নায়িকার ভূমিকায়। দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য

3

১৯২০এর দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ চরিত্র হল তার পুরাণ নির্ভরতা। একদিকে রাজা  হরিশচন্দ্র থেকে নল-দময়ন্তী, ভস্মাসুর-মোহিনী বা শ্রীকৃষ্ণের মহিমা বর্ণন, চলচ্চিত্র নির্মাতারা ভরসা  রাখছিলেন মহাকাব্য-পুরাণ থেকে পাওয়া এমন গল্পকথার উপর যার সঙ্গে ভারতীয় দর্শক সমাজ  পরিচিত। অন্যদিকে হিন্দু পুরাণ নির্ভরতার রাজনৈতিক গুরুত্ব হল তা সমসাময়িক জাতীয়তাবাদী জনপ্রিয়  সংস্কৃতির নানা নির্মাণের মধ্যে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছিল। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রযুক্তি এদেশে আসার পরপরই দাদাসাহেব ফালকের মত অনেক ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালকরা ঝুঁকেছিলেন এক ‘স্বদেশি ছবির’ ধারণার দিকে। তাঁদের বক্তব্য ছিল চলচ্চিত্র প্রযুক্তি পশ্চিম থেকে এলেও  এই প্রযুক্তির ব্যবহার করে এমন ছবি হওয়া উচিত যার বিষয়বস্তু ভারতের স্ংস্কৃতির একেবারেই নিজস্ব। স্বভাবতই এই ভারতীয়/ স্বদেশি/ জাতীয়তাবাদী ছবির নির্মাণে হিন্দু পুরাণ নির্ভর চরিত্র ও প্লটের গুরুত্ব  ছিল অপরিসীম। আর সেই সূত্র মেনেই ভারতীয় ছবির এই প্রারম্ভিক পর্যায়ে ছবির পর্দায় ভিড় করতে থাকেন বিভিন্ন হিন্দু পৌরাণিক নায়ক ও নায়িকা ও তাদের মাহাত্ম্যের ‘মিথ’।

সেই সময়ে বাংলায় চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যতম প্রধান সংস্থা ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেডও এই মিথ ও মিথলজিকাল এর জনপ্রিয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে প্রযোজনা করতে থাকে মহাভারত (১৯২০), বিষ্ণু অবতার (১৯২১), নল দময়ন্তী (১৯২১)ইত্যাদি ছবি। মজার ব্যাপার হল বাংলায় হোক কী অন্য প্রদেশে, এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ ছবিগুলির নায়িকারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলেন অ্যাংলো  ইন্ডিয়ান বা ইহুদি নর্তকী বা অভিনেত্রীরা । তো একদিকে এই ছবিগুলো যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তুঙ্গে থাকা এক সময়ে আত্মস্থ করতে চাইছে স্বদেশি চেতনার নানান অনুষঙ্গ ও উচ্চারণকে; ছবিগুলোর নায়িকার ভূমিকায় থাকছেন স্বদেশি রাজনীতির অন্যতম ‘অপর’- অহিন্দু অ্যাংলো ‘ইন্ডিয়ান’ মহিলারা।  শুধু তাই নয়, হিন্দু পৌরাণিক নায়িকার সিনেম্যাটিক কল্পনা ভাষা খুঁজে পাচ্ছে পেসেন্স কুপার বা রিনি স্মিথের মত নায়িকাদের পর্দায় উপস্থিতিতে ও অভিনয়ের কায়দায়। কেমন ছিল এইসব অ্যাংলো ‘ইন্ডিয়ান’ অভিনেত্রীদের ঘিরে বাংলার চলচ্চিত্রের আদি পর্বের আত্ম ও অপরের আদানপ্রদান? অল্প কিছু কথা এই প্রসঙ্গে।

চলচ্চিত্র একেতো পাশ্চাত্য প্রযুক্তি, তায় আবার তার বিভিন্ন কলাকৌশলে জন সমাজের সামনেই প্রদর্শিত হয় নারী-পুরুষের শারীরিক চলন-বলন ও তার নানা বিভঙ্গ! এ কথা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার নয় যে, জাতীয়তাবাদী  রাজনীতিতে এই দুয়েরই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছিল আদর্শ ভারতীয় নারীত্বের সংজ্ঞা। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গবেষকরা দেখিয়েছেন ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগ- এই পর্বের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী  রাজনীতিতে সমাজ ও তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে ভেঙে নেওয়া হয়েছিল অভ্যন্তরীণ (inner) ও বহির্ভাগের (outer) দুই পরিমণ্ডলে । বিজ্ঞান, প্রযুক্তি,  প্রশাসনিক শক্তির মত বিভাগকে বহির্ভাগের অংশ হিসেবে দেখে জাতীয়তাবাদী চিন্তকরা কার্যত স্বীকারই করে নিয়েছিলেন পাশ্চাত্যের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ এবং মনোনিবেশ করছিলেন শিখে নিতে। কিন্তু ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির মত ক্ষেত্র এই চিন্তকদের কাছে অভ্যন্তরীণ, এবং এইসব ক্ষেত্রে ভারতই শ্রেষ্ঠ। এই প্রসঙ্গে যা বিশেষ ভাবে মনে রাখার তা হল, নারী/নারীত্বের স্থান ছিল অভ্যন্তরীণে। অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় মনে করাচ্ছেন, এর ফলে এই সময় জুড়ে ব্রিটিশদের সহায়তায় প্রায় কোনও সংশোধন আন্দোলনই হচ্ছেনা, যেখানে মহিলাদের প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ।

এইসময়ের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের কল্পনা সংজ্ঞায়িত করছিল মহিলাদের ঘিরে নানা সামাজিক রীতি নীতির খুঁটিনাটি। কিন্তু এই অভ্যন্তরীণ ও বহির্ভাগের সীমানায় চলচ্চিত্র নিয়ে এল এক  অদ্ভুত দ্বিধা ও স্ংশয় – শ্বেতাঙ্গ ইংরাজি ভাষী অভিনেত্রীরা জন-মানসে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পেলেন  আদর্শ হিন্দু পৌরাণিক নায়িকা হিসেবে! প্রথমেই বলতে হয় পেসেন্স কুপারের কথা, যিনি ভারতীয়  চলচ্চিত্রের এই পর্বে হাতে গোনা কয়েকজন তারকাদের মধ্যে অন্যতম একজন। ম্যাডান থিয়েটার্সের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার আগে পেসেন্স কাজ করতেন ব্যান্ডম্যান মিউজিকাল কমেডি নামে একটি ইউরেশিয়ান ডান্স ট্রুপে। এই ট্রুপ ছেড়ে শ্রীমতী কুপার যখন ম্যাডানে যোগদান করেন তখন তাঁর বয়স ১৪ কী ১৫ বছর!

দময়ন্তী (১৯২১) থেকে মোহিনী (১৯২২) বা কমলে কামিনী (১৯২৪)সিনেমার পর্দায় পৌরাণিক কল্পনা রূপ নিতে থাকে পেসেন্স কুপারের আদলে ও সু-অভিনয়ে। ১৯২৪ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী ম্যাডান প্রযোজিত ও কুপার অভিনীত ১৭ রিলের পত্নী প্রতাপ মুক্তি পায় কলকাতার কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে। বাংলায় এই প্রথম কোনও ছবিতে কোনও অভিনেতা/অভিনেত্রী দ্বৈত চরিত্রে। যমজ বোনের চরিত্রে পেসেন্স কুপারের অভিনয় দীর্ঘদিন চর্চিত হয় কলকাতার দর্শক ও পাঠক সমাজে। কিন্তু শুধুই কি পর্দার দ্বৈত চরিত্র? এ যুগের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীরা তাদের অভিনেত্রী পরিচয় আর ব্যক্তিগত জীবন এই দুই ভিন্ন পরিচিতি নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই কি এক দ্বৈত চরিত্রের অভিনয় করে যাননি?

 

এ প্রশ্নটি তুলছি তার কারণ, ১৯২০-এর দশকে বাংলার একের পর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীরা তাদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাম ও পরিচিতি বদলে হয়ে উঠছেন এক একটি আইকন যাদের বিশেষ খ্যাতি হিন্দু পৌরাণিক নায়িকা হিসেবে । উল্লেখ্য, অনস্ক্রিন (পর্দায়) উপস্থিতির বাইরেও তাদের নামকরণ হচ্ছে হিন্দু পৌরাণিক নায়িকাদের নামে। যেমন সীতা দেবী পর্দা ও পর্দার বাইরে এক আইকনিক তারকা এই সময়কার। লাইট অফ এশিয়া (১৯২৫) ছবিতে গোপার চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু এই সীতা দেবীর নেপথ্যে যে রিনি স্মিথ ছিলেন তাকে বাংলার দর্শক সমাজের খুব বেশি জানা হয়নি। গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের লেখায় জানতে পারছি, কলকাতার কিড স্ট্রিটের রিনি স্মিথ স্টেটসম্যান কাগজে ‘অভিনেত্রী চাই’ এর বিজ্ঞাপন দেখে স্টুডিও এসে পৌঁছান। নির্মাতাদের পছন্দ হয়ে যায় তাঁকে। ছবি মুক্তির সময় তাঁর নাম বিজ্ঞাপিত হয়েছিল এই ভাবেঃ “রক্ষণশীল অভিজাত বংশীয় হিন্দু পরিবারের বিদুষী কন্যা-সীতা দেবী।” পর্দার দ্বৈত চরিত্রের চেয়ে পর্দার বাইরের এই দ্বৈত চরিত্রও কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। এই দ্বৈত চরিত্রের অভিনয় ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে ১৯২০-১৯৩০ এর দশকের বাংলার চলচ্চিত্রের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের জীবন।

(ছবিটি পেসেন্স কুপারের, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত)
(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দ্য নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্র্যাগমেন্টসঃ কলোনিয়াল অ্যান্ড পোস্ট কলোনিয়াল হিস্টরিস, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৩।

গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ, সোনার দাগ (শতবর্ষের আলোয় বাংলা চলচ্চিত্র) ১ম পর্ব, যোগমায়া প্রকাশনী, ১৯৮২।

 

স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র, গবেষক এবং অধ্যাপক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।

Author

3 thoughts on “নায়িকার ভূমিকায়। দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য

  1. অসাধারণ, তথ্যপূর্ণ লেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *