সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৮। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

এইভাবে, না জানা ও অপঠিত ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সঙ্গে উত্তর-উপনিবেশ বর্তমানের সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হলো, জেন নিজের বংশপরম্পরা ও উৎস খুঁজতে শুরু করলেন। খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন, বুঝলেন, এই ইতিহাস শুধু তাঁর পরিবারের বা বংশের নয়, আরো বহু বহু মানুষের, তাঁদের বিচিত্র বিভিন্ন জীবনধারার, পরিপ্রেক্ষিতের, নিসর্গের, অর্থনীতির। এবং তৎসহ, অবশ্যই উপনিবেশের, ক্ষমতার, সাম্রাজ্যের। গ্রাহামস হোম, কালিম্পং এবং নিউজিল্যান্ড নিয়ে লেখাপড়ার কাজ করা যায়, তিনি করবেনও, জেন ঠিক করে ফেললেন। সেই কাজ থেকে দীর্ঘ গবেষণাকর্মের সূচনা, অন্তত দুটি বই, কালিম্পং ও হোমের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযোগ।
বিভিন্ন ভুলে যাওয়া মানুষ ও ভুলে যাওয়া গল্প পড়া ও বলা ছাড়া, তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে জেন যা যা বলবার চেষ্টা করেছেন, তন্মধ্যে অন্যতম, এই গল্পের সবটা কেন, অর্ধেকটাও জানা সম্ভব নয়। হোমের আবদিকদের গল্পে তাঁদের মায়েদের সরব অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে, মিজুতানি সহ অন্য গবেষকরা যা বলেছেন, জেন সে কথারই রেশ টেনে বলছেন:
কালিম্পং-এর ছোটদের পারিবারিক ইতিহাসে তাঁদের মায়েরা নীরব ছায়ামাত্র। উৎস খোঁজার গল্পে মায়েরা আছেন, নিতান্তই না থাকার মধ্য দিয়ে। দলিলদস্তাবেজ নথিপত্রে তাঁদের অনুপস্থিতির নীরবতা একেবারে পুরু ইটের দেওয়ালের মতো, বংশধরদের যাবতীয় চেষ্টা সে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। লিখিত নথিতে উল্লেখ না থাকা, সন্তান সন্ততিদের সঞ্চিত স্মৃতিহীনতা ও তথ্যের অভাব, এই মহিলাদের পাঠিয়ে দিয়েছে যাবতীয় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অ-য়ুরোপীয় মহিলাদের নথিপত্র থেকে চিরতরে বাইরে রাখবার শতাব্দীপ্রাচীন সিদ্ধান্ত থেকে তৈরি হয়েছে আজকের চিরস্থায়ী অনুপস্থিতি, নেই, নেই, নেই। পাশ্চাত্য আমলাতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী তাঁদের যেভাবে অস্তিত্বহীন করে তোলা হয়েছে, ভেবে নেওয়া যায়, পারিবারিক সম্পর্কেও তাঁদের বিশেষ ভূমিকা থাকতো না, নথিপত্রে তাঁরা যতটা নীরব, জীবনেও তাইই।
হোমে ক্রমাগত যাতায়াতের সূত্রে জেন জানতে পারেন, তিনি ছাড়াও আরো অনেকে ইতিমধ্যে পরিবার, বংশ ও উৎসের খোঁজে কালিম্পং এসেছেন, নিজের নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত আবাসিকদের ফাইল দেখেছেন। মোটামুটি ১৯৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে লোকজন হোমে আসতে শুরু করেন, পরবর্তীতে জেনের সঙ্গে তাঁদের অনেকের যোগাযোগও হয়। কালিম্পং-এর সঙ্গে যুক্ত পরিবারদের একে একে নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুঁজে বার করছেন জেন, ইচ্ছে থাকলেও সবার পক্ষে অতদূরে গিয়ে খোঁজখবর করা সম্ভব নয়, তাঁদের হয়েও জেন হোমে যাচ্ছেন, আলাদা আলাদা ফাইল দেখছেন, সে ফাইলের প্রতিলিপি পৌঁছে দিচ্ছেন নিউজিল্যান্ডবাসী পরিবারের কাছে। জেনের গবেষণাকাজে অবিরলভাবে হোমের আবাসিকদের ফাইল ব্যবহৃত হয়েছে। কিভাবে তৈরি হতো ফাইল, কি কি নথি থাকতো সেখানে? কোন দলিল আগে, কোনটা পরে? ফাইলের গঠন ও স্থাপত্য সম্পর্কে জেন যা বলছেন শোনা দরকার:
হোমের ব্যক্তিগত ফাইলগুলো গড়ে উঠত হুবহু একভাবে। মলাটে থাকতো বাচ্চাদের নাম, তাদের ভর্তি নম্বর। মলাটের ঠিক নিচেই ভর্তি ফর্ম, যদিও ভর্তির আগে থেকেই প্রচুর খোঁজখবর চিঠিপত্র চলতো। ফর্মগুলোকে প্রথমে রাখা থেকে বোঝা যায়, ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ কাগজপত্রের গুরুত্ব কতটা ছিলো। ফর্মগুলোয় বলা থাকতো বাচ্চারা কি শর্তে হোমে জায়গা পাচ্ছে, এবং ঠিক কি অবস্থায় তাদের হোমে পাঠানো হচ্ছে। ফর্মে বাচ্চাদের বয়স, ধর্ম, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ে তথ্য দিতে হতো।…বাচ্চাদের বাবামাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে হতো, অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ বাঁধাবাধি ছিলো না। ১৯১২-র আগে, ভর্তি ফর্মে মায়ের নাম দিতে হতো না, শুধু বয়স ও জীবিত না মৃত জানাতে হতো।…বাচ্ছাপিছু কত টাকা দিতে পারা যাবে, জানানো আবশ্যিক ছিলো, পুরো টাকা দিতে না পারলে সেটাও জানাতে হতো।…বাচ্চাদের ভারতের না উপনিবেশের জন্য তৈরি করতে হবে, বলতে হতো।
ভর্তি ফর্মের পরে থাকতো অভিভাবকদের সঙ্গে হোমকর্তাদের(আগের দিকে, মূলত গ্রাহাম, পরে জেমস পার্ডি) বার্তালাপ। লর্নার বাবা ইগারটন পিটার্স আসামের কাছাড় থেকে ১৯০৫ সালে গ্রাহামকে ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘গোপন’ চিঠি দিচ্ছেন, তাতে বলা হচ্ছে, তাঁর দুটি বাচ্চা, প্রথমজন মেয়ে, বয়স সাড়ে তিন, দ্বিতীয়জন ছেলে, আরো ছোট, বয়স মাত্র দেড়। পিটার্স জানতে চাইছিলেন, হোমে ভর্তির পক্ষে এদের বয়সটা খুবই কম হয়ে যাচ্ছে কিনা, এবং, ভর্তির জন্য থোক টাকা একসঙ্গে দিতে হলে তা তাঁর সাধ্যের বাইরে। এই নিয়ে পরের কয়েকটা মাস পিটার্স এবং গ্রাহামের মধ্যে ভর্তির শর্ত নিয়ে চিঠিপত্র চলতে থাকে। পিটার্স স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, যতদিন অবধি না উপনিবেশে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, তাঁর বাচ্চারা হোমের ‘স্থায়ী’ বাসিন্দা হবে। বাচ্চাদের মায়ের বিষয়ে তিনি কয়েক লাইন যা লিখেছিলেন, তার পাঠোদ্ধার করা যায়নি। তাঁর শেষ চিঠিতে পিটার্স লিখছেন, তাঁর বাচ্চাদের প্রতি যেন সহানুভূতিপূর্ণ ও দয়ালু আচরণ করা হয়, বিশেষত যখন ওরা বড় হয়েছে ‘প্রধানত নেটিভদের হাতে, বিন্দুমাত্র ইংরিজি জানে না, এবং ওদের সামলানো বেশ মুশকিলের হবে।’
(ক্রমশ)