কাফিরনামা । পর্ব ৯। লিখছেন রাণা আলম

0

সুশান্ত কে কেউ আপনারা চেনেন না, সপ্তক কেও না। এরা দুজনে কেউই সে অর্থে সোসাল সেলেব্রিটি অথবা নৃত্য দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না। আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে ব্যস্ত চাকুরিজীবির বাইরে এদের আর কোনো পরিচয় ছিল না।

সুশান্ত এবং সপ্তক, দুজনেই গত বছর কোভিড সংক্রমণে মারা গেছে। সুশান্ত আক্রান্ত হয় বিধান সভা ভোট এ ভোটকর্মীর দায়িত্ব সামলে ফেরার পর। কোভিডে সুশান্তর মা এবং সুশান্তর মৃত্যুর সময়ের ব্যবধান ঐ দিন সাতেক। আর বহুজাতিক সংস্থার কর্মী সপ্তক বাড়িতেই ছিল। ভোট পরবর্তী সময়ে তার বাড়ির একাধিক সদস্য কোভিডে আক্রান্ত। প্রথমে সপ্তকের মা এবং তার মাস তিনেক পরে সপ্তক মারা যায়।

এখন গত দুবছরে আমরা অজস্র কোভিডে মৃত্যুর খবর দেখে ফেলেছি। অনেকেই নিজের প্রিয়জন হারিয়েছি। চোখের সামনে তরতাজা ফুটফুটে প্রাণ কে চলে যেতে দেখেছি। তাহলে নতুন করে পুরোনো দুটি ‘অপাংক্তেয়’ মৃত্যুর খবর নিয়ে লিখছি ক্যানো সেটা বলার দরকার আছে।

কিছুদিন আগে সংবাদ মাধ্যমে জনৈক সরকারি প্রতিনিধি বলছিলেন যে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ তে মাত্র জনা কুড়ি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সুতরাং এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

সত্যিই তো? ভয় পাওয়ার কি আছে? মাত্র জনা কুড়ি মানুষ। একুশ না বাইশ তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ওই জনাকুড়ি মাত্র।

মানুষ কখন তার অস্তিত্ব হারিয়ে নিছক সংখ্যায় পরিণত হয় তা বোঝা বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই কুড়ি জন মানুষের প্রত্যেকের একটা ঘর ছিল, উঠোন আর বারান্দা ছিল। তাদের সাথে বাঁচার মত কিছু মানুষ ছিল। হয়ত এই চলে যাওয়া মানুষটির উপর আর্থিক এবং মানসিকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তার পরিবারের বাকিরা।

একটা মহামারী এলো, সরকারের পক্ষ থেকে সেটাকে আটকানো বা প্রতিরোধ করার মত কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হল না, যাদের যাওয়ার কথা ছিল না তারা অসময়ে চলে গেলেন, অনেক পরিবার আক্ষরিক অর্থেই পথে বসলো, তারপর অনেক মানুষের অকারণ মৃত্যুর পর সরকার বাহাদুর ঘোষণা করলেন, এখন কোভিডে দিনে মাত্র কুড়ি জন মারা যাচ্ছে, কোনো ভয়ের কারণ নেই।

আমরা, ব্যানানা রিপাবলিকের ম্যাঙ্গো পাবলিকেরা নিশ্চিন্তে স্ট্যাটিস্টিকস ঘেঁটে দেখলাম এর চেয়ে বেশি লোক রোজ রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, সুতরাং আর ভয়ের কি আছে ইত্যাদি ইত্যাদি…

মানুষ মরণশীল, সুতরাং, মৃত্যু নিয়ে এত ভাবার কি আছে গোছের সেমি-দার্শনিক তক্কে আগ্রহ নেই স্যার। জাস্ট এইটুকুই বলার যে রাষ্ট্রের অপদার্থতা আর ঔদাসীন্যে যে মানুষটির মৃত্যু ঘটছে সে মৃত্যু আর পাঁচটা সাধারণ বয়সজনিত বা অসুখজনিত মৃত্যু সাথে তুলনীয় নয়।

হপ্তাকয়েক আগে শিলিগুড়িতে মাঝ বয়সী যে মানুষটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে মারা গেলেন বা লকডাউনের মধ্যে বাইপাসের ধারে বেসরকারী হাসপাতালে বাইরে পর্যাপ্ত টাকার অভাবে ভর্তি হতে না পেরে অ্যাম্বুলেন্সেই যে বয়স্ক মহিলা চলে গেলেন, সেগুলি কি নিছকই মৃত্যু নাকি রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যে খুন?

অপরিকল্পিত লক ডাউনে গাড়ি না পেয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে রাত্রে ট্রেন লাইনে ঘুমিয়ে ছিলেন ষোল জন জ্যান্ত মানুষ। ভোর রাতে তাদের উপর দিয়ে মালগাড়ি চলে যায়। ষোল জন জ্যান্ত মানুষ খুন হলেন।

দুহাজার কুড়ি সালে পুরো লকডাউন পিরিয়িডে হেঁটে রেল লাইন ধরে বাড়ি ফেরার পথে মারা গেছেন ৮৭৩৩ জন জ্যান্ত গোটা গোটা মানুষ। তাদের পরিবার ছিল। বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছিল। ঠিক আমার আপনার মত। ছিল না শুধু আমার আপনার মত ঘরে বসে থাকার প্রিভিলেজ।

আমাদের স্মৃতি খুব শক্তিশালী নয়। তাই খুব জলদি আমরা এই মৃত্যু লীলা ভুলে যাই। তারপরে বোকা বাক্সের সামনে ঠান্ডা ঘরে বসে আওড়াই, ‘মাত্র জনাকুড়ি মানুষ মারা গেছে’।

মুশকিল হচ্ছে যেহেতু এই কুড়ি জনের মধ্যে আমাদের নিজেদের কেউ নেই, তাই আমরা এই মৃত্যুগুলি নিয়ে মোটেই ভাবিত নই। অথবা মিডিয়া চর্চিত জীবনে আমরা কোন মৃত্যু টা নিয়ে ভাববো সেটাও বোধহয় ট্রেন্ড দেখে ঠিক হয়। দেনার দায়ে গত আর্থিক বছরে আমাদের দেশে ৫ হাজার ৫৭৯ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। যেহেতু তারা শত্রু দেশের হাতে সীমান্তে মারা যান নি তাই তাদের জন্য আমাদের দেশপ্রেম জেগে ওঠে না।

আমরা কি  আমাদের রাষ্ট্রের দিকে আঙ্গুল তুলবো না যে অপরিকল্পিত লকডাউন, ভ্রান্ত জনস্বাস্থ্য নীতি’র দায় তারা নেবেন না ক্যানো?

এইমুহুর্তে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ চলছে সারা দেশে। সরকারী হিসেবে শুধু গতকালই আমাদের রাজ্যে ৩৯ জন মানুষ মারা গেছেন। মাত্র ৩৯ জন। অতএব ভাবার কিছু নেই। আমরা জাস্ট পোকামাকড়ের বেশি কিছু নই রাষ্ট্রের কাছে। তাই, সংক্রমণ বাড়বে জেনেও কুম্ভ আর গঙ্গাসাগরে মেলা বসে, রাজনৈতিক দল চুটিয়ে মিছিল করে।

পার্থক্য একটাই, নেতা অসুস্থ হলে বাইপাসের ধারে দামী বেসরকারী হাসপাতালে অথবা পিজি হাসপাতালে ভিআইপি কেবিনে রাজার মত খাতির পান, দুবেলা মিডিয়া তার খবর করে। আর সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে জমানো পুঁজি শেষ করে বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়। সঞ্চয় শেষ হয়। সরকারী খাতায় আরও দু-একটা সংখ্যা যোগ হয়।

ঠান্ডা ঘরে বসে চশমা এঁটে আমলা হিসেব কষে জানান যে সাতজন মৃতদের মধ্যে পাঁচ জনের ডায়াবেটিস আর হার্টের অসুখ ছিল, তাই তাদের কোভিডে মৃত ধরা যাবে না। সংখ্যা কমিয়ে তিনি শাসকের হাততালি পান। বকলসে রূপোর বোতম বসে। শাসক তার গজদন্ত মিনারে বসে স্তাবকের স্তাবকতা উপভোগ করেন। আর আমরা, শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা মাথা নিচু করা বেঁচে থাকা অভ্যেস করি।

লেখার শুরুতেই সুশান্ত আর সপ্তকের কোভিডজনিত মৃত্যু কে ‘অপাংক্তেয়’ বলেছিলাম। কারণ এই মৃত্যু’র খবরে আমাদের কারুর কিচ্ছু যায় আসে না। সপ্তকের আট বছরের ছেলে প্রতিটি জন্মদিনে তার বাবার অপেক্ষা করবে। সন্ধেবেলা যতবার দরজার কলিং বেল বাজবে ততবার বাড়ির লোকের মনে হবে সুশান্ত বোধহয় বাড়ি ফিরলো।

খুব জরুরী ছিল কি এদের চলে যাওয়া? কার দায়? আমরা কি আদৌ উত্তর খুঁজবো কোনোদিন?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *