খড়কুটোর জীবন : সিনেমা যখন । পর্ব ১১ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
স্কুলে বন্ধুরা মিঠুন নামের এক বন্ধুকে ক্ষ্যাপাতো — ‘ঘরে নেই নুন / ছেলের নাম মিঠুন।’ আবার তাপস নামের ছেলেদের শুনতে হতো — ‘ঘরে নেই পাকা তাল / ছেলের নাম তাপস পাল।’ এইরকম করে সিনেমার হিরো বা হিরোইনদের নাম নিয়ে আমরা অনেক ছড়া বলতাম। যেমন — ‘ঘরে নেই চিনি / মেয়ের নাম মন্দাকিনী।’ গ্রামে-গঞ্জে বাবা-মায়েদের প্রবণতা ছিলো প্রিয় নায়ক-নায়িকাদের নামে জাতক-জাতিকার নাম রাখা। আমাদের বহু বন্ধু-বান্ধবীদের নাম ছিলো – প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, রণজিৎ, দেবশ্রী, শতাব্দী, ইন্দ্রানী, বিপ্লব, অভিষেক, রাজ্জাক, জসিম, মান্না, রুবেল, ফিরদৌস, দিলদার, অঞ্জু, শাবানা, রোজিনা, পপি, চম্পা ইত্যাদি। গ্রাম জীবনে সিনেমার যে কী প্রভাব ছিলো তা এর থেকে বোঝা যায়।
খুকি পিসির বিয়ে হলো। অষ্টমঙ্গলাতে নতুন পিসি মশাই এলেন। তাকে কেন্দ্র করে বাড়িতে আনন্দ উৎসব। খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব বেশ হৈ হৈ ব্যাপার। বাড়িতে অন্যান্য পিসি আর মা-কাকীমারা তাদের নতুন জামাইবাবু বা ঠাকুরজামাই-এর কাছে আব্দার করে বসলো চাপড়ার ‘রূপবাণী’ সিনেমা হলে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। কারণ অন্যসময় প্রমীলা কুলের কাছে সসৈন্যে সিনেমা দর্শন নিষিদ্ধ। তো নতুন পিসি মশাই সম্মতি দিতেই সকলে আহ্লাদে অষ্টখান। মাথায় শ্যাম্পু লাগিয়ে কেউ রেখা, কেউ হেমা, কেউ সুচিত্রা, কেউ শতাব্দী হয়ে গেলেন। আমরা কেউ মাস্টার অরিন্দম তো কেউ মাস্টার বিট্টু। বাড়ির বিকাশ রায় বা পাহাড়ী সান্যাল বা উৎপল দত্তেরা নানান রকম উপদেশ বাণী শোনাতে থাকলেন। কেউ কেউ একটু গর্জন করলেন, নইলে আর গার্জেন কেন। তো খাওয়া-দাওয়া সেরে সদলবলে পিসি মশাই বাড়ি থেকে বারোটার দিকে বার হলেন। একটা-চারটে শো। চারটে-সাতটা দেখতে গেলে রাত্রি হয়ে যাবে। বাহিনী যখন সিনেমা হলের কাছে পৌছালো তখন চতুর্দিকে লোক থই থই। কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। পিসি মশাই আর ছোটো কাকা লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাউন্টারের উপরে লেখা ব্যালকনি – ২০ টাকা, প্রথম শ্রেণী – ১৫ টাকা এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর মূল্য ১০ টাকা। ভিড় ঠেলে পিসি মশাই তেরোখানা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কেটে নিয়ে এলেন। সঙ্গে ছোটো কাকার সঙ্গত। তো টিকিট দেখিয়ে একে একে অন্ধকার হলের ভিতর প্রবেশ। অতঃপর টর্চের আলোয় একে একে সকলের সিট নং অনুযায়ী আসন গ্রহণ। বাইরে