অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২। অনন্ত জানা

বার্নার্ড প্যালিসির সেই উদ্্ভ্রান্ত দিনগুলির কথা মনে হওয়ায় আগন্তুকের ঠোঁটের প্রান্তে একটু হাসির আভাস দেখা দিল। বাড়ির আসবাবপত্রকে ভেঙে সমিধ হিসেবে চুল্লিতে গুঁজে দেওয়া!
এমন উদ্্ভ্রান্তি ছাড়া পৃথিবীতে কোনো নতুনের উদ্বোধন হয়েছে বলে মনে হয় না!
চা-এর স্টলের সামনে হাঁ-করে থাকা অন্যমনস্ক মানুষটি এতক্ষণে নিজের অবস্থান-সম্পর্কে সচেতন হলেন। অবশ্য স্টেশন চত্বর এতটাই জনবিরল যে, এই আগন্তুকের বিহ্বলতা লক্ষ্য করার জন্য আশেপাশে কাউকে দেখা গেল না। বিজ্ঞাপনী বোর্ডগুলো ও তার বিষয়বস্তু নিয়ে সেদিনের, ছেলেবেলার সেই বিস্ময় যেন আজ অধীত কৌতূহল এবং কৌতুক হয়ে দেখা দিল।
আজ তিনি বুঝলেন―এই বোর্ডগুলো আসলে লোহার ওপর পোর্সেলিনের প্রলেপ লাগিয়ে কাস্টিং-এর সময়েই ছাঁচাই করে ছাপা বা লেখা। এক-সময় এই ধরনের বিজ্ঞাপনী ও পরিচয়জ্ঞাপক বোর্ডের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। শুধু চায়ের স্টলে নয়, স্টেশনগুলির পোস্টে লাগানোর জন্য রেলওয়ের ছোটো ছোটো স্থান-পরিচায়ক বোর্ডগুলিও ছিল এমন এনামেল কাস্টিং-এর। সংবাদপত্রের হকারদের সাইকেলের রডে এমন বোর্ড লাগানো থাকত।
সেসময় তাছাড়া এনামেলের বাসনেরও যথেষ্ট ব্যবহার ছিল। একদা কলাই-করা বাসন ও অন্যান্য জিনিস তৈরি একটা বড়ো পেশাক্ষেত্র ছিল। যারা এই কালাই প্রয়োগ বা এসব তৈরি করা যাদের পেশা ছিল তাদের কালাইওয়ালা বা কালাইগার বলা হতো। পুরোনো দিল্লির মাটিয়া মহল কলাই-করা বাসন তৈরির একটা পরিচিত অঞ্চল। সেখানের গলিতে গলিতে―‘ভান্দে কালাই করা লো’ অর্থাৎ ‘আপনার বাসনপত্র টিনজাত বা টিনিং করে নিন’―বলে কালাইগারদের হাঁক শোনা যেত। মূলত তামা বা পিতলের বাসনপত্রের ওপরে টিনিং করে রান্না-খাওয়া-পানীয় জলের জন্য ব্যবহার করা যায়। অনেক কলাইয়ের পাত্র লোহার ওপরে এনামেলের পালিশ ধরিয়ে তৈরি করা হয়। অ্যালুমিনিয়ামের এবং পরে স্টিলের ব্যাপক ব্যবহার বাসনশিল্পে এবং টিনের ব্যবহার সাইন-শিল্পে কলাইয়ের ব্যবহারকে প্রায়-বিলুপ্ত করেছে। একজন প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ভাষ্যকার সন্তোষ দেশাই লিখেছেন―‘দি মিডিল ক্লাস লাভ অ্যাফেয়ার দি মডার্ন টুক উইং উইথ স্টেনলেস স্টিল।’ অর্থাৎ―‘আধুনিকের সাথে মধ্যবিত্তের প্রেমের সম্পর্ক স্টেইনলেস স্টিলের সাথে যুক্ত হয়েছিল।’ (সন্তোষ দেশাই : ২০১০) এই উচ্চারণে সমাজবেত্তার সংগুপ্ত খেদ স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
দেশাইয়ের সেই আক্ষেপ এখন আমাদের এই আগন্তুক মানুষটিকেও ছুঁয়ে গেল যেন।
―‘এমন বোর্ড এখন আর দেখাই যায় না’―একটা প্রশ্বাসিত বেদনা দেখা দিল তাঁর। অথচ যাঁরা এই ধরনের এনামেল বোর্ডের স্কিম করতেন, কনটেন্ট লিখতেন কিংবা অক্ষর আর ছবির বিন্যাস করতেন, মোল্ড বানাতেন বা কাস্টিং-এর কাজ করতেন তাঁরা সৃজনশীলতা ও করণকৌশলের প্রয়োগে কী পরিমাণ দক্ষ ছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। বলা যায়―কালাইওয়ালা বা কালাইগারসহ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরা কৌলিক বৃত্তি ত্যাগ করে অন্য বৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন।
অন্য পেশা! সে-তো প্রতললগ্ন শিকড় উৎপাটনের সািমল!
চায়ের স্টলের সামনে থেকে সরে প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে একটুক্ষণ বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন মানুষটি।
সুধার অন্বেষণ
সত্যিই সুধাময়কে খুঁজে পাবেন তো! ঠিকানা তো জানেন না, ওর টাইটেলটা যেন কী ছিল! মনে করতে পারলেন না। আসলে সেই কৈশোরের বন্ধুত্বে তো পদবি, জাতি-গোত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল না। সেদিন শুধু সুধা-ডাকেই জীবনের সমস্ত গরল দূর হয়ে যেতো। সেদিন তিনি শুধু জানতেন বয়েজ স্কুলের পিছনের যে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানের মাঠ, তার দিগন্তরেখার কাছে যে ধোঁয়া ধোঁয়া টিলাটির শৈলশিরা দেখা যায় তার পিছনে ফলসা-পারুলিয়া গ্রামে সুধার বাড়ি। তার বাবার আছে বিঘা-দুয়েক জমি, একটা বসতবাটি আর বাড়ির লাগোয়া-সীমানায় একটা ঘরোয়া নটকনার দোকান।
নাড়ুতে-মোয়াতে সুধাময়ের মায়ের সঙ্গে ছিল অকাতর পরিচয়। তাঁর মতো ডাক্তারবাবুর ছেলের সঙ্গে নটকনা-দোকানির ছেলের বন্ধুত্বে তখনকার মাঠঘাট, শালতরুবীথিতে উন্মনা পরিভ্রমণে, খাল-পাড়ের নাম-না-জানা বৃক্ষতলে পা ছড়িয়ে রঙ-তুলি নিয়ে ছবি আঁকায়, সেচের খাল-নালায় মাছ-ধরা খেলার অপার সখ্যে কেউ কখনও বাধা দেয়নি।
বাবার বদলির পর গত তিন দশকে মাত্র বারদুয়েক কলকাতায় দেখা হয়েছিল সুধার সঙ্গে, শেষবার―সে-ও প্রায় বছর-তিনেক আগে―ছেলের বই কিনতে এসেছিল কলেজ স্ট্রীটে। দেখেই চিনেছিলেন তিনি।
ভাগ্যিস সুধারা কখনও বদলায় না!
তিন ঘন্টার ঝোড়ো আড্ডায় তাঁরা পরস্পরের প্রায় কথা অনেকটা জেনেছিলেন।
সুধাময় ফলসা-পারুলিয়া গ্রামের জমি-বাড়ি বিক্রি করে গঞ্জে থাকে এখন, বাপের মতো সে-ও একটা নটকনার দোকান দিয়েছে এখান থেকে দশ-কিলোমিটার দূরের বর্ধিষ্ণু জনপদ সিড়িকোড্ডে গ্রামের বাজারে। একটা ভটভটি আছে তার, তাতেই যাতায়াত করে সে।
বন্ধুর চিকিৎসক-পিতার প্রয়াণ সংবাদ, ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজে পড়া বিদ্যে নিয়ে ঠিকে কাজ করে তার দিনযাপন, বন্ধুর কৃতী ও সফল দাদাদের অবজ্ঞা-অবহেলার বৃত্তান্ত শুনে সুধাময়ের চোখে ঘনিয়েছিল বেদনার ছায়া। সে বার বার বলেছিল সময় পেলেই তিনি যেন কৈশোরের গঞ্জটিতে একবার যান, কোনো প্রয়োজন হলে যেন বন্ধুকে জানাতে ভুলে না যান―ইত্যাদি।
এই কার্তিকেই বেলা ছোটো হয়ে এসেছে।
স্টেশন-ঘরের রাস্তাটুকু পেরোলেই বাজার―আগের মতোই আছে। দোকানপাটের সমাবেশ একটু বেশি, এই যা। স্টেশনের সামনের রাস্তা দিয়ে বাজারের এলাকা পেরিয়ে রাজ্য সড়ক। এই রাস্তাই সোজা চলে গেছে বড়ো মহকুমা থেকে জেলা সদরের বুক চিরে মেজো মহকুমার দিকে।
বাজার এলাকা এখনও ফাঁকা, বেড়ার দোকানগুলোর ঝাঁপ ফেলা, আকাশের নিচে বসা ব্যাপারিদের ঝুড়ি, সকালবেলার অবিক্রিত পসরাগুলো বস্তা-টস্তা দিয়ে ঢাকা দেওয়া। লোকজন নেই, প্যাসেঞ্জার নিয়ে রিক্সাগুলোও চলে গেছে কখন।
কাকে জিজ্ঞেস করেন সুধাময়ের কথা!
গত বছর যখন তিন দিনের জ্বরে মা চোখ বুঁজলেন, তখন খুব অসহায় বোধ করছিলেন তিনি।
সংসারটাকে এত ফাঁকা মনে হলো!
ছবি এঁকে রোজগার তাঁর সামান্য, তা-ও নিতান্ত অনিয়মিত―টাকা না-থাকলে সংসারে কে কাকে পোঁছে!
ঘরে ছবি টাঙালে পেট ভরে না। ঠাকুর-দেবতা, মহাপুরুষ-টুরুষ কিংবা বড়োজোর ফুল-টুল―সে তো ক্যালেণ্ডারেই মেলে। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাড়ির কালিমালাঞ্ছিত দেওয়ালে ছবি রাখার জায়গা কোথায়! কার ছবি কে কেনে!
সুতরাং দুটো টাকার জন্য আর্টিস্ট হওয়ার বাসনা-বেদনা তাড়িয়ে তিনি কমার্শিয়াল কাজ ধরেছিলেন। মানে বরাত অনুযায়ী এঁকে দেওয়া। জন্মদিনের উপহারে নাম লিখে দেওয়া থেকে শুরু করে থিম-অনুযায়ী বিয়ের পিঁড়ি আঁকা, পাঞ্জাবিতে, টি-শার্টের বুকে ছাপাই ছবি আঁকা, বুটিকের শাড়িতে নকশা আঁকা বা ফেব্রিকের কাজ করা ইত্যাদি।
এসব করে ক-পয়সা আর তুলে দিতে পারতেন মেজো বউদির হাতে।
মায়ের নিষ্ক্রমণের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জামা কাচতে গিয়ে দেখেন গুঁড়ো সাবানের কৌটো যথাস্থানে নেই। বাড়িতে থাকলেও তাঁকে সকালের জলখাবার খেতে ডাকে না কেউ। বিকালে বা সন্ধ্যায় কোনো বালক-বালিকার বরাতের ওয়ার্ক এডুকেশনের খাতা বানাতে বানাতে চিঁড়ে-বাদামভাজার গন্ধ পান। কেউ তাঁর ঘরে একমুঠো দিয়ে যায় না। কাগজের আপেলের গায়ে রঙ লাগাতে লাগাতে রগের পাশের শিরাদুটো ঢিপ ঢিপ করতে থাকলে চায়ের পিপাসা পায়, কিন্তু চামচ-পেয়ালার মৃদু-সংঘর্ষের টুং-টাং টুং-র্-র্-র্-টুং শব্দ থেমে গেলে যখন বুঝতে পারেন চা আর আসবে না তখন কাজ থেকে উঠে ময়লা পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিতাই হালদারের দোকানে একটা লেড়ো-বিস্কুট আর চা খেয়ে আসেন।
অনেকদিন ধরেই বুঝছিলেন এভাবে চলবে না। কিন্তু যেদিন বাবার আমল থেকে চলে আসা বাড়ির এজমালি ল্যাণ্ডফোন থেকে এক বি-এড পরীক্ষার্থী মক্কেলকে ফোন করতে গিয়ে দেখলেন সেই ফোন বিশেষ নম্বর দিয়ে লক করা―সেদিন লগুড়াঘাতের বেদনায় বুঝলেন কতটা বেহাল তাঁর দশা।
কিন্তু কী করা!
উত্তর শহরতলির দরিদ্র এলাকা ঘেঁষে বাড়ি ছিল বলে তাঁদের বাসাঞ্চলে অর্থের প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিংবা নিজেই আঁকা-শেখানোর ইস্কুল খুলে বাচ্চাকাচ্চাদের পেয়ালা, পিরিচ কলা মুলো ফুলদানি ফুল লতা পাতা পাহাড়ের কোলে উদিত সূর্য ইত্যাদি শেখাবার সুযোগ ছিল না তেমন। শুধুমাত্র শখ এবং মতাদর্শগত বিশ্বাসের খাতিরে আর্ট কলেজের ছাত্র আন্দোলনের সময় তাঁকে কাগজের ওপর পোস্টার লিখতে হতো।―ভালো হাতের লেখা হওয়ার খেসারত আর কী।
কিন্তু পেশাদার কারিগর বা পটুয়ার মতো সস্তায় শিল্পসময় বিক্রি করার কথা আগে তখনও ভাবেননি তিনি।
সুতরাং এই কাজে অক্ষরশিল্পের বৈচিত্র্যের সঙ্গে ঈষৎ পরিচয় হয়েছিল তাঁর।
মানুষের আত্মরক্ষার প্রবণতা এমনই সহজাত যে ভেতরে ভেতরে তিনিও যেন পরিত্রােণর উপায় সন্ধান করতে গিয়ে শিক্ষক শিক্ষণের বিচিত্র কোর্সের সুবাদে লেসন-প্ল্যান ও নানাবিধ সামগ্রী তৈরি ও ওয়ার্ক এডুকেশনের সামগ্রী তৈরি করে গ্রাসাচ্ছাদনের বৃথা চেষ্টা করছিলেন তিনি।
এবার চারজন বি.টি. পরীক্ষার্থীর লেসন-প্ল্যানের খাতা-পত্র, পোস্টার, প্রমাণ সাইজের ম্যাপ, প্র্যাকটিশ-টিচিংয়ের বরাত মিটিয়ে অনেকগুলো টাকা একসঙ্গে পেয়েছিলেন। বউদিকে দিয়েও হাতে ছিল দিলখুশার একটা-দুটো কাটলেট খাওয়ার রেস্ত, কফি হাউজে ফুল কাপ কপি খাওয়ার প্ররোচনা।
পুজো শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাতাসে এখনই রুক্ষ ধূলিকণা। প্রতিটি রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে উৎসবের আমন্ত্রণ।
হাঁপ-ধরা প্রাণটাও ছটফট করছিল যেন!
দরাজ নিমন্ত্রণ ছিল আর্ট কলেজের বন্ধু সালেম ওস্তাগরের।
শিমুলডাঙার লালমাটির প্রান্তরে শাল-মহুয়ার ছায়াঘেরা মাটির বাড়িতে তার স্টুডিও। এই স্টেশনের মাত্র চার-পাঁচটি স্টেশন পরে ঝাড়খণ্ড-লাগোয়া গ্রাম শিমুলডাঙার সালেম ওস্তাগরের সঙ্গে থেকে ছবি-আঁকার নিমন্ত্রণ! আর মধ্য-রাতে দুই বন্ধুর জ্যোৎস্না-মায়ায় মহুয়া-নিষিক্ত উদ্দাম হুলাহুলা নাচ!
কিন্তু কী আশ্চর্য, ট্রেনে ওঠামাত্র তাঁর প্রথমে সুধাময়ের কথাই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল ছেলেবেলার লীলানিকেতন এই গঞ্জটির কথা।
নেমেছেন তো বালকবেলার সেই বিলুপ্তপ্রায় প্রবারণার ছায়াময় নিমন্ত্রণে, কিন্তু এখন এই প্রাক-সন্ধ্যায় সুধাময়কে খুঁজে বের করবেন কীভাবে!
সে-ই-ই তিন বছর আগে কলেজ স্ট্রীটের জংশন থেকে হাওড়ার বাস ধরবার আগে ঠিকানা-লেখা একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছিল সুধাময়। কিন্তু এই তিন বছর পরে কোথায় সেই চিরকুট! গুছিয়ে রাখবে কে? যার সবকিছু,― মায় তাঁর জীবনটাকেও গুছিয়ে রাখার কথা ছিল, সে তো কোনো কথা রাখেনি।
কিন্তু হাওড়া থেকে ছেড়ে অকুস্থলের দিকে যতই ট্রেন এগোচ্ছিল ততই সুধাময়ের কাছে যাওয়ার ইচ্ছাটা বলবতী হচ্ছিল। মনে হয়েছিল―মানুষ অজানা গ্রহে চলে যাচ্ছে, মহাকাশে বসতি স্থাপনের কথা ভাবছে―তো সুধাময়ের ঠিকানা আর কী এমন!
স্টেশন-বাড়ি থেকে বাজারের রাস্তাটুকু পেরোতে পেরোতে তাঁর চোখ মানুষ খুঁজছিল।
(ক্রমশ)