কাফিরনামা । পর্ব ৮। লিখছেন রাণা আলম

গঙ্গার ধারে বসে বেশ জম্পেশ করে মালাই চা তে চুমুক দিচ্ছিলাম। ডাক্তার আমাকে ড্রাই ফ্রুট, দুধ ইত্যাদি খেতে বলেছেন কিনা। মালাই চা তে কাজু বাদামের গুঁড়ো, কিশমিশ, ঘন সরমাখা দুধ সবই থাকে। এক ভাঁড় চা পান করলেই পিত্তিরক্ষাটাও হয় আর ডাক্তারের কথাটাও মানা হয়। তবে ডাক্তার মশাই আমার মালাই চা পান কে কতটা স্বাস্থ্যকর ভাবতেন সেটা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অবশ্যি, ডাক্তাররাই কে কবে এসব ডায়েট বিধি মেনে চলেন বলুন। আমার এক কৈশোরকালীন ডাক্তার বন্ধু আছেন তিনি ডায়েট করতেন গাজর সেদ্ধ খেয়ে। আজ্ঞে, সেরেফ গাজর সেদ্ধ নয়, তার সাথে থাকতো যথেষ্ট পরিমানে তন্দুরী চিকেন। তাকে দেখে অণুপ্রাণিত হয়ে আমিও চিকেন কষা দিয়ে ওটস খেতে শুরু করি। কিন্তু তা শুনে আমার ডাক্তার আবার বিন্দুমাত্র অণুপ্রাণিত বোধ করেন নি। এরেই কয় থিওরি অফ রিলেটিভিটি।

যাকগে, খাবার-দাবার  নিয়ে দু-লাইন না লিখলে ক্যামন আইডেনটিটি ক্রাইসিস হয় আজকাল, তাই লিখলাম আর কি। নইলে তো আপনি জানেনই, আমি এখন ঘোর ডায়েটে আছি। তৈলবহীন শূলপক্ক রামপাখি ছাড়া কিস্যু মুখে তুলিনা।

তা চায়ে চুমুক দিচ্ছি, অ্যামন সময় দেখি পাশে মৌলানা সায়েব বসে। মৌলানা সায়েব মাঝ-চল্লিশের মানুষ। দেওবন্দ না দারুল-উলুম কোথায় থেকে দু-চারটে পাশ দিয়ে এসেছেন। গঙ্গার ওপারে একটা মাদ্রাসা চালান। বেশ মিশুকে লোক। মৌলানা সায়েবের মুখ ভার। আমার দিকে তাকিয়ে কইলেন,

‘ভাইজান, এইটা কি ঠিক করলেন?’

যথারীতি ঘাবড়ে গেলাম। এই সাড়ে তিনদশকের দুনিয়াদারীতে ঠিক কটা জিনিস ঠিক করেছি তা হাতে গুণে বলা যায়। সুতরাং, ভুলের সাম্রাজ্যে নতুন কি ভুল যোগ করলাম জানতে চেয়ে কইলাম,

‘কি করলাম মৌলানা সায়েব?’

‘এই যে আপনি কাফিরনামার আগের কিস্তিতে লিখেছেন যে ইসলামে বাচ্চার জন্মের পর কানে দোয়া পড়া হয়। তা আপনার কানে নাকি পড়া হয় নি। ওটা দোয়া নয়, আজান। আপনি না জেনে লেখেন ক্যানো?’

