সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৯। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

১৯০৯-এ আসামের ডিব্রুগড় থেকে প্ল্যান্টার ফ্রান্সিস হকিন্স তাঁর ১৫ মাসের শিশুপুত্র রিচার্ডকে হোমে পাঠাতে চেয়ে গ্রাহামকে চিঠি দিচ্ছেন। ‘হকিন্স’ ফাইলে গ্রাহামের উত্তরও রাখা, যেখানে গ্রাহাম বলছেন, রিচার্ড তাঁদের সঙ্গে কমপক্ষে ১৫ বছর থাকবে। পিটার্সের মতো, হকিন্সও চাইছেন তাঁর সন্তানের ‘ঔপনিবেশিক’ ভবিষ্যত তৈরি হোক, যদিও হোমের পুরো খরচা মেটানোর সামর্থ্য তাঁরও নেই। প্রাথমিক চিঠিপত্রের কিছু মাস পর, হকিন্স আবার চিঠি দিচ্ছেন গ্রাহামকে। দু বছরের রিচার্ডকে বিশ্বস্ত কারুর মাধ্যমে ডিব্রুগড় পাঠানো হচ্ছে, হোমের প্রতিনিধির হাতে সেখানে তাকে তুলে দেওয়া হবে। কথামতো তাঁর লোক ডিব্রুগড় পৌঁছে বসে আছে, অথচ হোমের কারুর দেখা নেই। বাচ্চাকে বড়জোর আর কয়েকদিন রাখা যেতে পারে, কিন্তু তার পর তাকে বাগিচায় ফেরত পাঠাতে হবেই। এই ঘটনায় হকিন্স ‘বিমূঢ়’, ‘হতাশ’ ও ‘ব্যথিত’, একবার বাচ্চাকে ফেরত নিয়ে গেলে তাকে আর কোনদিনই পাঠানো যাবে না। শেষমেষ হোম থেকে লোক এসে পৌঁছয়, হকিন্সও হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। জেন বলছেন, রিচার্ডের মা-কে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বাচ্চার ওপর তাঁর বা তাঁর পরিবারের লোকজনের যে দাবি ছিলো বা থাকতে পারে, হকিন্সের হাবভাব থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে। হোমের ভর্তি ফর্মে মায়ের নামের পাশে লেখা ছিলো, বাঙালি।
চার
১৯১২ সালে, দার্জিলিং-এর জনৈক ডেনমার্কবাসী প্ল্যান্টার, পল মোলার, গ্রাহামকে লিখছেন, যত শীঘ্রি সম্ভব, তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে ভর্তি নেওয়া হোক। ‘ওদের মা খুবই ঝগড়াঝামেলা করছে, কিন্তু যা করার করতেই হবে,’ মোলার লিখছেন। দার্জিলিং-এ জনৈক ডঃ সিল পরিবারের সঙ্গে দেখা করছেন(সম্ভবত হোমের হয়েই), এবং সুপারিশ করছেন, ছোট ছেলেটিকে(চার বছর) নেওয়া যায়। বাকি দুজনকে নিয়ে আরো ভাববার দরকার, তাঁর অভিমত। হয়তো ডোরা(১৩ বছর)কে নেওয়া যায়, কিন্তু সবচাইতে বড় যে, চার্লস(১৪ বছর), তাকে নেওয়াটা বেশ গন্ডগোলের, সিল জানাচ্ছেন। মোলার অনেক কাকুতিমিনতি করায়, গ্রাহাম অবশেষে রাজি হন, তিনটি বাচ্চাকেই হোমে নেওয়া হয়।
অন্য গবেষকদের কাজে যা ইঙ্গিতমাত্র ছিলো, জেন ম্যাকেবের কাজে তা অবয়ব ধারণ করছে, যে ‘নেটিভ’ মায়েরা বা মহিলারা এতদিন হোমের যাবতীয়( শারীরিক এবং চিন্তায়, উভয়ত) চৌহদ্দি থেকে বিচ্ছিন্ন, অনুপস্থিত এবং কার্যত অস্তিত্বহীন ছিলেন, তাঁরা কালিম্পং এবং হোমের শ্বেতশুভ্র হিম পরিসরে ক্রমে ঢুকে আসছেন। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, চা বাগিচা এলাকায় কিম্বা কলকাতার দরিদ্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অঞ্চলে নেটিভ মেয়েদের সঙ্গে সাদা সায়েবদের অবৈধ সহবাসের ফলে যে অশ্বেত পাপ-পরিসর তৈরি হচ্ছে, হোমের শিশু কিশোর আবাসিকরা আসছে সেই পরিসর থেকে, সত্যি কথা বলতে কি, তাদের পাপমুক্ত ও সাম্রাজ্য-উপযোগী সাদা করে তোলার জন্যই হোম জন্মাচ্ছে, যেন নেটিভ-কণ্টকিত দিশি পরিসর ও নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া কানাডা আদি উপনিবেশ যথা স্বর্গের মাঝখানে গ্রাহামসায়েবের হোম এক পবিত্র পুর্গাতেরিও, কঠিন পরিশ্রম ও অনুশাসনের যুগপৎ তাড়নায় রক্ত ও পারিপার্শ্বিকের সঞ্চিত নেটিভ পাপ যেখানে ধুয়ে যায়। তবে এসব পুরোনো, শতাব্দী-প্রাচীন ভাবনা, আজকের