খড়কুটোর জীবন : মাঠে মাঠে চলো বিহরি । পর্ব ৩ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
সেই মাঠ আর আমাকে চেনেনা। একদিন যে মাঠের খোলা হাওয়া আমার জন্য বরাদ্দ ছিলো এখন তা অন্য কোনো ফুসফুসে। তবু এখনও যখন চোখ বুজে শুয়ে থাকি দেখি আমার বুকের ওপর তার নীল আকাশ, কাঁচা রোদ্দুর হামাগুড়ি দিচ্ছে। আর আমি অপত্য স্নেহে জড়িয়ে ধরে চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দিচ্ছি। আমার শিকড় নেমে যাচ্ছে গভীর থেকে আরো গভীরে। একটি বীজ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ছে আদিগন্ত মাঠের জরায়ু জুড়ে। শূন্যে ভিজে বেদনার মেঘ জমছে । এখন যেখানেই বৃষ্টি হোক পুরাতন বেদনার গন্ধ
বয়ে আনে সে। একথা জানেনা কেউ — কেবল সেই প্রান্তর জানে।
চতুর্দিকে সবুজ মাঠ। মাঝখানে দ্বীপের মতো ছোট্ট আমার গ্রাম। গ্রামের দক্ষিণ দিকে পূ-বিলের মাঠ, কলের মাঠ, উত্তর দিকে গুব্দো মাঠ আর পুঁটিমারির বিল, পশ্চিমে মষেগাড়ির মাঠ, পূর্ব দিকে কানাডাঙা , ঘষেগাড়ি, কাগমারি , নাপতেফালি, অন্নাগাড়ি, শুড়েখোঁড়া, চৌউরধার, সড়ানের মাঠ আর বিশালাকার বিল মাঠ। এক এক মাঠের চরিত্র এক এক রকম। কেউ এক ফসলি, কেউ দু-ফসলি, আবার কেউ তিন ফসলি। মানব জীবনের মতো সে মাঠ। আবাদ করলেই সোনা ফলে। আবার দৈব দুর্বিপাকে কৃষাণের চোখে অশ্রু নামায়।
গ্রামের সবথেকে কাছের মাঠ কলের মাঠ। কলের মাঠ নাম কেন? কেননা এই মাঠটিতে রয়েছে ডিপ-টিউবয়েল। তাই কেউ কেউ বলে ডিপটি-কলের মাঠ। সারা মাঠ জুড়ে পাইপের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় ভূগর্ভস্থ জল। প্রায় খান কুড়ি স্পাউট থেকে মাটির ড্রেনে জল ঢোকে টুকরো টুকরো আল বাঁধা ক্ষেতে। জল সেচনে বাড়তে থাকে ফসলের প্রাণ। বিবর্ণ-ধূসর ক্ষেতে জেগে ওঠা সবুজে বাতাস হিল্লোল তোলে। ডিপ-টিউবয়েলের অপারেটর সময় ধরে কল চালান, জল দেন, ট্যাক্স আদায় করেন। আর নির্জন মাঠে শেয়াল -শিশিরের সঙ্গে কল সংলগ্ন আবাসটিতে একাকী জীবন যাপন করেন। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে তার বেশ দোস্তি। বাড়ি থেকে কেউ কেউ দিয়ে আসে নানান আহার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টার যেন সে। আর আমার গ্রাম গল্পের উলাপুর। তবে রতন এর মতো কেউ তার জীবনে আসেনি। তিনি কবিতাও লিখতেন না। মাঝে মাঝে গ্রামের ফুটবল টিমে যোগ দিতেন। হুল্লুড়ে মানুষটি তার একাকী আবাসে ছেলেদের নিয়ে মাঝে মাঝে করতেন পিকনিক। গ্রাম থেকে কিনে আনা হতো পাতি হাঁস, মুরগি বা ডিম। মাঠের ভিতরের ময়রা পুকুর থেকে যোগান পেতেন মাছের। মাসে মাসে কয়েক দিনের জন্য তিনি যখন নিজের শহরের বাড়িতে যেতেন তখন হয়তো তার এবং তার পরিবারের সবার মন ভালো হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের মন খারাপের শেষ হতো তাকে আবার ফিরে আসতে দেখলে। সঙ্গে নিয়ে আসতেন শহুরে গল্পগাছা। ফিল্ম স্টার থেকে খেলোয়ার, মোহন বাগান – ইস্ট বেঙ্গল, চিমা থেকে মারাদোনা, কপিল দেব থেকে আজহার উদ্দিনের সব খবর তার কাছেই জানতাম। জেনেছিলাম রাজীব গান্ধীর হত্যা কাহিনী। এল টি টি কারা। শ্রীলংকার জাফনা দ্বীপ, প্রভাকরণ, তাদের বীরত্ব সব। আবার জেনে ছিলাম গঙ্গাসাগরে মা অভয়া নামক যাত্রী বোঝাই ট্রলারের ডুবে যাওয়া ঘটনাও। আজ আর মনে নেই সব। তিনি কতকাল ফিরে গেছেন শহরে। বেঁচে আছেন কিনা তাও জানিনা। নির্জন মাঠের বাসিন্দা সেই মানুষটি আজো বেঁচে আছে আমার নির্জনতায়। হাওয়া পাওয়া সময়ের পালে যতই লেখা থাক – জগতে কে কাহার।
পড়াশুনা না করলে আমাদের বুড়ো মাস্টার বলতেন — ‘ঘোড়ার ঘাসকাটা হবি’। কিন্তু আমি পড়াশুনার পাশাপাশি মাঝে মাঝে সকালে বা বিকালে ঘাস কাটতে যেতাম। বিশেষকরে বাড়ির কাছের গুব্দো মাঠে বা কলের মাঠে বা কানাডাঙাতে। পড়নে হাফ প্যান্ট আর জামা, মাথায় গামছা আর বগলে ভাঁজ করা চটের বস্তা, হাতে কাচি। একেবারে ডামাট লাগানো আধখানা চাঁদ। এই হলো ঘাসিয়াড়ার পোশাক। কাচি হাতে বন্ধুদের সঙ্গে যেতে যেতে ছড়া বলতাম —
‘পড়ে পেলাম এক কাচি
কাচিই নেই ধার,
পড়ে পেলাম এক হার
হারে নেই লকেট,
পড়ে পেলাম এক পকেট,
পকেটে নেই টাকা
চলে গেলাম ঢাকা,
ঢাকায় নেই শাড়ী
চলে এলাম বাড়ি,
বাড়িতে নেই ভাত
কচু খেয়ে থাক।
কী কচু?
মান কচু।
কী মান?
বর্ধমান।
কি বর্ধ?
চুপ করতো!’
কে আর চুপ করে। হাসতে হাসতে গ্রাম ছেড়ে মাঠের আল পথে পৌঁছে যেতাম ততক্ষণ ।
শীতের সময় সর্ষে বা গমের ক্ষেতের ভিতর থেকে ছিঁড়ে নিতাম হেঁটকায়, বেতু বা যব। যব আর গম মাঝে মাঝে একাকার হয়ে যেতো। ঘাস তুলতে তুলতে ভরে উঠতো পিঠের বস্তা। যেন চা বাগিচায় চা-পাতা তুলছি। পাটের সময় কাটা পাট গাছের মাথা গুলো কেটে নিতাম। সেই মেথির বোঝা পাটের কাঁচা আঁশ দিয়ে বেঁধে বাড়ি নিয়ে এসে বিচালির সঙ্গে চুরিয়ে গরুর ছানির সঙ্গে দিতাম।অন্য সময় শ্যামা, মুথা, দূর্বা, বৈটান, নটে দাম, আদা গিঁটে, কিশুরী, শুড়শুড়নি, কলমি লতা, বিরকিনী, ভেজালী, ক্যান্দ্রা, পটপটি, শিয়াল কাঁটা, ধানের কেস্তি, ময়না, ভেজালি, চাপাটি, কেশি, উলু , ব্যানা ঘাস নিয়ে আসতাম মাঠ থেকে। ভ্যাজালি ঘাস ফসলের মধ্যে হলে তা নিড়ানো ছিলো ভীষণ কষ্টকর। তাই গ্রাম্য ছড়া — ‘ওরে শালা ভ্যাজালি আমাকেও হ্যাদালি, বউটাকেও পাদালি।’ কোনো কিছু মরণাপন্ন বা নষ্ট হতে বসেছে এমন বোঝাতে বলা হতো — ‘ব্যানা তলি তলি।’
সবুজ ঘাসের পেলবতা আমাকে মোহিত করে দিতো। আমার ইচ্ছে কবির ইচ্ছের সঙ্গে মিলে যেত খোলা প্রান্তরের ভাঁজে ভাঁজে —
‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস— তেমনি সুঘ্রাণ—হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।
আমারও ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি– চোখে চোখ ঘষি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।’
ঘাস কাটতে গিয়ে গল্প হতো, গান হতো। আমাদের মতো ছোকরাদের সঙ্গে বুড়োরাও যেতো ঘাস কাটতে। আজিরুদ্দিন দাদার চুটকি বেশ মজার ছিলো। বলতেন — ‘সেবার বিলের ধারে ঘাস কাটছি। দুই লোক জল পেরিয়ে পাশের গ্রামে যাবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো — ‘এখান দিয়ে গেলে প্যান্ট ভিজবে?’ আমি বললাম — ‘প্যান্ট কেন, লেপ, কাঁথা যা দেবে সবই ভিজবে।’ সে কথা শুনে সবার হাসি। তিনি মাঝে মাঝে বিড়ি টেনে মেসিন চললে সাইলেন্সার দিয়ে যেমন ধোঁয়া বার হয় তেমন করে নাক দিয়ে ধোঁয়া বার করতেন আর মুখে বড বড করে শব্দ। আর আকবত দাদা যখন তাল ঠুকে ঠুকে শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন — ‘বাগদিনীর সাজ সেজে চল মা আমার সঙ্গে চল /হাতে সরা নে মা তারা যাতে করে সেঁচবি জল/বাগদিনীর সাজ সেজে চল মা আমার সঙ্গে চল।’ — তখন জাত-পাতের বেড়া ডিঙিয়ে মানবতার ঘোড়াগুলো ঘাস খেতে আসতো আমাদের স্বর্গে।
(ক্রমশ)