কাগজের নৌকো। পর্ব ১১। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
গৃহের দ্বিতলে প্রশস্ত কক্ষটি পুরাতন দিনের সাতটি মেহগিনি কাঠের আলমারি দিয়ে সাজানো-সবগুলিই নানাবিধ পুস্তকে পরিপূর্ণ, বামদিকে দুটি গরাদহীন জানলার অপর প্রান্তে মেঘাচ্ছন্ন আষাঢ়ের দ্বিপ্রহর অলস পোয়াতির মতো নিদ্রাতুরা, মন্দ মন্দ পূর্বগামিনী বাতাসে কোনও বিরহীর দ্বীর্ঘশ্বাস যেন ভেসে আসছে, এখান থেকে বারাণসীর প্রানস্বরূপা সুরধুনিও চোখে পড়ে-নির্বিকার স্রোতে একখানি বজরা উত্তরদিকে রাজহংসীর মতো ভাসমান, উঁচু কড়ি বরগার ছাদে ঝোলানো পাখাটি যেন বরষা বাতাসের সঙ্গিনী-আপনমনে দুলে চলেছে।
কক্ষের মাঝে একটি কাঠের বড়ো টেবিলের সামনে আরাম কেদারায় বসে রয়েছেন চন্দ্রভানু রায়-বৃদ্ধ মানুষটির পরনে সাদা রামজামা, হাঁটু হতে পায়ের পাতা-একটি ধূসর তুষের চাদরে আবৃত, মাথায় কাশচরের মতো কেশরাজি পরিপাটি করে সাজানো, দাড়ি-গোঁফ কামানো পরিষ্কার মুখমণ্ডলে সোনালি গোল চশমার আড়ালে উজ্জ্বল দুটি চোখে কৌতুক রৌদ্রের ঝিলিমিলি স্পষ্ট বোঝা যায়, পাশে নিচু টেবিলে একটি গ্রামাফোন যন্ত্র ও কতগুলি এল.পি রেকর্ড রাখা-বোধহয় বৃদ্ধ গান শুনছিলেন, দরজায় ঐন্দ্রীকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘আসুন, আপনার কথা গতকাল রাত্রে অবিনাশ আমায় বলেছে।’
প্রত্যুত্তরে নমস্কার জানিয়ে ঐন্দ্রী স্মিত হেসে বলল, ‘এভাবে হঠাৎ এসে আপনাকে বোধহয় বিরক্তই করলাম!’
সামনে গদি আঁটা একটি চেয়ার হাতের ইশারায় ঐন্দ্রীকে দেখিয়ে আন্তরিক সুরে চন্দ্রভানু বললেন, ‘বিরক্ত কেন করবেন, আমি একা মানুষ, বইপত্র নিয়ে দিন কাটানোর মাঝে কেউ এলে সত্যিই ভালো লাগে। তবে কী জানো, আজকাল হাঁটাচলায় বড়ো কষ্ট, বাতের ব্যথায় প্রায় চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছি।’, কথা শেষ করেই কী যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিমায় বলে উঠলেন, ‘দেখেছেন, বুড়ো বয়সের খেয়ালে আপনাকে “তুমি” বলে ফেলেছি! কিছু মনে করবেন না! আসলে বৃদ্ধ বয়সে স্নেহার্দ্র হয়ে ওঠে মন, তখন জগতকে আপন মনে হয়! বেশি কথা বলার মতো এও একধরণের অসুখ!’
চেয়ারে বসে ঝোলাটি কোলের উপর রেখে কিশোরীর মতো হাসল ঐন্দ্রী, ‘আমাকে “তুমি” না বললেই কিন্তু রাগ করব!’
–তুমি তো দেখছি আজকালকার মেয়েদের মতো নও! অবশ্য অবিনাশ বলেছিল সে-কথা! আমি কিন্তু তোমাকে আগে থেকেই চিনতাম!
বিস্মিত স্বরে ঐন্দ্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘চিনতেন?’
নিচু টেবিলে রাখা ভারী কাঁসার গ্লাসটি তুলে একচুমুক জল খেয়ে মিটিমিটি হাসলেন বৃদ্ধ, ‘তোমার আঁকা ছবি দেখেছি আমি, সিরিজের নাম দিয়েছিলে সুরনদী-রিভার অব মিউজিক!’
কিশোরীর কৌতুহলে বেজে উঠল ঐন্দ্রী, ‘আপনি কলকাতা এসেছিলেন?’
–নাহ! আমার এক পরিচিত আর্ট ডিলার ছবিটি কিনে আমাকে পাঠিয়েছিল, বেডরুমে ওয়াল-মাউন্ট করা আছে! ভারি সুন্দর ছবি, কতদিন রাত্রে খোলা জানলা দিয়ে ভেসে আসা গঙ্গা-বাতাসের মধ্যে বসে পাহাড়ি পথ, ধুপি গাছ, নির্জন ঝোরা, কুয়াশা আর রৌদ্রের খেলা দেখেছি আমি, প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছ তুমি চিত্রে, তাই বোধহয় দেখতে পেয়েছি!
বৃদ্ধের কথা শুনে ভারি চমৎকৃত হল ঐন্দ্রী-এমন কাব্যকুসুম বাক্যে সাধারণ মানুষ তো কথা বলেন না, তবে কি এই বৃদ্ধ নিজেও শিল্পচর্চা করেন? কিন্তু ছবিটি কোন্ ডিলার পাঠাল? যতদূর মনে পড়ছে, ‘তিস্তা’ রামানুজ সেল করেছিল, রামানুজ কি চন্দ্রভানুর পরিচিত?
ঐন্দ্রীর চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে চন্দ্রভানু বললেন, ‘ছবিটির নাম তিস্তা, তবে তোমার আঁকা দেখে আমার বারবার মনে হয়, তিস্তা কোনও নদী নয়, সে এক পাহাড়ি কিশোরী, অর্কিড আর ফার্নের ছায়ামাখা নির্জন পথের বাঁকে তার ছোট্ট কাঠের বাড়ির এক টুকরো বারান্দায় বসে ঝিলমিল কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় প্রতিদিন, মেঘ আসে, আবার রৌদ্রে মুছেও যায়, কুয়াশাচ্ছন্ন খাদের ধারে তিরতিরে বুনো ফুলের মাথায় বৃষ্টি এলে ওই কিশোরী গান গেয়ে ওঠে, মজা কী জানো, সেই নেপালি গানটিও তোমার ছবির রঙে স্পষ্ট শুনতে পাই আমি!’, একটানা কথা বলে বৃদ্ধ আবার দু-চুমুক জল খেয়ে সাদা একফালি কাপড়ে মুখ মুছে ঐন্দ্রীর দিকে তাকিয়ে মধুর শরতের মতো হাসলেন।
এমন পূর্ণবয়স্ক শিশুর হাসি অনেকদিন দেখেনি ঐন্দ্রী, মনে মনে ভাবল, এই মানুষটির সঙ্গে আলাপ না হলে জীবনের প্রান্তে নির্জনে ফুটে ওঠা শান্ত নির্ভার কুসুমকোমল মন দেখা হত না কোনওদিন!
‘এমন করে ছবির কথা বলতে খুব কম মানুষকেই আমি দেখেছি!’, লাজুক হেসে ঐন্দ্রী বলল।
–আসলে কী জানো, এখন তো আর একজিবিশনে যেতে পারি না, তাই ডিলারের উপরেই নির্ভর করতে হয়, তবে এই ছেলেটি আমার রুচি বোঝে, ছবি কেনার বিষয়ে এখনও অবধি হতাশ করেনি।
কিছুটা আন্দাজের উপর নির্ভর করেই ঐন্দ্রী শুধোল, ‘তার নাম কি রামানুজ চক্রবর্তী?’
সামান্য বিস্মিত কণ্ঠে চন্দ্রভানু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি চেনো তাকে?’
–রামানুজ আমার আর্ট ডিলার, সেক্রেটারিও বলা যায়-একজিবিশন, সেল, প্রমোশন সবই ও দেখে।
–দ্যাখো কী বিচিত্র কাণ্ড, আমরা দুজনেই রামানুজকে চিনি অথচ আমাদের এতদিন পরিচয় ছিল না! একসময় সারা দেশ ঘুরে ছবি কিনেছি, আমার কাছে রবি বর্মা থেকে ফিদা হুসেন সবার কাজই রয়েছে, গণেশ পাইনের একটি অপ্রকাশিত কাজও আছে! এই সূত্রেই বোম্বাইয়ের জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে বছর পাঁচেক আগে রামানুজের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
কৌতুহলী ঐন্দ্রী বলল, ‘গণেশ পাইনের কাজটি সম্ভব হলে একবার দেখানো যায়?’
মৃদু হাসলেন চন্দ্রভানু, ‘নিশ্চয় দেখাব, তাকে বড়ো যত্নে রাখা আছে! তবে তার আগে তোমার প্রশ্নগুলি শুনব, অবিনাশ বলছিল, গিরিশবাবুকে নিয়ে তুমি নাকি একটি সিরিজ শুরু করার কথা ভাবছ!’
জানলা দিয়ে দিগন্তপ্রসারী জাহ্নবীর পানে একপলক চাইল ঐন্দ্রী, পশ্চিমাকাশ মেঘকাজলে আকুল, রৌদ্র মুছে চরাচরে কে যেন ছায়াবৃতা জননীর স্নেহাঞ্চলটি বিছিয়ে দিয়েছে, উন্মনা বাতাসে নাওয়ের মতোই টলোমলো চন্দ্রভানু রায়ের পুরাতন ভদ্রাসনের এই কক্ষ-ঐন্দ্রীর সহসা মনে হল, তারা সেই অপরূপ বাতাসি পানসি চড়ে সুদূর কোনও দেশে ভেসে চলেছে, কোথায় চলেছে তা ঠিক জানে না কেউই, তবুও চলেছে, দুপাশে কত নগর, ক্ষুদ্র জনপদ, ধানে ভরা আষাঢ়ি ক্ষেত, কত ভগ্ন দেবদেউল, ধুলিধূসর প্রত্নক্ষেত্র, মানুষের সুখ, দুঃখ, বেদনা, ছিন্ন একতারায় বেজে ওঠা সুর সমস্ত কিছু পার হয়ে তাদের নাও তিরতির স্রোতে বয়ে চলেছে আর এই চিত্রটি বিশাল কোনও পটে আঁকছেন মায়া দেবী, তার আদি অন্ত নাই, রেখা ফুটে উঠছে আবার মিলিয়েও যাচ্ছে পরক্ষণে, প্রতিবার একটি নূতন চিত্র, কতজন্ম ধরে যেন এমনই হয়ে আসছে, খেলাটি পুরাতন অথচ কোনও ক্লান্তি নাই!
‘তুমি ওঁকে নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছ?’, চন্দ্রভানু রায়ের প্রশ্নে সংবিত ফিরে এল ঐন্দ্রীর।
দীর্ঘ বেণীটি কাঁধের একপাশে নিয়ে স্মিত হেসে ঐন্দ্রী বলল, ‘তেমন বিশেষ কিছু নয়, দু-চারটি বইপত্র পড়েছি মাত্র, সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র বলা যেতে পারে। ওঁর প্রথম জীবন আর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাত পরবর্তী জীবন-এই দুটির মধ্যে যে বৈপরীত্য, তাই নিয়েই সিরিজটি করার ইচ্ছে রয়েছে!’
–দেখো, দুটি জীবনে অমিল থাকলেও তাদের একেবারে বিচ্ছিন্ন বলা যায় না! পরবর্তী কালের বীজ প্রথম জীবনেই ছিল, ওটিই সংস্কার, নাহলে ওমন ষোলো আনা বিশ্বাস আর ভক্তি হঠাৎ আসে না!
–ওঁর তিরিশ বছর বয়সে বোধহয় স্ত্রী মারা যান, তখন থেকেই কি জীবনযাত্রা আলাদা হয়ে গেল?
চশমা খুলে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন চন্দ্রভানু, তারপর ঐন্দ্রীর দিকে একপলক তাকিয়ে ধীর স্বরে বললেন, ‘তা বলতে পারো! হ্যাঁ, জন্ম আঠারোশো চুয়াল্লিশ আর স্ত্রী প্রমোদিনী মারা যান আঠারোশো চুয়াত্তর সালের চব্বিশে ডিসেম্বর, গিরিশ্চন্দ্রের তখন তিরিশ বছর বয়স, এর কয়েকদিন আগেই যে আপিসে চাকরি করতেন-অ্যাটকিন্সন সাহেবের নীল ব্যবসার আপিস, সেটিও উঠে যায়, এদিকে ছোট ভাই ক্ষীরোদচন্দ্র আর বোন কৃষ্ণকিশোরীও মারা গেলেন, সব মিলিয়ে সে-এক দুঃসহ অবস্থা। স্ত্রীর মৃত্যু ওঁকে খুব কষ্ট দিয়েছিল, “আজি” বলে তাঁর রচিত একটি কবিতা পড়লেই সে-কথা বোঝা যায়! সেখানে তিনি লিখেছিলেন, “শৈশব সুখের স্বপ্ন নাহিক এখন, যৌবনে ঢালিয়া কায় পেয়েছিনু প্রমদায়, মলে কি ভুলিব হায় প্রথম চুম্বন!”‘
সাগ্রহে ঐন্দ্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘এই সময় কি তিনি থিয়েটার শুরু করেছেন?’
গেলাস থেকে এক চুমুক জল খেয়ে চন্দ্রভানু মাথা নাড়লেন, ‘নাহ! থিয়েটার আরও পরে, এই সময় তিনি আবার “ফ্রাইবার্জার এন্ড কোম্পানি”র চাকরি গ্রহণ করেন, এই কাজের সূত্রেই গিরিশবাবুকে ভাগলপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে হত, আমার ধারণা, পরবর্তীকালে নাটকের বিভিন্ন সাধারণ চরিত্র এই পর্বের অভিজ্ঞতার ছায়ায় রচিত হয়েছিল।’
–তারপর?
–তারপর এই চাকরিও ছেড়ে দেন, অস্থিরতা শুরু হয়েছে মনে, শিশিরকুমার ঘোষের অনুরোধে ইন্ডিয়ান লিগের হেড ক্লার্ক আর ক্যাশিয়ারের চাকরিতে যোগ দেন, তখন আঠারোশো ছিয়াত্তর, তবে এখানেও মন টিকল না বেশিদিন, এক বছর পরেই চাকরি ছেড়ে পার্কার কোম্পানির আপিসে বুক কিপারের কাজ নেন!
দু-এক মুহূর্ত পর ঐন্দ্রী আনমনা স্বরে বলল, ‘এই যে বারবার চাকরি বদল, কোথাও মন টিকছে না, তার মানে, তখন ওঁর খুব অস্থির দশা!’
‘নিশ্চয়! অস্থির তো বটেই, আর ওই অস্থিরতা জুড়োবে সেই দক্ষিণেশ্বরে, ওই গানটি শোনোনি ?’, বৃদ্ধের কথা মাঝপথে থামিয়ে ঐন্দ্রী মৃদু হেসে বলল, ‘শুনেছি! জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই, কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই!’
–হ্যাঁ, শেষের পঙতিগুলি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কর তমঃ নাশ, হও হে প্রকাশ, তোমা বিনা আর নাহিক উপায়, তব পদে তাই শরণ চাই! তবে এ-গান লিখেছেন আরও অনেক পরে!
–এই সময়ই কি দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন?
মাথা নাড়লেন চন্দ্রভানু, ‘ঠিক! সিমলে পাড়ার বিহারীলাল মিত্রের কন্যা সুরতকুমারীর সঙ্গে বিয়ে হয়। আসলে বুঝছ না, বারবার বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছেন মন স্থির করার, কিন্তু যা লেখা আছে ললাটে, তা কে খণ্ডাবে বলো? কুটো বাঁধা আছে যে অন্য জগতে!’
বিস্মিত স্বরে ঐন্দ্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘অন্য জগত মানে?’
হাসলেন চন্দ্রভানু, অলস জ্যোৎস্নার মতো সেই হাসি যেন শিউলি ফুলের রেণু, মালিন্যহীন এমন হাসি বহুদিন ঐন্দ্রী দেখেনি! স্মিত স্বরে বৃদ্ধ বললেন, ‘সে-জগতের কথা যে আমি জানি না মা! আন্দাজ করতে পারি মাত্র! তুমি ছবি আঁকার সময়ে যে জগতে থাকো, তেমনই কিছু হবে হয়তো! কী জানি!’, একমুহূর্ত চুপ করে থাকার পর পুনরায় বললেন, ‘পরে গিরিশ লিখেছিলেন, “আমার মনে ধারণা জন্মিয়াছে যে গুরুর কৃপা আমার কোন গুণ নহে।”-এই বাক্যটি পড়ি আর আজকাল অবাক হয়ে ভাবি, কতদূর অটল বিশ্বাস থাকলে এমন কথা লেখা যায়! সে তো আর আমার মতো আলগা বিশ্বাস নয়, ও হল জাতসাপের কামড়, একবার ধরলে আর ছাড়ান নাই!’
কথা শেষ হওয়ার পরেই ঐন্দ্রী দেখল, ঘাট থেকে বাড়ি অবধি পথ চিনিয়ে নিয়ে আসা মানুষটি হাতে একখানি রুপোর ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর গেলাসটি নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে তাদের দুজনকেই অভিবাদন জানালেন, তিনি চলে যেতেই চন্দ্রভানু গেলাস দেখিয়ে ঐন্দ্রীকে বললেন, ‘আজকাল তোমরা মিষ্টি খাও না জানি, কিন্তু এই বাড়িতে আমিষ খাবারের চল নাই, তাই শরবত করতে বলেছিলাম। মালাই-কেশরিয়া লস্যি, কাশীর বিখ্যাত পানীয়, মনে হয় ভালোই লাগবে!’
রুপোর গেলাসের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ সত্যিই বিস্ময়কর, প্রায় একসেরি হবে, মাথায় ঢাকনির উপর ক্ষুদ্র ময়ূর বসে রয়েছে-লাল পাথরে তৈরি তার চোখ দুটি আলোয় জ্বলজ্বল করছে-এই অভিজাত পানপাত্রের পানে চেয়ে মুগ্ধ গলায় ঐন্দ্রী বলল, ‘এমন অপূর্ব কারুকাজ আজকাল দেখাই যায় না!’
মৃদু হাসলেন চন্দ্রভানু, ‘আজকের তো নয়, এই গেলাস ব্যবহার করতেন আমার প্রপিতামহ! প্রতিদিন সকালে একসের খাঁটি দুধ খেয়ে তাঁর দিন শুরু হত, শেষ বয়সেও দশাশ্বমেধ ঘাটে নিয়মিত মুগুর ভাঁজতেন-সেইসব মানুষ, দিনকাল কোন্ স্মৃতিস্রোতে মিলিয়ে গেছে!’
ঐন্দ্রীও হেসে বলল, ‘আমি কিন্তু এত শরবত খেতে পারব না!’
–তুমি বুঝি আমিষ ভালোবাসো?
–না, না, দু বছর হল আমিষ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি! এখন মাছ মাংসের গন্ধও আর ভালো লাগে না!
বিস্মিত কণ্ঠে চন্দ্রভানু বললেন, ‘তুমি তো দেখছি সর্বার্থেই ব্যতিক্রমী! খাও, খাও, ধীরে সুস্থে খাও, ভালো লাগবে!’
বাইরে ঝিমঝিম বৃষ্টি শুরু হয়েছে, গঙ্গার ওপার বৃষ্টির অস্বচ্ছ আঁচলের তলায় অস্পষ্ট, বাড়ির পেছনের বাগান থেকে চাঁপা ফুলের সুবাস বিস্মৃত কোনও কাব্য পদের মতো ভেসে আসছে, পথঘাটে লোকজন তেমন নাই, হাতে একখানি ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে নির্জন গলি পার হয়ে ছুটে যাচ্ছে একটি অল্পবয়সী বালক-জগতের পানে একপলক চেয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম, পার্কার কোম্পানির চাকরিও শেষ পর্যন্ত গিরিশ ছেড়ে দিলেন, মাসে দেড়শো টাকা বেতন, তখনকার দিনে কম নয়! এই চাকরি ছেড়ে বিয়ের পর যোগ দিলেন গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে, মালিক তখন প্রতাপচাঁদ জহুরি, গিরিশবাবুর বেতন ঠিক হল মাসে একশো টাকা! এখানে ছিলেন ম্যানেজার, তখন আঠারোশো আশি সাল, এই শুরু হল ওঁর জীবনের বর্ণময় অধ্যায়! বোধহয় নিয়তি দেবীই স্বয়ং তাঁকে রঙ্গমঞ্চে ডেকে এনেছিলেন।’
কেশর সুবাসে আমোদিত হিমশীতল লস্যির গেলাসে চুমুক দিয়ে ঐন্দ্রীর মনে হল শিশিরে ভেজা কোনও বাগিচায় সহস্র গোলাপ ফুটেছে, আরও একটি চুমুক দিয়ে দু-এক মুহূর্ত পর জিজ্ঞাসা করল, ‘এর পর থেকেই কি ওঁর অভিনয় জীবন শুরু হয়?’
–তা ঠিক নয়, আগেও অভিনয় করেছেন, যেমন ধরো, আঠারোশো সাতাত্তরে মেঘনাদবধ কাব্য নাটকে তিনি রাম ও মেঘনাদ উভয় চরিত্রেই অভিনয় করেন-এইটি দেখেই সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক তাঁকে প্রথম গ্যারিকের সঙ্গে তুলনা করেন। এছাড়াও আঠারোশো আটষট্টি সালে প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে দুর্গাপুজোর রাত্রে সধবার একাদশী নাটকে নিমে দত্তর চরিত্রে অভিনয় করেও যথেষ্ট প্রশংসা পান, দীনবন্ধু মিত্রও এই নাটকে গিরিশের অভিনয় দেখে নাকি অভিভূত হয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, আঠারোশো আশি সালে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ওঁর পেশাদার নটের জীবন শুরু হল। অপরেশ্চন্দ্র লিখেছিলেন, ‘নাট্যকার, অধ্যক্ষ ও নাট্যাচার্য্য গিরিশচন্দ্রের প্রতিষ্ঠা এই প্রতাপ জহুরির থিয়েটার হইতেই আরম্ভ হইল!’
এখনও অপরাহ্ন অতিক্রান্ত হয় নাই অথচ ঘরখানি আঁধার হয়ে এসেছে, মলিন আলোর নৌকোয় চেপে বরুণা ও অসি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই সুপ্রাচীন নগরীটি যেন আপনমনে ভেসে চলেছে, দূরে দেবালয়ের সুউচ্চ চূড়াগুলি কুয়াশার মতো মিহি বৃষ্টি ছায়ায় আবছা, গলিপথ প্রায় জনহীন, চন্দ্রভানু রায়ের ভদ্রাসনের অদূরে কোনও নির্জন গৃহ প্রাঙ্গন থেকে ক্ষীণ বাঁশির সুর ভেসে আসছে-এমন বাদল বেলায় এই অবিমুক্ত ক্ষেত্রকে সত্যিই জাদু নগরী বলে ভ্রম হয়।
ঐন্দ্রী হাতের গেলাসটি টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বলল, ‘এই প্রথম জনপ্রিয়তার স্বাদ পেলেন গিরিশ্চন্দ্র, বোধহয় রাবণবধ পালা থেকেই তাঁর জয়যাত্রা শুরু হল!’
–ঠিকই বলেছ, রাবণবধ নাটক অন্য একটি কারণেও অবশ্য স্মরণীয়!
সাগ্রহে ঐন্দ্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘কী কারণ?’
–এই নাটক বিখ্যাত গৈরিশ ছন্দে লিখিত! মজা কী জানো, এর পর থেকেই গিরিশ মূলত পৌরাণিক নাটক রচনা শুরু করলেন, খুব যে ইচ্ছে ছিল তাঁর তা নয়, একজায়গায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যাত্রা-কথকতা ও হাফ আখড়াইয়ের শ্রোতাদের দেখে দেশে নাটক লিখতে হত। সেই দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে হলে পৌরাণিক নাটক ছাড়া আর উপায় কি?’
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে ঐন্দ্রী মৃদু হেসে বলল, ‘শিল্পীর চিরকালীন সঙ্কট। গুণমান নাকি জনপ্রিয়তা-এই প্রশ্নের মীমাংসা কিন্তু আজও হয়নি!’
পা দুটি অতিকষ্টে সামান্য নাড়াচড়া করে চন্দ্রভানু কৌতুকের স্বরে বললেন, ‘জনপ্রিয়তা ও উচ্চমান-দুটি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্করহিত বস্তু ঐন্দ্রী, এদের মধ্যে কেমন করে তুমি সম্পর্ক তৈরি করবে!’
বৃদ্ধের কথায় বিস্মিত হল ঐন্দ্রী, ‘আপনি সে-কথা কী করে বলতে পারেন? যা জনপ্রিয় তাই কি উচ্চমানের হয়? বরং দেখা যায়, জনপ্রিয় বস্তুই নিম্নমানের হয়!’
হাসলেন চন্দ্রভানু, ‘আচ্ছা, তোমার ছবি তো যথেষ্ট জনপ্রিয়, বহুমূল্য, দেশে বিদেশে ক্রেতা রয়েছে, তাহলে সেইটি নিশ্চয়ই খুব নিম্নমানের, কী বলো?’
শান্ত সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের কাছ থেকে এমন কূটপ্রশ্ন আশা করেনি ঐন্দ্রী, চুপ করে রইল! দু-এক মুহূর্ত পর বৃদ্ধ পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কথা বাদ দাও, হুসেন বা পিকাসো, জীবদ্দশায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁদের কাজ কি তুমি নিম্নমানের বলবে?’
–কিন্তু এই মুহূর্তে এমন অনেক শিল্পীর নাম করতে পারি, যাঁরা জনপ্রিয় হলেও, ছবি মোটেও ভালো নয়, আপনিও নিশ্চিত আমার সঙ্গে একমত হবেন!
ডান হাতের তর্জনীটি শূন্যে তুলে চন্দ্রভানু বললেন, ‘নিশ্চয়! আমিও তো সে-কথাই বলছি। মন দিয়ে শোনো, জনপ্রিয় মানেই উচ্চমানের হবে এমন কোনও কথা নাই, আবার যা জনপ্রিয় তাই নিম্নমানের-এটিও ভুল সিদ্ধান্ত! এর উদাহরণ আগেই দিলাম! আর উচ্চমানের হলেই জনপ্রিয় হবে-একথাও বুক ঠুকে বলা যায় না, উদাহরণ হিসাবে আমি ভ্যান গঘের নাম করব, জীবদ্দশায় তাঁর একটি ছবিও জনপ্রিয়তা পায়নি! তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল?’
ঐন্দ্রী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধোল, ‘কী?’
–জনপ্রিয়তা এবং গুণমান-দুটির মধ্যে কোনও সম্পর্কই নাই! তোমরা মিথ্যাই এসব নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করো। আসল বস্তু কী জানো? শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিকতা, এইটি হলেই সব হয়! আন্তরিক যদিও হও, দেখবে সব গোলযোগ মিটে গেছে!
দু-একটি নীরব মুহূর্ত কালস্রোতে ভেসে যাওয়ার পর ঐন্দ্রী আপনমনে নিজেকে শুনিয়েই যেন বলল, ‘এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি!’
–ভাবো, গিরিশবাবুর জীবনে এই কনফ্লিক্ট ছিল, আরও একটি বিষয়, জানি না আমার সঙ্গে কেউ সহমত হবেন কিনা!
–কী?
প্রায়ান্ধকার কক্ষে জানলার বাইরে ম্রিয়মান অপরাহ্নের দিকে চেয়ে রইলেন চন্দ্রভানু, ধীর স্বরে বললেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার পর ওঁর লেখায় স্পষ্টভাবেই ধর্ম প্রচারের কথা উঠে এসেছিল, নাটকের সংলাপ দীর্ঘ হয়ে উঠছিল ক্রমশ, চৈতন্যলীলার দ্বিতীয় ভাগ সম্পর্কে এই অভিযোগ করেছিলেন স্বয়ং বিনোদিনী! শঙ্করাচার্য্য নাটকও তাই। আবার ম্যাকবেথ নাটক তিনকড়ি দাসীর অসম্ভব ভালো অভিনয়ের পরেও জনপ্রিয় হয়নি, ক্ষুব্ধ হয়ে গিরিশ বাবু বললেন, “নাটক দেখিবার যোগ্যতালাভে ইহাদের এখনও বহু বৎসর লাগিবে-নাটক বুঝিবার সাধারণ দর্শক এখনও বাংলায় তৈরী হয় নাই!”। আমি জানি না, ধর্মভাব প্রচার শিল্পের উদ্দেশ্য হয়ে উঠতে পারে কিনা, হয়তো পারে, হয়তো বা তাতে শিল্প সৌন্দর্য নষ্ট হয়, আমি সত্যিই জানি না। আর বড়ো কথা হল, এই বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকারও আমার নাই, আমি তো আর শিল্পী নই, এখানে মতামত দেবে তুমি, তোমার মতো শিল্পীরা!’
