

বিস্কুট ভাগ করতে করতে ও বাবা মাকে দেখছিল মন দিয়ে। কেমন করে যেন টের পাচ্ছিল এই রোদের দিনের মেয়াদ বেশি নয়। যে কদিন হাতে আছে সেকদিন ভোগ করে নেওয়াই ভাল।কদিন আগেই ভেবেছিল মা বাবাকে নিয়ে দীঘা থেকে ঘুরে আসবে।মাকে বলেওছিল কথাটা। কতদিন তোমরা কোথাও বেড়াতে যাওনি।যাবে না কি?”

মা হাসল, নিরুপায়ের মত।বলল ,“খ্যেপেছিস?তোর বাবাকে নিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনতে পারব না।তার থেকে থাক, যেকদিন  থাকে।”

কথাটা খুব হার্ট করেছে তাকে। বেশ বুঝেছে, এতদিন ধরে ওই নিদারুণ সত্যের জন্য মা নিজেকে প্রস্তুত করছে।তাই ওর হাতে নিজের সাধের সংসার ছেড়ে দিয়েও নির্বিকার আছে।

এখন বাবা মা দুজনেই ছেলেমানুষের মত বিস্কুট খাচ্ছে । সেই ফাঁকে দিদির জন্য বেছে বেছে ভাল বিস্কুটগুলো বড় একটা কৌটোতে ঢোকাচ্ছিল ও। মা হঠাৎ এদিকে তাকাল একবার। চোখে চোখ পড়তেই কুহু ঘাবড়ে গেছিল। তারপর মা নজর সরিয়ে নিল।

মাঝেমাঝে ভাবে কুহু  এদের দুজনকে রেখে ও কিকরে পাহাড়ে যাবে।পাহাড়ে উঠলে জীবন তো ভয়ংকর ভাবেই অনিশ্চিত হয়ে যায়। ওর কিছু হয়ে গেলে এদের দেখবে কে? কিন্তু ও নিজে কিভাবেই বা নিজের বেঁচে থাকার লক্ষ্য ত্যাগ করে?

ওই একটা সাধ নিয়েই তো বেঁচে থাকা।বাচ্চুর কাজের ব্যাপারটা নিশ্চিত হতেই ওর মাথা থেকে বড় একটা ভার নেমেছে।কলেজের ক্লাস সেরেও অফিসের কাজটা ভালই সামাল দিচ্ছে ও। সেদিন অবশ্য একটু কাঁদুনি গাইছিল।বলছিল, “এখন আমার ফ্রি টাইম বলে কিছু রইল না।সারাক্ষণ কাজ, কাজ আর কাজ।বাড়িতে থাকলেই বাজার, দোকান, রেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। কত বলব? তারপরে কলেজ। কলেজ থেকেই অফিস। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত নটা। বই নিয়ে বসি।পড়া কিছু হয়না। খেতে দেবার আগেই চোখ বুজে আসে।”

অনু সেই শুনে বলল, “হাঁফিয়ে যাচ্ছিস না? আমার তো ফাঁকা সময় না পেলেই হাঁফ ধরে।”

ওসব শুনেটুনে খুব রাগ ধরছিল কুহুর। অনুটা তো প্রচন্ড ইম্‌প্র্যাক্টিকাল।কিন্তু বাচ্চু? হাঁড়ি চলছিল না, এখন ভুলভাল বকছে।ওর মুখের চেহারা দেখে বাচ্চু অবশ্য সামলে নিল, আর বেশি বকল না। পাপু ওকেই বলল, “কিরে তোর কী হল?মুখটা পালটে ফেললি কেন? মুড অফ?”

ও হেসেই বলেছিল, “ হ্যাঁ । হিপোক্রেসি পছন্দ হয়না। অনুর হাঁফ ধরে, ভেবেচিন্তে কবিতা লিখতে না পারলে। কিন্তু বাচ্চুর আজকাল ফ্রি টাইমের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে কেন, বুঝতে পারছি না।আমার বাবা সকালে চাকরি করে সন্ধেয় নাইটক্লাস করে বি.কম পাস করেছিলেন।জীবনে কার কোনটা এমার্জেন্সি সে নিজেই ঠিক করুক।”

হাওয়া বুঝে বাচ্চু সুর নরম করে বলেছিল,“চাকরি দরকার ছিল, পেয়েছি বলেই বেঁচেছি। কিন্তু মনের কষ্ট কার সঙ্গে শেয়ার করব?তোরাই তো আছিস।কুহু তুই খ্যেপে যাসনা মাইরি।”

“আবার? আবার ওই শব্দ?”কুহু মারতে হাত তোলে,বাচ্চু মাথাটা সরিয়ে নেয়। আর ওরা দেখে অজয় ঢুকছে।তবে সেই বিখ্যাত ঝিন্‌ঝিনি সঙ্গে নেই।

ওদের দেখেও অজয় বেঞ্চের অন্য দিকে গিয়ে বসে।ওরা সেদিকেই ধাওয়া করে।

“আরে তুই?”বাচ্চু গায়ে চাপড় মারে, “কিরে? তোর বইএর মলাট কোথায় গেল?”

অজয় চুপচাপ বিড়ি টানে।পাপু বলে, “বস্‌, ঝিন্‌ঝিনির খবর কী?”

“কেন? জেনে কী করবি? তোরা তো ওকে পছন্দ করিস না।”

এবার অনু উৎকন্ঠিত গলায় ওদের ধমক দেয়।তারপর অজয়ের দিকে ফেরে।

“ওর খবর সত্যি কিছুই জানা নেই। সেই যে হাওয়া হল…।তুই খবর জানিস তো?”

“ও এই কলেজ ছেড়ে বঙ্গবাসীতে ভর্তি হয়েছে।আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই।হল?”

কথা শেষ করে অজয় আর দাঁড়ায় না।ওর চলে যাওয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ওরা চারজন । বোঝাই যাচ্ছে ওদের আর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার জন্য অজয় কী ওদেরই দায়ী করল?কে বলতে পারে?হয়ত  তাই করেছে।

আড্ডাটা ভেঙে গেল অজয় চলে যেতে।ওরা চলে যেতে অনুকে টোটোতে তুলতে যাচ্ছিল কুহু।কানের গোড়ায় জুহুর ফিস্‌ফিস্‌ শুনতে পাচ্ছিল ও।সাড়া দিচ্ছিল না।জুহু নাছোড়বান্দা হয়ে বলছিল, “আমার কথাটা একবার শোন।শোন না।”

অনু বলল, “আমার একটা কবিতার বই আগামী বইমেলায় বেরোবে।প্রুফ দেখছি।খবরটা আর কাউকে দিইনি।তুই বলিস না।ওদের সারপ্রাইজ দেব।”

কুহু ভাবল বলে, এই জুলাই এ  ও পাহাড়ে উঠবে ভাবছে।তারপর বলল না।ওরা তো কেউ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনা।সবকথা ও নিজে থেকে বলবে কেন?”

(ক্রমশ)

Author

2 thoughts on “অক্সিজেন। পর্ব ২৪। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. পারিবারিক সম্পর্কের দৈনন্দিন যাপন, সেও তো অন্য এক পাহাড় চড়া। তার চড়াই উৎরাই ভালই ধরা পড়ছে লেখায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *