অকূলের কাল। পর্ব ২। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ভবেনের অস্ত্রশস্ত্র
এক মাসের মধ্যেই হস্টেলের সব সিট ভরে গেল। বেশির ভাগই জয়পুরিয়া কলেজের ফিজিকস, জনা দুয়েক কেমিস্ট্রি। ১৯ নম্বরে ক্ষিতি-দিনুর সঙ্গে শচি আর প্রদীপ। শচির বাড়ি বর্ধমানের কাটোয়া লাইনের এক গাঁয়ে। প্রদীপ এসেছে দুর্গাপুর থেকে। ১৮ নম্বরে অনুপম। তার বাড়ি নদীয়া-মুর্শিদাবাদের সীমানার এক গঞ্জে। উত্তর দিকে সিঁড়ির পাশের ছোট ঘরে মলয়, আসাম থেকে এসে জয়পুরিয়ায় ফিজিকস নিয়ে ভর্তি হয়েছে। কলেজ শুরু হওয়ার বেশ কয়েক মাস পরে এল অভীক আর মনোজিতদা। অভীকের বাড়ি আসানসোল, সে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ছিল, মহারাজদের সঙ্গে কীসব গণ্ডগোল পাকিয়ে চলে এসেছে। সেও ফিজিক্স, জয়পুরিয়া কলেজেই। মনোজিতদা শিলচর থেকে এসেছে, ক্ষিতিদের থেকে বছর তিনেকের সিনিয়ার, সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। কস্ট অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে কলকাতায় আসা। যে কজনের কথা বলা হলো তাদের সঙ্গেই ক্ষিতির মেলামেশা ক্রমশ সম এবং বিষম চারিত্রিক রসায়নে ঘনিষ্ঠতায় গাঢ় হবে এবং প্রথম বছর বাদ দিলে হস্টেলবাসের বাকি সময়টা তারাই হস্টেল শাসন করবে। মলয় এবং মনোজিতদার সঙ্গে দলের বাকি কজনের হৃদ্যতায় কোনো খাদ না থাকলেও তারা অবশ্য দলের নানাবিধ যৌথকাণ্ড থেকে একটু আলগা হয়ে থাকাটাই পছন্দ করে। ১৮ নম্বরে অনুপমের সঙ্গে অভীক ছাড়া ছিল পলাশীর প্রশান্ত আর বাংলাদেশ থেকে আসা দুলাল সাহা। প্রশান্ত, দুলাল দুজনেই কমার্স, দুজনেই বেশ বড়লোকের ছেলে। তাদের পোশাক-আসাক, হাতখরচের বহর দেখে সহজেই বোঝা গেল সেটা। তারা তিনতলার অভীক-অনুপম-দিনু-শচি-প্রদীপ-ক্ষিতির ব্র্যাকেটে চেষ্টা করেও জায়গা পেল না। বড়লোক হওয়ার কারণে নয়, তাদের আত্মকেন্দ্রিক আচরণের জন্য। আর এই কারণেই তারা র্যাগিং-এর সহজ লক্ষ্য হয়ে উঠল। খুবই হালকা ধরনের র্যাগিং। দুলালের বাঙ্গাল উচ্চারণ নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি, শান্তর ক্রিম মাখা নিয়ে হাসাহাসি। তাতে রাগ না করে দুজনেই হাসি-তামাশায় যোগ দেওয়ার কৌশল নিতে অচিরেই র্যাগিং-এর মজা মাঠে মারা গেল।
তিনতলার ব্র্যাকেটটি গড়ে উঠতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েক মাস। স্কুলের নিচু ক্লাস থেকেই ভারী ভারী সব উপন্যাস পড়ে ক্ষিতির ধারণা হয়েছিল সে নিজে খুবই জ্ঞানসমৃদ্ধ তরুণ এবং চারপাশে যেসব ছেলেদের দেখে তারা হয় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কিছু পড়ে না, বা পড়লেও সেসব নেহাতই রদ্দি, হালকা ধরনের অবাস্তব প্রেমকাহিনি বা ডিটেকটিভ গল্প। যেমন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বা নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা বই। নিজের সাহিত্য-চেতনা এবং দার্শনিক অনুভবের কারণে তার একটু নাক-উঁচু ভাব বাসা বেঁধেছে মনে। বই-পড়া বিদ্যা সম্বল করে সে-সময়ে যেসব কাঁচা, অপরিণত লেখা সে লিখছে, সেগুলোকেও উঁচু দরের মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগেই বুদ্ধদেব গুহের ‘দূরের দুপুর’ নামে একটা ছোট উপন্যাস পড়ে মজে আছে সে। দিনুকে জিজ্ঞেস করল, তোমার প্রিয় লেখক কে? দিনু বলল, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সেই সবে এক শারদ পত্রিকায় ‘ঘুণপোকা’ বেরিয়েছে। একেবারে নতুন ধরনের লেখা। শুনে দিনুর প্রতি শ্রদ্ধা জাগল মনে। তারপর থেকে নিজের মনের কথা উজাড় করে দিনুকে শোনাতে শুরু করল। সেসব শুনেই সম্ভবত, দিনুই প্রথম ক্ষিতিকে কাকু বলে ডাকতে শুরু করে। সেই ডাক ক্রমশ সংক্রামিত হয় শচি, প্রদীপ আর অনুপমের গলায়। সব শেষে অভীক, তাও অনেক ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে। শেষ পর্যন্ত কাকুকে কেন্দ্রে রেখেই ব্র্যাকেট সম্পূর্ণ হয়।
ক্ষিতি ততদিনে জেনে গেছে তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যে থাকা বন্ধুরা সহজেই তার অনুরাগী হয়ে ওঠে; যদিও তার কারণ সে ভেবে দেখেনি। তার বাইরে থাকা ছেলেদের আকৃষ্ট করার যোগ্যতা তার নেই। ফলে একতলা আর দোতলার ছেলেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক মুখ-চেনাচিনিতেই আটকে রইল। ব্র্যাকেটের সূচনা হয় দিনু থেকে। কিন্তু দিনুর পর ব্র্যাকেটে না-আসা মলয়ই প্রথম তার কাছাকাছি এল। মলয় শহুরে ছেলে, কিন্তু খুবই মুখচোরা। ফরসা, লম্বা, খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট – রীতিমতো সুদর্শন। ফিজিক্সের মেধাবী ছাত্র। পরবর্তী কালে সে পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নম্বর পাবে। যে সর্বোচ্চ পাবে, সে প্রেসিডেন্সির, ছোটখাটো ফরসা চেহারা, থাকে তাদেরই হস্টেলের দোতলায়। তার সঙ্গে ক্ষিতির তেমন করে কথাবার্তা হয়নি কখনও। ক্রমশ বুঝবে ক্ষিতি, মলয় এবং সেই ছেলেটির মধ্যে একটা বুনিয়াদি পার্থক্য আছে। মলয় পড়ুয়া হিসাবে সর্বভুক, যখন যে-বিষয় ধরে সে-বিষয়ে একটা পোক্ত ধারণা আয়ত্ত করার আগে ক্ষান্তি দেয় না, আর প্রেসিডেন্সির ছেলেটি পদার্থ বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই পড়ে না।
গড়বেতা কলেজের নষ্ট বছরে একটা উপন্যাস শুরু করেছিল ক্ষিতি। কলেজে ভর্তি হয়ে তার প্রধান কাজ দাঁড়াল সেই উপন্যাসটা শেষ করা এবং তার পাঠক জোগাড় করা। উপন্যাসের নাম দিয়েছে ‘ভবেনের অস্ত্রশস্ত্র’। ভবেন শৈশবেই মাতৃহীন। বাবা তার প্রতি অকারণেই নির্দয় ও নিষ্ঠুর। সামান্য বেয়াদবি দেখলেই তিনি ভবেনের উপর বেত নিয়ে চড়াও হন, চামড়া ফেটে রক্ত না বেরনো পর্যন্ত থামেন না। একদিন কিশোর ভবেন বাবার হাত থেকে বেত কেড়ে নিল। আর তখনই সে বাবার চোখে আবিষ্কার করল ভয়। সেই থেকেই জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার মন্ত্রটির সন্ধান মিলে গেল যেন। রোগা, লম্বা, কালো, শ্রীহীন ভবেন তখন থেকেই একটা ছোরা দেখিয়ে তার কলেজ এবং মফস্সল শহর কাঁপিয়ে বেড়াতে লাগল। কয়েকটি অনুগত ছেলে নিয়ে তার একটি দলও পাকিয়ে উঠেছে। রূপে, মেধায় মনোহরণকারী, কলেজের যে-ছাত্রীটির প্রতি তার গোপন অনুরাগ, সে আবার তাদেরই কলেজের অন্য এক ছাত্র, এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেকে ভালোবাসে। একদিন ভিন্ন কারণে সেই ছেলেটির সঙ্গে ভবেনের মারামারি হয়। ভবেন তাকে মাটিতে ফেলে বুকে ছোরা বিঁধিয়ে দিতে উদ্যত হয়েও সেই মেয়েটির সকাতর চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে তার মনে এক ধরনের বৈরাগ্যের উদয় হয়। সে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে। শহরতলির এক কারখানায় শ্রমিকের কাজ জোগাড় করে একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে।
এই পর্যন্ত আসতে সেলাই করা দু-দিস্তা ফুলস্কেপ কাগজের দুটো খাতা শেষ হয়েছে। কিন্তু নিজে কলকাতা দেখার আগেই ভবেনকে কলকাতায় এনে ফেলে একটু ফ্যাসাদে পড়েছিল সে। সমরেশ বসুর উপন্যাসের ভরসায় ভবেনকে শহরতলির বস্তিতে এনে তুলেছিল। কিন্তু লিখতে গিয়ে বই-পড়া বিদ্যা খুব একটা কাজে দিচ্ছিল না বলে একজন ভবঘুরে দার্শনিক কথাবার্তা বলা পাগলের চরিত্র আমদানি করে তাকে ভবেনের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে কিছুটা এগোয়। ক্ষিতির ধারণা, সে যে খুব সাদামাঠা লেখক নয়, উচ্চ চিন্তাও তার আয়ত্তে, এই পাগলের চরিত্র থেকেই পাঠক তা টের পাবে। এই হস্টেলে উঠে উপন্যাসকে মূল পথে ফিরিয়ে আনার একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে গেল ক্ষিতি। তাদের উনিশ আর আঠারো নম্বর রুমের দক্ষিণ দিকের বারান্দার পিছনের জায়গায় একটা গাড়ি সারাইয়ের গ্যারেজ। সেই গ্যারেজ সংলগ্ন সাত-আটটা টালির চালের ঘরে প্রত্যেকটায় এক একটা পরিবারের বাস। ক্ষিতি ধরে নিল, গ্যারেজটা ভবেনের কারখানা আর ওই টালির চালের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সে থাকে। এরপর থেকেই তার উপন্যাস তরতর করে এগোচ্ছে। তবে ঘটনা যেদিকে মোড় নিয়েছে, ‘ভবেনের অস্ত্রশস্ত্র’ নামটা চলবে কি-না, সন্দেহ হচ্ছে।
(ক্রমশ)