খড়কুটোর জীবন : হরেকরকম পাগল দিয়া । পর্ব ৫ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
আজকাল একটা গান লোকের মুখে মুখে , কানে কানে ঘুরছে। না, ‘টুম্পা সোনা’ না। এ গানটা হলো –
‘বাবা হরেক রকম পাগল দিয়া মিলাইছে মেলা
বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা।’
আমার দুনিয়াদারির দরবারে কত পাগলকেই না দেখলাম। যারা এই মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে রবি ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মেহের আলীর মতো আমাকে বলে ‘সব ঝুট হ্যায়, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও।’ কিন্তু ক্ষ্যাপা আমি খুঁজে ফিরি পরশ পাথর।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ ,মোহ, মাৎসর্য আমাদের পাগল করে রেখেছে। তবিলদারি বা চিনির লোভে বেড়েই চলে সে পাগলামি। দুনিয়াতে যত রকম মানুষ আছে তত রকম পাগল। কেউ ভবের পাগল, কেউ বা ভাবের পাগল। কেউ টাকা-পাগল, দেশ-পাগল, ধর্ম-পাগল, জ্ঞান-পাগল, কর্ম-পাগল বা নির্বাণ পাগল। ‘বাতুল’ শব্দ থেকে এসেছে ‘বাউল’ শব্দটি যার অর্থ ‘পাগল’। তবে তারা ঈশ্বর বা মনের মানুষ বা আলেক সাঁই – এর জন্য পাগল। পাগলা ঠাকুর রামকৃষ্ণ সবাইকে ঈশ্বরের জন্য পাগল হতে বলেছেন। অথচ আমরা কেউ স্বীকার করি না যে আমরা পাগল। সে যাই হোক পাগল কখনো স্বীকার করে না যে সে পাগল। তবু সমাজে যারা তথাকথিত পাগল আজ সেই রকম কয়েকজন পাগলের নমুনা দাখিল করবো আপনাদের দরবারে।
গ্রীষ্মের দুপুর। ছেনচের ছায়ায় কুকুর হাঁপাচ্ছে আর তার জিভ থেকে লালা ঝরছে। হাঁস গুলো পুকুর পাড়ের নিমগাছের ছায়ায় ডানার মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে ঘুমাচ্ছে। মার কাছে বসে আছি মাটির দাওয়ায়। দূরে রাস্তা শূন্য। হঠাৎ মা একটা লোককে দেখিয়ে বললো – ‘ঐ দেখ, প্রদীপ পাগলা আসছে।’ লুঙ্গি আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরিহিত উস্কো-খুস্কো চুল আর শুকিয়ে যাওয়া কাদা মাখা লোকটি তো আমার চেনা। পাগল হতে যাবে কেন। মাকে বললাম -‘ওটা তো মেজ কাকা। আর কাকার নাম তো প্রদীপ নয়।’ ‘মা বললো – ‘দেখ, প্রদীপ পাগলার মতো দেখতে লাগছে।’ আমি প্রদীপ পাগলাকে চোখে দেখিনি কিন্তু তার অনেক গল্প শুনেছি। পাগলা কোথা থেকে যে আমাদের গ্রামে এসেছিলো তা কেউ বলতে পারেনা। তবে তার হাবভাব কথাবার্তায় নগর জীবনের ছাপ ছিলো। গভীর রাতে নাকি সে থেকে থেকে চীৎকার করে উঠতো – ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ। দুনিয়ার মজদুর এক হও। সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।’ গ্রামের বারোয়ারী ঘরে তার আস্তানা ছিলো। খিদে পেলেই যে কারোর বাড়ি ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো। যতক্ষণ কিছু না কিছু খাবার পাবে ততক্ষণ সেখান থেকে তাকে সরায় কে। আর বাচ্চাদের কাছে পেলেই কোলে নিতে চাইতো। কিন্তু বাচ্চারা ভয়ে কেউ তার কাছে যেতোনা। পাগলকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করলে সে কাউকে গালি দিতো না বা মারতে যেতো না শুধু শ্লোগান দেওয়ার ভঙ্গীতে ডান হাতটা বারবার আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিতো।
প্রদীপ পাগলার গল্প এখন মনে এলে ভাবি লোকটার হাতে বোধহয় একদিন হালাল ঝাণ্ডা ছিলো, লোকটা হয়তো বলেছিল ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’ বা ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ । গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরতে না পারার যন্ত্রণাতে বোধহয় সে পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমাদের গ্রামেই পাগলের মৃত্যু হয়। সারারাত কালবৈশাখী ঝড়ের শেষে সকাল বেলা লোকে দেখে বারোয়ারীর চালা ঘরটা চাপা পড়া থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো মরে আছে প্রদীপ পাগলা। গ্রামের লোকেরা চাঁদা তুলে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তাকে দাহ করে। বার বার আমার মনে হয় কেন জানিনা যে আমি তার চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাতটি তুলে চিৎকার করে বলছি – ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ।’
আমাদের এলাকায় ফেমাস রমজান পাগলা। চাপড়া বাজারে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার দেখা মিলবে। চাপড়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে ডোমপুকুর গ্রামে তার বাস। সকালে হাফ প্যান্ট আর সার্ট পরে কাপড়ের একটা থলে কাঁধে আর লাঠি হাতে বাস রাস্তায় এসে দাঁড়ালেই যে কেউ তাকে যে কোনো বাহনে পৌঁছে দেয় চাপড়া বাজারে। এমনকি বাসের ড্রাইভাররাও তাকে রাস্তার যেখানেই পাক তুলে নেবে বাসে। ব্যবসায়ী লোকেদের বিশ্বাস রমজানের জন্য কিছু করতে পারলে তার ব্যবসায় লাভ সেদিনের মতো নিশ্চিত। পয়া পাগল রমজান সবার বিশ্বাস।
রমজানকে সবাই দু’চার পয়সা দেয়। কেউ হয়তো বললো – ‘পকেট থেকে নিয়ে নে।’ পকেট থেকে প্রচুর টাকা বার হলেও রমজানের দাবী একটা দু’ -টাকা বা পাঁচ টাকার কয়েন। সেটা পেলেই সে হাসি মুখে বলবে – ‘সাবাস বেটা, ভালো বেটা।’ রসিক পাগলা রমজান। আপনার সঙ্গে রসিকতাও করতে পারে। আপনার কাছে গিয়ে হয়তো বললো – ‘বলতো, হাঁড়ির মধ্যে পাকাকলা।’ আপনি যেই বললেন অমনি বলবে – ‘তুই কি আমার বড়ো শালা?’ বা কখনো বলতে পারে -‘বলদিকি, ফেঁসু।’
— ফেঁসু।
— হনুমান তোর মেসু।’
কাউকে হয়তো বললো – ‘বলতো, হাঁড়ির মধ্যে মুসুরি।’
— মুসুরি।
— তুই কি আমার শাশুড়ী?
মুসকো একটা লোককে শাশুড়ী বলে তার সেকি খ্যাকখ্যাকে হাসি।
রমজান যখন তার ব্যাগটা রেখে হয়তো কোথাও গেছে, ছেলের দল সেই সুযোগে তার সঙ্গে রসিকতা করার জন্য হয়তো ব্যাগে ইঁট ঢুকিয়ে রেখেছে। ফিরে এসে সে যখন ব্যাগটা কাঁধে তুলতে না পেরে খুলে ইঁট আবিষ্কার করবে তখন তাকে দেখে কে। কোন হতচ্ছাড়া তার ব্যাগে ইঁট রেখেছে সেটা খুঁজে বার করার জন্য সে আপনাকেও হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারে। আপনি যাকে দেখাবেন সে তাকেই সেই ইঁট নিয়ে তাড়া করবে। কিন্তু কখনোই মারবে না। মুখ দিয়ে হয়তো কয়েকটি অপশব্দ বার হতে পারে। তবে সেটা উত্তেজনার পারদের উপর নির্ভর করবে। এ হেন রমজানের পিছনে যদি কেউ না লাগে তখন সে বলবে – ‘আজকে কি বাজারে কেউ আসেনি?’
বড় আন্দুলিয়া বাস স্ট্যাণ্ডে গেলেই দেখতে পাবেন লুঙ্গি পড়ে, ছেঁড়া জামা গায়ে সিরিঙ্গে একটা লোক ইঁটের টুকরো নিয়ে ব্যস্ত পিচ রাস্তায় হাবিজাবি লিখে চলেছে। কাউকে জিজ্ঞাসা করার আগেই শুনবেন – ‘আলায় পাগলা কোনদিন বাসে চাপা পরে মরবে।’ আন্দুলিয়াতেই বাড়ি আলায় পাগলের। বাজারে সারা দিন-রাত ঘোরাঘুরি।
একদিন স্কুল থেকে ফিরছি। ক্লাস সিক্স তখন আমার। একাই। বাজার থেকে ব্যবসায়ী সমিতির বিল্ডিং পেরিয়ে মাঠের দিকে আল পথ ধরবো। দেখি একটা টিউবওয়েলের নীচে মাথা রেখে ভেজাচ্ছে আলায় পাগলা। ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। দেখছি মাথা ভেজানোর পর একটা ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজেই ন্যাড়া হচ্ছে সে। ধারালো ব্লেডে চুল সহ মাথার চামড়া উঠে আসছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চোখ-মুখ। আমি ভয়ে চোখ বুজে কাঁদতে কাঁদতে বাজারের দিকে দৌড়। হায়রে পাগলা!
অনেক বছর পর তখন কলেজে পড়ি। দেখি বাজারে আলায় পাগলা আর সন্তোষ পাগলার মারামারি। কী নিয়ে? না বাজারের বাসন্তী পাগলীর সঙ্গে কে থাকবে তাই নিয়ে। হাসি পেলো বড্ড। মনে মনে উচ্চারণ করলাম জয় গোস্বামীর কবিতা –
‘পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।’
পরবর্তী সমাচার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের পাঁচিকে নিয়ে। বসির আর ভিকু ডাকাতের মতো পরিণতি এদের হয়নি। কিছু দিনের মধ্যে বাসন্তী উধাও হয়ে যায়। আলায় আর সন্তোষের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
আমাদের গ্রামের গঙ্গারাম ঘোষ হাট্টাকাট্টা যুবক। দুরন্ত মহিষ দিয়ে লাঙ্গল বহায় আর গাড়ি টানায়। বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার। সে হঠাৎ করে পাগল হয়ে গেলো। প্রথম দিকে কেউ বললো ভূতে ধরেছে বা জিন, পরীতে আউলানি দিয়েছে। কেউ বললো গোদানে পেয়েছে (ঘোড়া মরে গেলে নাকি গোদান হয়)। অনেক ওঝা-বদ্দি, মৌলানার তেলপড়া, জলপড়া, তাবিজ-কবজ দেওয়া হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। হাসান ডাক্তারের ওষুধও ফেল। দিন দিন পাগলের পাগলামি বেড়েই চললো। বউ-বাচ্চাকে মারে। রাস্তা-ঘাটে যাকে সামনে দেখে তাকেই মারে। সারা গ্রামের ত্রাস হয়ে উঠলো গঙ্গারাম। পরামর্শ করে তাকে শিকল দিয়ে বাড়ির চালা ঘরটাতে বাঁশের শক্ত খুঁটিতে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো। বউটি বাচ্চা আর পাগলাকে নিয়ে পড়লো মহা আতান্তরে। মহিষ বিক্রি হয়ে যেটুকু জমি ছিলো তা বিক্রি হয়ে গোলো। বউটাকে সাহায্য করা কেউ নেই। সে লোকের বাড়িতে কাজ করে, কাঁথা সেলাই করে, শাক-পাতা, ক্ষুদকুড়ো চেয়েচিন্তে দিন গুজরান করতে লাগলো। সমাজে তার পরিচয় হলো গঙ্গা পাগলার বউ। শয়তান পুরুষের দল তার উপর নজর দিলো। বউটা সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে মরলো। বাচ্চাটার কান্না শুনে পাড়ার লোক গিয়ে দেখে সব শেষ। মৃত দেহটা দাহ করার জন্য যখন গ্রামের লোকেরা নিয়ে যাচ্ছিল সবার চোখে জল। এক পাগলা সেদিন খুব হাসছিল। একেবারে অট্টহাসি। সে হাসি কেউ কোনো দিন শোনেনি। তবে সে হাসি – হাসি না কান্না শুধু গঙ্গারামই জানে।
(ক্রমশ)