খড়কুটোর জীবন : সেইসব মোড়লেরা। পর্ব ২৪। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
কথায় আছে –‘গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল। ‘ কিন্তু আমাদের গ্রামে অনেক মান্য মোড়লের মোড়লি দেখেছি। যাদের সিদ্ধান্ত গ্রামের সকল মানুষ নতমস্তকে মেনে নিতো বা মানতে বাধ্য হতো। পারিবারিক অনুষ্ঠান বা সমস্যা, সামাজিক কোনো সিদ্ধান্ত — সবেতেই মোড়লেরা ছিলেন শেষ কথা। সে মোড়ল কেউ মুকুন্দরামের ‘ চণ্ডীমঙ্গল’ এর বুলান মণ্ডল , কেউবা ভাঁড়ু দত্ত আবার কেউ রবী ঠাকুরের ‘ ডাকঘর ‘ নাটকের মোড়ল মশাই। কেউবা শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ ‘ উপন্যাসের বেণী ঘোষাল বা গোবিন্দ গাঙ্গুলী। সাহিত্যের চরিত্রদের বাস্তবরূপ দেখেছি গ্রামজীবনে ।
রাখাল বিশ্বাস গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার । কিন্তু দাপট তখনও বজায় রয়েছে। সমাজকে তখনও তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিসংস্কার আইনের ফলে তার বহু জমি খাস হয়ে গেছে। গ্রামের প্রান্তিক কৃষকেরা অনেকেই সেইসব জমি পেয়েছেন। একটা সময় যারা তার গোলামি করতো অর্থাৎ ভাগচাষী বা মজুর ছিলো তারা জমির মালিক হয়ে গেল। এটা তার নাপসন্দ। গরীবের বাচ্চাগুলো সব মাথায় উঠে গেলো। গরীব-গুর্বোর দলও লাল ঝাণ্ডা ধরে এতদিনের তার শাসন, শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। শুরু হলো প্রাক্তন জমিদারের বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত। কেউ হয়তো সখ করে একটা ঘড়ি কিনেছে। বাঁ হাতে পরে জমিদারের বৈঠকখানার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। জমিদারের সাগরেদ দের কারো নজরে পড়লো। সে জমিদারকে জানাতেই জমিদারের হুকুম – ‘ ধরে নিয়ে আয় ওকে। ‘ ধরে নিয়ে আসা হলে জমিদারের তিক্ত ভাষণ — ‘ ইতরের বাচ্চা, ঘড়ি পরে আমাকে দেখাতে আসা হয়েছে? তোর এত বড়ো স্পর্ধা? এই ঘড়িটা কেড়ে নে। আর ঘড়ি পরা হাতটা ভেঙে দে? কোনো ছোটো লোকের বাচ্চা যেন আমার সামনে ঘড়ি পরার সাহস না দেখায়। ‘ কথা মতো কাজ হয়ে গেল। জমিদার ছোটো লোকের বাচ্চাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। কেউ হয়তো নতুন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে তার সাইকেলের হাওয়া খুলে দেওয়া হলো। এমন আর কতদিন চলবে। ছোটো লোকেরা একদিন একত্রিত হয়ে জমিদার আর তার ঠ্যাঙারে বাহিনীকে পিটিয়ে দিলো। গ্রাম থমথমে । জমিদার প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে।
গ্রামের বারোয়ারীকে কেন্দ্র করে নানান মোড়লের মৌচাক বসতো বড়ো পূজা বা নাম যজ্ঞের পূর্বে।আকাশে মেঘেরা যখন তুলোর নানান পুতুল হয়ে উঠতো, নয়নজলীর ধারে দুল তো কাশ, পাট পচা জলের গন্ধ মিশে যেতো শিউলি সুবাসের সঙ্গে তখন এক সন্ধ্যায় মোড়লরা দুর্গাপূজার মিটিং ডাকতো। প্রত্যেক বাড়ি থেকে একজনকে সেই মিটিং এ হাজির থাকতেই হতো। তারা মিটিং-এ বসে প্রথমে দেখে নিতেন কোন কোন গ্রামবাসীর চাঁদা বাকি আছে। তাদের প্রত্যেককে ধরে ধরে শাস্তি দিতেন। তারপর নুতুন চাঁদা ধার্য করা হতো গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলা হতো পরতা ফেলা। কারো পরতা কত হবে তা মোড়লদের মর্জির উপর নির্ভর করতো। কেউ পরতা দিতে অস্বীকৃতি হলে তাকে একঘরে করে রাখার হুমকি দেওয়া হতো। অনেকে মোড়লদের কাছে অর্থাৎ দশের কাছে নতজানু হয়ে চাঁদা কমানোর প্রার্থনা জানাতো। দশের বিচারে ঠিক করা হতো চাঁদা কমবে না একই থাকবে। মোড়লদের তোষামোদ কারী অনেকে সামর্থ থাকলেও চাঁদা কমিয়ে নিতেন। এরপর মোড়লরা ঠিক করতেন কারা পরতা আদায় করবে বা করা পূজার দায়িত্বে থাকবে বা পূজার অনুষঙ্গে কী কী আয়োজন হবে। চাঁদা যারা তুলতে যেতেন তারা একরকম বাড়ি বাড়ি গিয়ে জুলুমবাজি করতেন। তাদের অত্যাচারের ভয়ে অনেকে ধার দেনা করে চাঁদা মেটাতেন । পূজার দিনগুলিতে মণ্ডপে মোড়ল ও তাদের বাড়ির লোকেদের আধিপত্য চলতো। মোড়ল – গিন্নীরা আগে অঞ্জলি দেবেন, প্রসাদ পাবেন – তারপর বাকিদের।
কারোর বাড়িতে বিবাহ বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হলে আগে বাড়িতে ডেকে মোড়লদের অনুমতি নিতে হতো। সমাজের কে কে নিমন্ত্রণ পাবে বা কে কী করবে তা গৃহকর্তা কে ঠিক করে দিতেন মোড়লেরা। দশের কথায় তাকে উঠতেবসতে হতো। মোড়লদের অনুমতি না নিলে গ্রামের লোক কেউ সেই বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগ দিতো না। গৃহকর্তা দশের অনুমতি ব্যতীত কাউকে নিমন্ত্রণ করলেও সেই নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিতে হতো।
গ্রামে ভায়ে-ভায়ে পৃথগন্ন অর্থাৎ ভেনো বা আলাদা হওয়ার সময় ভাগ বাটোয়ারায় ডাক পেতেন মোড়লেরা। তাদের বিচার প্রত্যেক ভাইকে মেনে নিতে হতো। এছাড়াও যে-কোনো পারিবারিক সমস্যায় মাতব্বরদের মাতব্বরী ছিলো শীরোধার্য। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পত্তি বা অন্যান্য বিষয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে মোড়লেরা মোড়লদেল কাছে বিচার দেওয়া হতো। তারা অপরাধের বিচার করে বিধান দিতেন। কখনো অপরাধীর মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢালা হতো, কখনো করা হতো জুতো পেটা, কখনো করা হতো আর্থিক জরিমানা বা একঘরে করে দেওয়ার মতো ঘটনা।
গ্রামের প্রত্যেক মোড়ল ছিলেন নীতি পুলিশ। নবীনেরা তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতো। তাদের সামনে মেপে কথা বলতে হতো। বিড়ি- সিগারেট আড়ালে খেতে হতো। গ্রামের যুবক- যবতীদের ভাব-ভালোবাসা বা বেলেল্লাপনা তারা একদম সহ্য করতেন না। আজ ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগে হারিয়েছে সব। হারিয়েছে সমাজ বোধ। তবু চোখের সামনে ভাসে ডাকঘর নাটকের সেই দৃশ্যটি। যেখানে মোড়ল বলছেন — ‘ কে রে? আমি পঞ্চানন মোড়ল। তোদের মনে ভয় নেই নাকি? ‘
(ক্রমশ)