বিশাল পোস্টার দেখে এসেছি। সিনেমার নাম ছোটো বউ। পরিচালনায় অঞ্জন চৌধুরী, অভিনয়ে – রঞ্জিত মল্লিক, প্রসেনজিৎ, সন্ধ্যা রায়, কালী ব্যানার্জী, নিমু ভৌমিক প্রভৃতি। বেল বাজতেই সিনেমা শুরু হলো। পর্দায় মিউজিকের সঙ্গে বাইরে পোস্টারে লেখা নামগুলো ফুটে উঠতে থাকলো। দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে চলেছি দ্রুত। কেশবিন্যাস, মেকআপ, ফাইট, কোরিওগ্রাফি , সঙ্গীতের কথা, সুর, প্লেব্যাক – একটা সিনেমার এত বিষয় থাকে ভেবে অবাক হতাম। পরে জেনে ছিলাম যারা সিনেমার মধ্যে পায়রা ওড়ার শব্দ, জুতো পায়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ বা কাচের গ্লাস টেবিলে রাখার শব্দ ইত্যাদি শব্দগুলো কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করে সংযোজন করে তাদের থালি আর্টিষ্ট বলে।
যাই হোক সিনেমা শুরু হলো। দৃশ্যের পর দৃশ্য চলে যাচ্ছে। মনে আছে ঠাকুমা হরলিক্সের কৌটাটা কেড়ে নিয়ে যেতেই ছোট্ট বিট্টুর আর চেটে চেটে হরলিক্স খাওয়া হলো না। সে মায়ের মার খেলো। সে তো জানেনা তার বাবার উপার্জন কম, তাই তার হরলিক্স খাওয়া হবে না। নিজেদের বাড়ির কথা মনে এলো। বাবাকে মাঝে মাঝেই শুনতে হয় – ‘তোমার তো পাঁচটা পেট?’ মা-কে কতদিন সিনেমার সন্ধ্যা রায়ের মতো নিজের ভাত অতিথিকে খাইয়ে জল খেয়ে থাকতে দেখেছি। প্রসেনজিৎ আর দেবীকার প্রণয় সঙ্গীতে আর নৃত্যে এক সময় মোহিত হয়ে গেছি চোখের জল মুছে। তখন বাজছে – ‘পাহাড়ের জঙ্গলে এক মানুষ খেকো বাঘ থাকে /মানুষের পোশাক পড়ে ডোরা ডোরা দাগ ঢাকে…।’ বেশ উৎফুল্ল মন। শয়তান শাশুড়ী শাস্তি পাচ্ছে। ভালো মানুষের জয় যে শেষ পর্যন্ত হয় তা সেদিনের সিনেমা থেকে জেনে গিয়েছিলাম। মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে সিনেমা হলের বাইরে এলাম সকলে। তারপর মিষ্টি খেয়ে বাড়ি।
গ্রামে বিয়ে বাড়িতে অনেকে ভাড়া করে আনতেন ভিডিও। অমরপ্রেম , অমরসঙ্গী , কথা দিলাম, লড়াই, আবিষ্কার, সাহেব কতনা সিনেমা দেখেছি বিয়ে বাড়িতে। বিয়ের ফুল সিনেমাটি অবশ্যই থাকতো। মুখে মুখে গান ফিরতো – যতই করো বাহানা, যতই বলো নানা /বিয়ের ফুল ফুটলেই বাজবে বিয়ের বাজনা । আবার কোনো বাড়িতে দেখেছি চলছে গীত সঙ্গীত সিনেমাটি। গান বাজছে – দরজা খুইলা দেখুম যারে করুম তারে বিয়া। বিয়ে বাড়িতে সিনেমা দেখতে গেলে যে নিমন্ত্রিত হতে হবে এমন কোনো ব্যাপার ছিলো না। সে আনন্দ যজ্ঞে সবার আমন্ত্রণ ছিলো। বর যাত্রীদের সঙ্গে জমে উঠতো আলাপ আলোচনা। প্রসেনজিৎ এর বাবার নাম বিশ্বজিৎ, তিনি নায়িকা দেবশ্রীকে বিয়ে করেছেন, চিরঞ্জিত এর পিতা বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট শ্রী শৈল চক্রবর্তী, সুচিত্রা সেন উত্তম কুমারের বিরহে আর জনসমক্ষে আসেন না, মনোজ মিত্র অধ্যাপক, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ডাক্তার হয়েও অভিনয় করেন, তাপস পালের বাড়ি চন্দননগর, মিঠুন চক্রবর্তী শান্তিপুরের লোক, কিশোর কুমারের স্ত্রী যোগিতাবালীকে মিঠুন বিয়ে করেছেন, অমিতাভ বচ্চনের স্ত্রী জয়া ভাদুড়ী – এরূপ নানা কথায় ভরে উঠতো সেসব সিনেরাত। ঢুলু ঢুলু চোখে ভোরবেলা বাড়ি ফিরে নিদ্রা যেতাম। সিনেমার রঙিন স্বপনেরা এসে ফুল তুলতো সে ঘুমের বাগানে। জাদু লাগাতো, মায়া লাগাতো প্রাণে। তারপর কড়া রোদ্দুর, বাবার কানমলা আর সিনেমা সৃষ্টি করতো ম্যাজিক রিয়ালিজম। সে জাদু বাস্তবতায় নিজেকে কখনো পর্দার জীবনে কখনো ছেঁড়া কাঁথায় মুড়ে ফেলতাম। দাবানল শেষে পোড়া পাখিরা উড়ে যেতো জলঙ্গীর ঢেউয়ের উপর দিয়ে।
গ্রামে সরস্বতী বা দুর্গা পূজা উপলক্ষে টিকিটের বিনিময়ে ভিডিও দেখার চল ছিলো। চট দিয়ে ঘিরে দেওয়া হতো। ক্লাবের ছেলারা ব্যবস্থা করতো সব। দুই টাকার বিনিময়ে ভিডিও দেখা। সন্ধ্যা থেকে হয়তো দু’টো শো হতো। সিনেমার নাম আগে থেকেই গ্রামে মাইকের মাধ্যমে প্রচার করা হতো। বাড়ির বউ-ঝিরা এ সুযোগ কাজে লাগাতেন। গুরুদক্ষিণা, ফুলনদেবী, আশা ও ভালোবাসা, অন্ধবিচার, মন্দিরা, অনুতাপ, আক্রোশ, আব্বাজান, দামু, দেবতা -এইসব সিনেমাই চলতো মূলত। হিন্দি সিনেমা খুবই কম চলতো। বাবা তারকনাথের মতো সিনেমাও আসতো। সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পথে কেউ গায়ের -হে মোর গুরু দক্ষিণা /গুরুকে জানাই প্রণাম, তো কেউ গায়ছেন – মিশরের নীল নদ সাগরে মিলায় ইত্যাদি। কেউবা আক্রোশ সিনেমার উৎপল দত্তের সংলাপ আউড়াচ্ছেন, কেউ ভিক্টর ব্যানার্জীর মতো জুতোতে বারূদ ঘষে সিগারেট জ্বালাচ্ছেন। গ্রামের ঝগড়ুটে বউ বা মেয়েদের ডাকা হতো দস্যুরানী ফুলনদেবী বলে।
শুক্রবার বাংলাদেশের বিটিভি চ্যানেলে আর রবিবার বিকেলে কলকাতা দূরদর্শনে হতো বাংলা সিনেমা। যাদের বাড়িতে টিভি ছিলো ভিড় করতাম তাদের বাড়িতে। ছোটোখাটো কাজ করে দিয়ে তবে সে সিনেমা দেখার সুযোগ হতো সাদাকালো জীবনে। নায়ক, আগন্তক, চিড়িয়াখানা, ধন্যি মেয়ে, ভালোবাসা ভালোবাসা, অন্তর্জলি যাত্রা, পদ্মানদীর মাঝি, ভানু পেলো লটারী, গুপি গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, সোনার কেল্লা কত যে রবিবাসরীয় বিনোদনের সঙ্গী হয়েছিলো তার ইয়ত্তা নেই। যমালয়ে জীবন্ত মানুষ সিনেমার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাম হাম গুড়ি গুড়ি ডান্স আজো মনে আছে। আজকের বাবা যাদব বা গণেশ আচারিয়ার কোরিওগ্রাফি তার কাছে নস্যি। বাংলাদেশের কতনা সিনেমা দেখেছি। ইলিয়াস কাঞ্চন আর শাহনাজের মাটির কসম, তারেক মাসুদের মুক্তির গান, চাষী নজরুল ইসলামের হাঙর নদী গ্রেনেড, কাজী হায়াৎ পরিচালিত মান্না, দিলদার অভিনীত তেজি আরো কত নাম। চিরঞ্জিত ও অঞ্জু ঘোষ অভিনীত বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না ছিলো দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনার ছবি।
কলাকুশলীরাও ছিলেন দুই বাংলার। জানালার শিক ধরে আমরা নিজেদের সিনেমার বন্দী রাজকুমার ভাবতাম আর গাইতাম – মা, আমি বন্দী কারাগারে / আছি গো মা বিপদে / বাইরের আলো চোখে পড়ে না। ঘর থেকে চিরুনি নিয়ে গিয়ে ছাগলের মাথা আঁচড়াতাম। ছাগলটা চিরুনি সহ দৌড় দিলে দিলদারের মতো বলতাম – ছাগল ভাই, ছাগল ভাই আমার চিরুনি দিয়া যাও। বেদের মেয়ে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে বা কারোর স্থিরিকৃত বিবাহ ভেঙেছে তাদের শুনতে হতো – বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে / আসি আসি বলে জ্যোৎস্না ফাঁকি দিয়েছে।
অন্যান্য গ্রামের মতো আমাদের গ্রামেও ছিলো ভিডিও হল। মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনির সে হলে কত নায়ক-নায়িকার ভালোবাসা- বিরহ- লড়াই দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে কত সময়। ঠোঁটের কোণে জমেছে কত সংলাপ, কত গান। হৃদয়ে জমেছে কত ইচ্ছের রঙ। কিন্তু খুব ছোটোতেই বুঝেছিলাম জীবনটা ফিল্মি ফিল্মি নয়। বাংলাদেশের তারেক মাসুদের মাটির ময়না দেখতে গিয়ে কতবার চোখের জল মুছেছি। মাদ্রাসার ছোটো ছোটো ছেলেদের নিজের বন্ধু মনে হতো। জীনে ধরেছে বলে গ্রামের এক বন্ধুর উপর ওঝার অত্যাচার মিলে গিয়েছিলো সিনেমাতে জলে বার বার ডুব দিতে থাকা ছেলেটির সঙ্গে। হুমায়ুন আহমদের শ্যামল ছায়াতে দেখেছিলাম বাংলাদের মুক্তি যোদ্ধাদের লড়াই আর পাকিস্তানি খান সেনাদের নির্মমতা। গায়কের ছদ্মবেশে থাকা হুমায়ুন ফরিদির লড়াই আজো চোখে লেগে আছে। আমাদের বাড়ি থেকে বাংলাদেশ চার কিলোমিটার। কাঁটাতারে উড়তো আমার মন প্রজাপতি। মুক্তি যোদ্ধারা কেমন যেন আপন মানুষ হয়ে উঠতো।
আমাদের বড় আন্দুলিয়াতে ছিলো মুখোমুখি দুটি ভিডিও হল সুমনা আর মিনতি। স্কুল পালিয়ে বন্ধুরা মাঝে মাঝে সেখানে হাজিরা দিতাম। কলেজে পড়ার সময় কখনো তেহট্ট প্রান্তিক, বেতাই বাবুয়া , কৃষ্ণনগর সঙ্গীতা, মিমি, চিত্র মন্দির প্রভৃতি সিনেমা হলে সিনেমা দেখেছি। এগুলির অধিকাংশই আজ ইতিহাস। ঘরে ঘরে টিভি, মোবাইল আজ সেসব ভুলিয়েছে । তবু মায়া লেগে আছে এত বছরের জীবনের। এতো বলে শেষ করার নয়, কিছু কথা নির্বাক যুগের সিনেমা হয়ে থাকে সঙ্গোপনে।
(ক্রমশ)