হোম বহিরঙ্গে না হোক, ভিতর থেকে বদলে গেছে অনেকটাই। ভারতবর্ষের মতো উত্তর ঔপনিবেশিক দেশে, উপনিবেশ বা উপনিবেশ-ভাবনা কিছুই আর অবিকল আগেকার চেহারায় থাকতে পারে না, হোমের অবিকৃত নিসর্গের মধ্যেও না। না পারুক, সাম্রাজ্যের বিবিধ ও অজস্র পাপ প্রতিদিন খুঁজে ও খুঁড়ে বার করছেন যে গবেষকরা, তাঁদের কাজ এখনো কঠিন, দুরুহ ও কখনো কখনো দুঃসাধ্য। খোদ ব্রিটেনের কথাই ধরুন। আসল ঐতিহাসিক উপনিবেশ সব ফৌত, মরা কলোনিতে সায়েবসময়ের পচা আশ, এমনকি সাদাদের নিজেদের রাজত্বে নেটিভদের গিজগিজে ভিড়। তাতে কি? আমরা আগেই যেমন বলেছি, সাম্রাজ্য আসলে একটা ভাবনা, জীবনদর্শন, এমনকি ধর্ম। তাকে গাল দেওয়া যায় না, দেওয়া পাপ, মহাপাপ, বিশেষত যদি সেই গাল বদরক্ত নেটিভবাচ্চাদের কাছ থেকে আসে। বিশদ আলাপের সুযোগ নেই, শুধু একেবারে হাল আমলের একটি উদাহরণ দি। ভারতীয় -ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও গবেষক সাথনাম সংঘেরা গত বছর তিনেকের মধ্যে দুটি বই লিখেছেন, এমপায়ারল্যান্ড: হাও ইম্পিরিয়ালিজম হ্যাজ শেপড মডার্ন ব্রিটেন ( বা, সাম্রাজ্যদেশ: সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে আধুনিক ব্রিটেনের নির্মাণ করে), নামে প্রথমটি প্রকাশিত হচ্ছে ২০২১ সালে, পেঙ্গুইন থেকে। পরেরটি,এমপায়ারল্যান্ড: হাও ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজম হ্যাজ শেপড দি গ্লোব( বা সাম্রাজ্যদেশ: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে পৃথিবী নির্মাণ করে), বেরুচ্ছে ২০২৪ সালে, ভাইকিং প্রকাশনী থেকে। প্রথম বইটি জনপ্রিয় হয়। পন্ডিতি নয়, গল্পের মতো লেখা, দুটি বইতেই সায়েবসময়ের নানান কীর্তির(দাসব্যবসা, অত্যাচার, মারদাঙ্গাখুন, জবরদখল, লুঠ, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি) বৃত্তান্ত সপ্রমাণ সবিস্তারে কথিত। সায়েবদের গাল ইদানীং বিস্তর লোক দেয়, যাদের মধ্যে বেশিরভাগটাই সম্ভবত সায়েব। যেমন উইলিয়ম ড্যালরিম্পল সায়েব দীর্ঘদিন ধরে ভারতে, একের পর এক বইতে ব্রিটিশ রাজ ও ভারতে তাদের নানান কর্মকান্ডের ইতিবৃত্ত পেশ করছেন। তাঁকে, অর্থাৎ সাহেবকে সায়েবলোকে গাল দেয় না। এক্ষেত্রে লেখক নেহায়েত দিশি, ফলে এম্পায়ারল্যান্ড বেরুনো ইস্তক ব্রিটিশ সাদারা( বা সাদা ভাবনার অ-সাদারা) তাঁকে যা নয় তাই বলে গাল দিচ্ছে, সাদা বাংলায়, ট্রোল করছে।
সায়েবশাসনের চুলচেরা বিশ্লেষণ কিম্বা সাহেবদের গাল পাড়া জেন ম্যাকেবের উদ্দেশ্য নয়, তাঁর লেখা পড়ে এমন মনে হলো। চা বাগিচা এলাকার সব প্ল্যান্টার অত্যাচারি, নেটিভতাড়ক ও বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন না, এবং বহু ক্ষেত্রেই উপনিবেশ যাত্রার ফল হোমের কিশোর বা তরুণ আবাসিকদের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক(সর্বদা সুখের না হোক) হয়েছে, বহু ব্যক্তিগত ইতিহাস তুলে দিয়ে সে তথ্যনিষ্ঠ বয়ান জেন রচনা করেছেন। তা সত্বেও, তিনি লিখছেন হোম নিয়ে, এবং, যেমন আমরা দেখছি, হোম থেকে সাম্রাজ্য বা উপনিবেশকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। ফলে, তাঁর লেখাতে বারবার ফিরে আসছে সায়েবসাম্রাজ্যের উৎসে থাকা বর্ণবিদ্বেষ ও শ্বেতপ্রাধান্য (যাকে আজকাল হোয়াইট সুপ্রিমেসি বলা হয় আরকি)। বারবার জেন বুঝতে চাইছেন, হোমের গল্পে না থাকা, অস্তিত্বহীন মায়েরা কোথায় গেলেন, তাঁদের ছেড়ে তাঁদের বাচ্চারা আসলে কেমন ছিলো, হোমনির্বাসনে না পাঠিয়ে তাঁদের নিজের মা কিম্বা মায়ের পরিবারের সঙ্গে রাখলে কি দাঁড়াতো ব্যাপারটা?
(ক্রমশ)