অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১। অনন্ত জানা

ছেলেবেলার স্টেশনে এক উদাসীন বিকেল
সেটা বিগত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়। রাঢ় বাংলার একটা মাঝারি মাপের স্টেশনে আরও একগাদা মানুষের সঙ্গে কাঁচা-পাকা চুলওয়ালা একজন মানুষকে নামিয়ে দিয়ে দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনের ভারি ভারি চব্বিশ বগির প্রলম্বিত সর্পিল গা টেনে টেনে চলে গেল উত্তরবঙ্গের দিকে।
আপাতদৃষ্টিতে মানুষটির কোনো বৈশিষ্ট্য নেই—রোগাশোকা, মধ্য-বয়সী, গড় বাঙালির মতোই লম্বত্ব, গাত্রবর্ণ ঈষৎ বাদামি, সাধারণ প্যান্ট। প্যান্টের সঙ্গে হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরনে—কাঁধ থেকে ঝুলছে সুপরিচিত নিত্যযাত্রীদের মতো একটা কালোরঙের সস্তার ছোটো কিট-ব্যাগ। তবু কেন যেন ভদ্রলোককে এখানকার স্থানীয় মানুষ বলে মনে হয় না। মুখে-চোখে, শরীরী ভাষায় কোথায় যেন গাঙ্গেয়-কোমলতা। ভদ্রলোকের চোখে ছিল কিছুটা অপরিচিতের উদ্্ভ্রান্তি।
বর্ধমান পেরোবার পর এদিককার অনেক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মই একটু নিচু, কিন্তু তুলনায় চওড়া এবং এই অঞ্চলের জনবিরল বসতিগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা চাষের মাঠগুলোর মতোই একটু হা-হা, ফাঁকাটে। প্ল্যাটফর্মের ওপর দোকানপাট নেই বললেই চলে।
যে জনতা ট্রেন থেকে নেমেছিল তারা দ্রুত-পায়ে নিষ্ক্রান্ত হওয়ায় প্ল্যাটফর্মটি অচিরেই জনশূন্যতার নৈঃশব্দে আক্রান্ত হলো। ভদ্রলোক একটু দাঁড়লেন, চারপাশটা একবার দেখে নিলেন। নাহ্, কোনো রেল-কর্মচারিরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এই স্টেশনটির এমন চরিত্রের সঙ্গে তিনি অপরিচিত নন। তিনি জানেন যে, এখানে যত মানুষ ট্রেন থেকে নামে তাদের মধ্যে নব্বই শতাংশই এখানকার বাসিন্দা নন। তাঁরা যাবেন জেলা সদর বা সেখান থেকে বাস ধরে তার আশপাশে কোথাও। কিন্তু জেলা সদরে ট্রেন-যোগাযোগ না-থাকায় এখানে নেমে স্টেশনের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি. ট্রেকার বা অন্য কোনো ভাড়ার গাড়িতে বা রাজ্য সড়কে গিয়ে বাস ধরে মহকুমা-সদরে বা জেলা-সদরে যেতে হয়। তাই ট্রেন থেকে নেমে সকলেরই তাড়া থাকে। নিত্যযাত্রীদের অনেকে কয়েকজন মিলে মাসিক বন্দোবস্তে স্থায়ী ভাড়া গাড়িতে সদর থেকে যাতায়াত করে থাকেন।
স্টেশনের এই চরিত্র মানুষটির কাছে যথেষ্ট পরিচিত। কিন্তু সেই পরিচয়ের নাগাল পেতে আরও অন্তত দুটি দশক পেছিয়ে যেতে হবে।
এই আধা-গঞ্জেই বাবার চাকরি-সূত্রে থাকতেন তাঁরা—সেই কৈশোরে—সে যেন পুরাকালের কথা। এখানকার নতুন হওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পোস্টিং ছিলেন বাবা। বড়ো বড়ো শাল গাছের আলোছায়ার সদ্য-হওয়া হেল্থসেন্টারের হলুদ রঙের নতুন বাড়ি—পাঁচ-ছয়টি ঘর নিয়ে একতলা ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পূর্বোত্তরে দু-কামরার আধা পাঁচিল-ঘেরা ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার—সেটার বহিরঙ্গের রঙও এলামাটির হলুদের মতো। অদূরে পলাশের নিমন্ত্রণ-ঘেরা রাজ্য সড়ক চলে গেছে বাঁ-দিকে মহকুমা শহর থেকে একেবারে সদর শহরের দিকে। এ-দুয়ের মাঝখানে সুবিস্তৃত হাইফেনের মতো ছিল এই গঞ্জটি।
সে এমন এক ছায়াচ্ছন্ন, মায়ানিষিক্ত উতলা সময়!
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল মানুষটির।
প্রথমে টিকিট-কাউন্টারের সামনের চায়ের স্টলটির সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।
এই দুই দশকে তেমন-কোনো পরিবর্তন হয়নি স্টলটির। রেলের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভেণ্ডারের স্টল। পাকাচুলো যে লোকটি সেই সুদূরের দিনে একটা বড়ো অ্যালুমিনিয়মের মগে যেভাবে ফুটন্ত দুধ-জলের মধ্যে হাতার সাইজের চামচ দিয়ে চিনিসহ চা ঘুঁটতেন, আজও তেমনই ঘুঁটছিলেন। এ কী এস. ওয়াজেদ আলির সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলা ‘ভারতবর্ষ’ নাকি! নাকি টাইম মেশিনের ইন্দ্রজালে তিন দশক পেরিয়ে পৌঁছে গেছেন ছোটোবেলায়। সেদিনের মতো ভাঙা বিস্কুটের জন্য হাত পাতবেন নাকি মানুষটার কাছে!
তিনি বুঝলেন―এই মানুষটি আসলে তাঁর ছোটোবেলায় দেখা সেই মানুষটির সেদিনের যুবকপুত্র, যিনি সেদিন বাবার নির্দেশনায় মাঝে মাঝে চা ঘুঁটবার ট্রেনিং নিতেন!
ইতিকর্তব্য নির্ধারণ করার জন্য, ভাববার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন।
তিনি এক ভাঁড় চা নিলেন। মাথা তুলে স্টলের ভিতরের দেওয়াল আর সামনের সীমানার দিকে তাকালেন।
আশ্চর্য! সেদিনের মজার বিজ্ঞাপনী বোর্ডগুলো আজও তেমনভাবেই সার দিয়ে লাগানো, তেমনই ঝকঝকে উজ্জ্বল, তেমনভাবেই লেখা―‘যাহাতে নাহিক মাদকতা দোষ / কিন্তু পানে করে চিত্তপরিতোষ।’ সঙ্গে একটি টি-পট থেকে কাপে ধূমায়িত চা ঢালার দৃশ্য। পাশের বোর্ডে আবার এই বয়ানের সঙ্গে একজন গৃহবধূর হাতে প্লেটসহ ধূমায়িত চা—অতিথিকে পরিবেশন করতে যাওয়ার ভঙ্গিতে বধূটি গমনরত ; পরের বোর্ডে―‘চা পানের উপকারিতা ইহা খাইতে বেশ সুস্বাদু, ইহাতে কোনো অপকার হয় না, ইহা জীবনীশক্তির উদ্দীপক, ইহাতে মাদকতা শক্তি নাই।’ তার নিচে লেখা―‘ইহা নিম্নলিখিত রোগের আক্রমণ হইতে রক্ষা করে—ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, প্লেগ, অবসাদ।’ তার সঙ্গে লেখা চা প্রস্তুত কার্যে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী অন্ন করিয়া খাইতেছে, জল ব্যতীত যাবতীয় পানীয়ের মধ্যে ইহা সর্বাপেক্ষা সুলভ।’ সঙ্গে একটি টি-পটের ছবি। তার পরের বোর্ডে ফেজ টুপি-পরা একজন অভিজাত মুসলমান ভদ্রলোকের ছবি, তিনি কাপ হাতে চা পান করছেন, এখানে আবার চা-কে ডাল-রুটির মতো নিত্যদিনের খাবার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পাশের বোর্ডটির কনটেন্ট আরও মজার, তাতে লেখা―‘গরম চা পান কর। লাভ হইবে / শীত ও বর্ষার ব্যাধি দূর হইবে / ইহাই একমাত্র গ্রীষ্মের শীতল পানীয়।’ সবার শেষে রীতিমতো ছবি দিয়ে ‘চা প্রস্তুত করিবার প্রণালী’ প্রদর্শন করা হয়েছে। বোর্ড-এর সারির মাঝামাঝি একটি ঈষৎ বড়োমাপের বোর্ডে চা-বাগানের প্রভূষিত সবুজের আত্ততার রাজ্যে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি আহরণরত পিঠে-ঝুড়ি কামিনদের কাল্পনিক ছবি। যখন ব্রিটিশ শাসকেরা এদেশে চা-এর ব্যবসা প্রচলন করবার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল, এসব তখনকার বিজ্ঞাপনী বোর্ড। এই সব বিজ্ঞাপনের শক্তিতে ইউরোপীয় বণিকেরা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্বের চা-পান বিরোধী সর্বাত্মক প্রচারণাকেও হেলায় পরাজিত করেছিল!
বোর্ডগুলো দেখতে দেখতে মানুষটির মধ্যে পুরোনো শৈশব জেগে উঠলো, তিনি দেখলেন এতকাল পরেও বোর্ডের লেখাগুলো বেশ জ্যান্ত আছে। কোথাও কোথাও নতুনের মতো চকচক করছে। তিনি যতদূর দেখেছেন, চা পানের উপকারিতা-সংক্রান্ত এমন বোর্ড পুরোনো স্টেশনগুলোয়—যেমন দমদম, নৈহাটি, ব্যাণ্ডেল, কৃষ্ণনগর ইত্যাদিতে কিছুকাল আগে পর্যন্ত দিব্যি শোভা পেতো। সম্ভবত পুরোনো ভেণ্ডিং রেলওয়ে স্টলগুলোতে এখনও সেগুলো টিকে আছে।
বোর্ডগুলোর দীর্ঘজীবিতার রহস্য এই যে, এগুলি এনামেল কাস্টিং-এর বোর্ড। কোনো এককালে পিতল বা তামার মতো মিশ্র ধাতুর ওপর ধাতুর টিনের আস্তরণ দেওয়া হতো আর বাসন তৈরি করলে তার ওপর পোর্সেলিন জাতীয় প্রলেপ।
মানুষটির গতিক্ষম-চৈতন্যে শিল্প-ইতিহাসের এই পূর্বাপর ছাত্রটি, নিজের নিরস্তিত্ব ছায়ার দুর্জ্ঞেয়তা এবং পটারি শিল্পের ইতিহাস অধ্যয়নের সন্ধানী কুহেলিকায় আক্রান্ত হলেন।
এই প্রলেপ বা এনামেলের সফলতার জন্য ফ্রান্সের মানুষ, শখের শিল্পী বার্নার্ড প্যালিসিকে (১৫০৯/১০-১৫৮৯) কী কাণ্ডটাই না করতে হয়েছিল!
প্যালিসি পেশায় ছিলেন জরিপকারী আর নেশায় শিল্পী। একদা জরিপের কাজে গিয়ে মাটির ওপর এনামেল করা একটি কাপ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে সেই রকম কাপ তৈরির চেষ্টায় প্রভূত শ্রমসাধ্য নিরীক্ষায় ব্রতী হয়েছিলেন। এটি ফ্রান্সের বাইরের কোনো দেশে তৈরি বলে প্যালিসি অনুমান করেছিলেন। কেননা প্রাচ্যে চিন এবং প্রতীচ্যে ইতালি ছাড়া অন্যত্র এই পালিশ-এনামেলের কাজের রহস্য অজ্ঞাত ছিল।
জানা যায় যে, প্যালিসি মাটির পাত্র তৈরি করে তার ওপরে পালিশ বা এনামেল ধরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। সেখানে একটিমাত্র পেয়ালায় পালিশ ধরেছিল। তখন তিনি নিজের বাড়িতেই চুল্লি তৈরি করে সেখানে পালিশের উপাদান হিসেবে মাটি আর পাথরের গুঁড়ো গলিয়ে চললেন। সেই সঙ্গে ঠিক কী কী উপাদান গলালে, কী করলে অমন চকচকে পালিশ উঠবে তা বুঝবার জন্য ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজও চলছিল। দু-বছর চুল্লি নিয়ে পরিশ্রমের পর প্রলেপ বা পালিশের মশলার খোঁজ পেলেন তিনি। এজন্য প্রথমে অন্যের চুল্লি ব্যবহার করে একটিমাত্র কাপে পালিশ ধরাতে সক্ষম হলেন তিনি। প্যালিসির ধারণা হলো যে, চুল্লির ত্রুটিতেই এটা ঘটেছে। তখন নিজের বাড়িতেই বড়ো একটি চুল্লি নির্মাণ করে কাঠের ইন্ধনের সাহায্যে কাপগুলিতে পালিশের কাজ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। জ্বালানির কাঠ ফুরিয়ে যাওয়ায় বাড়ির আসবাবপত্র ভেঙে গুঁজে দিতে থাকলেন চুল্লিতে। শেষপর্যন্ত মশলা গলল এবং চমৎকার সাদা পালিশে পেয়ালাগুলি ঔজ্জ্বল্য লাভ করল।
কিন্তু এরপরেও এই কাজে নানাবিধ বিচিত্র সমস্যা ও ত্রুটি দেখা দিতে লাগল। পনেরো-ষোলো বছর পর বার্নার্ড প্যালিসি নিজেকে একজন কুম্ভকার হিসেবে পরিচয় দেওয়ার সাহস করলেন; কিন্তু তিনি এখনও নিজের শিল্পে উন্নতির জন্য পরিশ্রম করেছিলেন, এবং তাঁর উপার্জনের একটি বড়ো অংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং শ্রমে ব্যয় করেছিলেন। প্যালিসি এ-সংক্রান্ত িনরীক্ষার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেিছলেন যা তখনও পর্যন্ত ফ্রান্সে অনার্জিত ছিল। কখনও রঙ গলে গেল, কখনও একটার রঙ আরেকটার গায়ে লেগে গেল―কখনও বার বার চুল্লি ফেটে কাজ পণ্ড হলো। এই সমস্ত ত্রুটির কারণে প্যালিসির এত পরিশ্রম এবং বিরক্তি তৈরি হয়েছিল যে, তাঁর মনে হয়েছিল―তিনি যেন তাঁর জীবনের উপান্তে পৌঁছে গেছেন! ( হেনরি মর্লে : ১৮৫২) পনেরো-ষোলো বছর একটানা স্ব-শিক্ষানবিশীর পর প্যালিসি এই কাজে অনেকটা সফল হলেন। পরবর্তী সময়ে অঙ্কিত বন্যপ্রাণী, সরীসৃপ, উদ্ভিদ ও প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণময় সজীবতা পাত্রগুলিতে এনামেল প্রলেপের অলঙ্করণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, প্যালিসির ‘সমৃদ্ধ কল্পনা’য় সেগুলি বিস্তৃত মণ্ডনকলায় নন্দিত হয়েছিল।
(ক্রমশ)