–এইটি তো সাঙ্ঘাতিক কনফ্লিক্ট! এর উত্তর আমারও স্পষ্ট জানা নেই।
দীর্ঘ আষাঢ় সন্ধ্যা নেমে আসছে ভুবনে, যুবতির অভিমানের মতো ক্ষীণ আলোয় ভরে উঠেছে জগত উঠান, বারিধারার বেগ এখন স্তিমিত, পূর্বগামিনী চঞ্চলা বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় অতীত কালের আখ্যান, দূর দেশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে চন্দ্রভানু বললেন, ‘আসলে এসব কিছুই নয়, গিরিশ বাবুর মূল শক্তি ছিল আন্তরিকতা, বিশ্বাস ও ভক্তি। নাটক রচনায়, শিল্প বস্তুর নির্মাণে তিনি কখনও অসৎ ছিলেন না, তাই তো লিখতে পেরেছিলেন, “রঙ্গভূমি ভালোবাসি হৃদে সাধ রাশিরাশি, আশার নেশায় করি জীবনযাপন!”। এর তুল্য মধুর আর কী আছে ঐন্দ্রী? একজন শিল্পীর কাছে সত্যের অধিক মূল্যবান আদর্শ আর কিছু নাই।’
সহসা একটি ক্ষণস্থায়ী দৃশ্যপট ঐন্দ্রীর মনোকাশে রচিত হল-গভীর রাত্রি,পুরাতন কলিকাতার জনশূন্য পথ গ্যাসবাতির ম্লান আলোয় অস্পষ্ট কুয়াশার মতো ছায়াবৃতা, চঞ্চল বারিধারায় প্রায় মুছে গেছে জগত-স্বপ্ন, অদূরে সুরম্য গৃহের দ্বিতলে একটি কক্ষে মৃত্যুপথযাত্রীর ক্ষীণ শ্বাসবায়ু তুল্য পীতবর্ণ সেজবাতি শুধুমাত্র জেগে রয়েছে- অস্থির পায়চারি করছেন একজন পুরুষ ,অনাবৃত দেহ, একটি সাদা ধুতি পরনে, চক্ষুদুটি অস্তসূর্য অথচ অশ্রুর লেশমাত্র চিহ্ন নাই, শ্মশ্রুগুম্ফ শোভিত মুখখানি ভাবগম্ভীর, কিছুতেই যেন শান্তি নাই মানুষটির।
দ্রুত পায়ে একবার জানলার কাছে আসছেন, পর মুহূর্তেই চঞ্চল পায়ে ফিরে যাচ্ছেন শয্যায়, দেরাজের উপর রাখা কন্যাকের বোতল ওষ্ঠ স্পর্শ মাত্রই শুষ্ক হয়ে উঠছে অথচ পিপাসা মিটছে না। অনন্ত পিপাসা সেই সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই যেন তাঁর দোসর। গতকাল মানুষটি সাহেবের হৌসে পদত্যাগ করেছেন, অল্প কিছুদিন পূর্বে গত হয়েছেন স্ত্রী, ভবসমুদ্র এখন অস্পষ্ট তাঁর কাছে, সর্বক্ষণ মনোপটচিত্রে ক্ষীণকায়া জ্যোৎস্নার মতো কতগুলি ছায়াচিত্র তৈরি হয়, পরক্ষণেই কে যেন কোমল হাতে মুছে দেয় তাদের, কতগুলি চরিত্র-যারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসছে, অশ্রু স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, তারা পরিচিত নয় আবার অপরিচিতও বলা যায় না, সর্বসময় বেজে চলেছে তাদের করুণ প্রশ্নের সুর, তুমি লিখবে না আমাদের?
দূর আকাশে সৌদামিনী ক্রুদ্ধা কালসর্পের ন্যায় উদ্যত ফনা তুলে ধরতেই মানুষটি নিজ খেয়ালে বজ্রকঠিন ইস্পাতের সুরে বলে উঠলেন, ‘ঊর্দ্ধ জটাজুট গভীর নিনাদিনী, উগ্রতুণ্ডা ভীমা অশিব বিমোদিনী। দনুজ হ্রাস ত্রাস, লক্লক্ রসনা, অসুর-শির-চূর, ভীষণ দশনা, ধিয়া তাধিয়া ধিয়া, টলোটলো মেদিনী। নর-কর-বেষ্টিত কপালমালিনী, রুধির অধরা তারা শিশুশশী-ভালিনী, নয়ন-জ্বলন-জ্বালা, সুর-হৃদি-বর্দ্ধিনী।’
(ক্রমশ)