যা বাব্বা। আজকাল আবার জেনেশুনেও লিখতে হয় নাকি। হালফিলে চাদ্দিকের বেশিরভাগ লেখাপত্তর দেখে তো মনে হয় সে পাঠ কোনকালেই চুকে-বুকে গ্যাছে। তবুও মাথাটাথা চুলকে দাঁত কেলিয়ে* বললাম,

‘সরি মৌলানাসায়েব’।

*ফুটনোটঃ দাঁত ক্যালানো বাঙালির অমোঘ অস্ত্র। আপিসে বড়কর্তার সামনে, বাড়িতে গিন্নীর সামনে, আধ ঘন্টা লেটে পার্কে ঢুকে প্রেমিকার সামনে, সর্বত্রই বাঙালির লাস্ট অব্যর্থ ওয়েপন হল দাঁত ক্যালানো। বাঙালি, বিশেষত বিবাহিত বাঙালি দাঁত ক্যালানোতে অনারারি ‘রকফেলার’।

 

মৌলানাসায়েব বাঁকাচোখে চাইলেন। দিলীপ ঘোষ যেমন একান্তে রাহুল সিনহার দিকে তাকান।

‘এই সরি কয়েই কি সব মাফ হয়ে যাবে সার? একে তো নামাজ রোজার ধার ধারেন না। এদিকে ইফতারের সময় বেহায়া বেশরমের মত দিব্যি কাবাব-রুটি খেতে বসে যান। তার উপরে এখানে সেখানে না জেনে না বুঝে উলটো পালটা বকে আবার কইছেন ‘সরি’।

মুশকিল হচ্ছে এসব নিয়ে অকারণ ‘আজাইরা’ তক্কো জুড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু শাস্ত্রে আছে যিনি ডেকে তন্দুরী রুটি আর পেঁপের আঠা দিয়ে তৈরী উৎকৃষ্ট গোস্ত কাবাব খাওয়ান, তার উপরে রাগ করতে নেই।

দয়া করে কোন শাস্ত্রে আছে তা জিজ্ঞেস করতে যাবেন না প্লিজ, মৌলানা সায়েব যখন ইফতারের সময় বলেন অমুক হইলে তমুক হয়, তখন তো আমি কক্ষণো কার্য-কারণ জিজ্ঞেস করতে যাই না, সটান ইফতারে মন দিই, আপনারা বরং কাবাবের রেসিপি  খুঁজতে পারেন, জাকারিয়া স্ট্রীটের আদমের সুতলি কাবাব এর ধারে কাছে আসে, চাইলে খেয়ে এসে আমায় থ্যাঙ্কুও জানাতে পারেন।

মৌলানা সায়েব অনেক দিন ধরেই ডাকছিলেন। এই সূযোগে তার মাদ্রাসা ঘুরতে যাওয়া হল। শহরের বাইরে মাঠের মধ্যে এল প্যাটার্নের লম্বা বাড়ি। একদিকে খাওয়ার ঘর। নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ। আর অনেকগুলো ঘরে বাচ্চারা থাকে। বাচ্চারা অধিকাংশই হতদরিদ্র বাড়ি থেকে উঠে আসে। অনেক ক্ষেত্রে বহু অনাথ বাচ্চারা এখানে পড়ে।

সাধারণতঃ এই ধরণের অস্বীকৃত এবং অসংগঠিত মাদ্রাসা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্তরে আপত্তি রয়েছে। বাচ্চাদের সঠিকভাবে পড়ানোর জন্য যে ধরণের পরিকাঠামো দরকার তার কোনোটাই এইরকম  মাদ্রাসায় থাকে না। ধর্মশিক্ষার বাইরে আর কোনো শিক্ষা এদের দেওয়া হয় না।ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মেঘনাদ সাহা বর্ণিত ‘সব ব্যাদে আছে’র আরেকটা ভার্সন তৈরী হয় মাত্র। গ্রামের মানুষ এবং কোনো মৌলানা স্থানীয় স্তরে উদ্যোগ নিয়ে এগুলো তৈরী করেন। সাধারণ মুসলিমের দানে এগুলো চলে।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামে সংখ্যালঘুদের ধর্ম-সংস্কৃতি আবর্তিত হয় মাদ্রাসা ঘিরে। এইখানে একটা অদ্ভূত বিষয় আছে। সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতি ঠাকুর-দালান থেকে উঠে আসতে পারে, সেখানে পুরোহিত মশাই কে দেখলে কেউই অস্বস্তিতে পড়েন না, অথচ ফেজ টুপি আর দাড়িওয়ালা মৌলানা সায়েব আর মাদ্রাসার নাম শুনলে অনেকেরই বিবমিষার উদ্রেক হয়।

এই ধরণের মাদ্রাসা পশ্চিমবঙ্গে অনেক। ‘দুধেল গাই’ দের স্বঘোষিত বর্তমান তল্পিবাহকদের আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের একজন সীমান্তবর্তী মাদ্রাসায় জঙ্গি পাওয়া যায় বা তৈরী হয় গোছের মন্তব্য করেছিলেন। সেসময় আমি স্কুলের ছাত্র। গ্রামের দিকে মুসলিম বাড়িতে কেউ মারা গেলে প্রতিবেশী অথবা ‘দশ’ বা সমাজ থেকে যারা প্রয়াত ব্যক্তিকে দেখতে আসছেন তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেরমই একটা জায়গায় আচমকা কেউ রব তুললেন যে পুলিশের গাড়ি ঢুকছে। খেতে বসেছিল স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্ররা। তারা খাওয়া ফেলে দৌড় লাগালো। পরে জানা গেল যে আগের রাতে পুলিশ জঙ্গী খুঁজতে সেই মাদ্রাসায় গিয়েছিল এবং বাচ্চাগুলোর সাথে মোটেই ভালো ব্যবহার করেনি।

দুপুরে একসাথে পাত পেড়ে খাওয়ার পর মৌলানাসায়েবের মাদ্রাসায় বাচ্চাগুলোর সাথে গল্প করছিলাম। আজ আমার সৌজন্যে মাংস হয়েছে। তাই খুব আনন্দ। এদের কারুর নাম সোহেল, কারুর আবার ইমরুল। দশ-বারো বছরের হাসিভরা নিস্পাপ মুখ। গল্প করতে করতে মাথায় ফেজ টুপি সামাল দিচ্ছিল। ফেরার সময় দেখলাম মাদ্রাসার বাইরে পোস্টার পড়েছে আগামী ‘জালসা’ নিয়ে তাতে আবার বেশকটা বানান ভুল।

এই বানান ভুলের প্রসঙ্গ টেনে মাদ্রাসা শিক্ষার অপকারিতা নিয়ে মৌলানা সায়েব কে জ্ঞান দিতে যাচ্ছিলাম। শ্যামলা চেহারার রোগাটে চোখে মৌলানা সায়েব আমার দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় বললেন,

‘ভাই, আমার আব্বা মারা যান তখন আমার বয়স পাঁচ। আম্মা সবার খাবার যোগাড় করতে পারতো না বলে আমায় মাদ্রাসায় দিয়ে এসেছিল। আমি আরবি তে কোরান-হাদিস ছাড়া আর কিছু পড়িনি। আপনি তো আমার ধর্মের লোক, আমার ভাই।  শুনেছি অনেকগুলো পাশ দিয়ে কলকাতায় কলেজে পড়ান। কই, কোনোদিন তো আপনি বা আপনার মত কেউই আমাদের খোঁজ নিয়ে এই ভুল গুলো শুধরে দিতে আসেনা’।

আমার ছত্রিশ বছরের শহুরে স্মার্টনেস এক ধাক্কায় কোথাও থমকে গেছিল। গাড়ি ছাড়ার আগে মৌলানা সায়েব আমার হাত ধরলেন,

‘ ভাই। আপনি আমার মেহমান। আমাদের তরফে কোনো ভুল হলে মাফ করবেন’।

বাস তখন ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানালা দিয়ে চেয়ে রইলাম। মৌলানা সায়েবের সাথে দাঁড়ানো দশ বছরের রফিকুল প্রাণপণে আমার দিকে চেয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ছিল। তার খুব ছবি আঁকার সখ। পরের বার এক বাক্স রঙ পেন্সিল চেয়ে রেখেছে।

পশ্চিম আকাশে তখন বিধাতাপুরুষ অস্তাচলের রঙ মাখাচ্ছেন আলতো চালে।

+ posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *