কাফিরনামা । পর্ব ৫। লিখছেন রাণা আলম

0

কলকেতা শহরটা আদতেই আজব কিসিমের পাবলিকে ভর্তি। উত্তর কলকাতার যে শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটায় মাস্টারি করতে যাই, সেইখানে এক সিনিয়র কলিগ দিদি আছেন। তার হাই সুগারের জন্য মিষ্টি খাওয়া বারণ। সক্কালবেলা আপিস ঘরে ঢুকে পিওন দিদিকে হাঁক দ্যান,

‘সাবুউউউউ, জলদি দৌড়ে অ্যাকটা সুগার ফ্রি সন্দেশ নিয়ে আয় তো।আমার খালি পেটে ওষুধ খাওয়া বারণ’।

আমার কলেজের চৌহদ্দিতে কোথাও সুগার ফ্রি সন্দেশ পাওয়া যায় না। পিওন দিদি যথারীতি চিনি-চর্চিত সন্দেশই কিনে আনেন। দিদি সেটা মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার স্বর্গীয় আস্বাদ উপভোগ করেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে সুগারের ওষুধটা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

‘শত্তুরের শেষ রাখতে নেই। বুঝলি?’

আমি তো নাহয় বুঝলাম। কিন্তু দিদি’র ডাক্তার কি করে বুঝবেন সেটাই লাখ টাকার কোশ্চেন।

অবশ্যি, ডাক্তার রা আর কবেই বা রুগীর দুঃখ বুঝলেন? আমার ডাক্তার প্রত্যেকবার সুগার-কোলেস্টরলের ত্রৈমাসিক রিপোর্টের দিকে তাকান আর রাগে দাঁত কিড়মিড় করেন। ডাক্তার হলে সজ্ঞানে রুগীকে মারা যায় না গোছের কিছু একটা শপথ বাক্য বোধহয় ওনাদের পাঠ করতে হয় নইলে উনি স্বেচ্ছায় আমায় খুন করে আন্দামান যেতেন, এরম ইচ্ছের কথা আমায় বহুবার শুনিয়েছেন।

একবার রেগে টেগে কইলেন,

‘আপনার কি লজ্জা-টজ্জাও করেনা? দিনরাত এই খেলুম, সেই খেলুম, হালুম-হুলুম করে না বেড়িয়ে এট্টু-আধটু পড়াশুনোও তো করতে পারেন। আপনার কত ক্লাসমেট আকাডেমিক্যালি কত ভালো জায়গায় রয়েছে। এই যহেচ্ছ না গেলার মোটিভেশন হিসেবে তাদেরকেই  ধরুণ না মশাই। নিদেনপক্ষে রোজ সন্ধেবেলা সন্তোষপুর লেকের ধারে চার চক্কর দিয়ে আসুন’।

শেষের দিকে ডাক্তারের গলাটা ক্যামন যেন করুণ আর্তির মত সোনালো। তবে ভেবে দেখলুম যে ডাক্তারের কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়। অধ্যাপক অশোক সেনগুপ্ত যখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ক্লাসে রবিনসন ক্রুশো পড়াতেন, আমি তখন লাস্ট বেঞ্চে বসে কাঠবাদামের গাছটার দিকে চেয়ে থাকতাম। ক্রুশোর কলোনিয়াল এক্সপ্ল্যানেশনের চেয়ে কাঠবাদাম যে সর্বদাই বেটার অপশন তা নিয়ে কোনোকালেই আমার সন্দেহ ছিল না।

আমার সহপাঠী অধ্যাপক অণির্বাণ ভট্টাচার্যি মশাই গায়ত্রী স্পিভাকের সাথে পেপার পড়তে স্যাম চাচার মুলুকে গেছিলেন। সেইসময় আমি কলকাতার হরেক জায়গার কাবাবের রকমফেরের তুলনামূলক আলোচনায় মগ্ন ছিলুম।মুশকিল হচ্ছে আকাদেমিক সেমিনারগুলো কাবাব কিংবা ঝাল লংকা আর শস-কাঁচা পেঁয়াজ দেওয়া এগ-চিকেন রোলের মত উমদা জিনিসের ভালোমন্দ নিয়ে হয় না। হলে তো আমি নির্ঘাৎ, তাতে অনারারি ক্রিটিকের অ্যানুয়াল প্রাইজটা পেতুম। আর কাবাব-বিরিয়ানি ছেড়ে আর কিছু পার্থিব প্রাপ্তি থাকতে পারে এরমটা ভাবতেও পারিনি কোনোদিন।

তাই এই নশ্বর জীবনে কি চাইলুম?

যৎসামান্য মাটন বিরিয়ানী আর রেওয়াজী খাসির মাংস। অভাবে কিঞ্চিৎ বড় সাইজের ইলিশ মাছ ভাজা আর সরু চালের ভাত।

কি পেলুম?

নচ্ছার হৃদয়হীন বেরসিক ডাক্তারের সুকঠিন প্রেসক্রিপশন আর ওটস চর্চিত হেলদি ডায়েটের হুমকি।

এই নিদারুণ মর্মঘাতী দিল চিরনে ওয়ালা অভিজ্ঞতার পরেও যে মনুষ্য জাতির উপরে বিশ্বাস না হারিয়ে মাঝরাতে উত্তর-আধুনিক কবিতা লিখে আপনাকে শোনাতে যাই নি, তার জন্য থ্যাঙ্কু দেবেন সার। চাইলে যাদবপুরে সুকান্ত সেতুর নিচে বাদশা’র কাউণ্টার থেকে একটা এগচিকেন রোলও কিনে খাওয়াতে পারেন, কিস্যু মাইন্ড করবো না।

কি কন কর্তা? রাস্তার ধারের দোকান থেকে চিকেন রোল কোনোদিন খান নি? আপনি সেরেফ দামী রেস্তোরার ঠান্ডি ঘরে বসে মেনুকার্ড দেখে অর্ডার দেওয়া পাবলিক? তাহলে, সিমপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, নেচারোপ্যাথি সবই নেবেন সার,  আপনার কলকাতা বাসের চোদ্দ আনাই ফাঁকি।

তামাম কলকাতা শহরটার ‘এসেন্স’ লুকিয়ে আছে তার স্ট্রীট ফুডে। এগ চিকেন রোলের ব্যখ্যানটাই শুনুন। কলেজে গুচ্ছের বক্তিমে ঝেড়ে কলেজ স্ট্রীটে কিছু কাজ সেরে বিচ্ছিরি বৃষ্টি ভেজা বিকেলে যাদবপুরে নেমে ভাবলুম যে কি খাওয়া যায়।

ইদিক উদিকে রুটি-সবজি হচ্ছে বটে কিন্তু এই অসময়ে অ্যাত্ত অস্বাস্থ্যকর খাবার-টাবার খেলে শরীর খারাপ হতে পারে তো? তাই শরীরের কথা ভেবে বাদশার কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছেয় একটা এগ-চিকেন রোলের অর্ডার দিলাম, নইলে তো আপনারা জানেনই যে আমি সেদ্ধ ওটস ছাড়া অফিসিয়ালি অন রেকর্ড কিস্যু খাইনা।

তবুও ডাক্তারের কথা ভেবে এট্টু-আধটু কিন্তু কিন্তু ভাবনা আসছিল মাথায়। শেষে গীতা না কোথায় যেন মুনি-ঋষিরা লিখে গেছেন, ‘বাসাংসি জীর্ণাণি…’ না কিছু একটা যার মোদ্দা কথাটা হল এই শরীর, সুগার-কোলেস্টরলের রিপোর্ট, ডাক্তারের দীর্ঘশ্বাস কোনোকিছুই তোমার সঙ্গে যাবে না, খাসির মাংসের ঢেঁকুর অব্দি নয়।

আর আমার মুর্শিদ কয়েছেন মনের শুদ্ধতাই আসল। মন ভালো থাকলে স-অ-ব ভালো। মন ভালো থাকলে বিয়ে বাড়িতে পাতে পোল্ট্রি মুর্গির মাংস দেখলেও মাফ করে দিতে ইচ্ছে করে (এটা অর্ধসত্য, আমার মাফ করতে ইচ্ছে করে না সার, শীতের রাতে হাত না শুকোবার অভিশাপ দেওয়ার জিঘাংসা জাগে)।

তাই, মুর্শিদের হুকুম মেনেই এগ-চিকেন রোলের অর্ডার দিলুম। কড়কড়ে পরোটার উপরে ছড়ানো হয় ফ্রায়েড চিকেন কাবাবের বড় বড় টুকরো। তার উপরে দক্ষ হাতে সাজানো হয় কুচি পেঁয়াজ, শশা আর কাঁচা লঙ্কার টুকরো। একপিস লেবুর রস দেওয়া হয় গুণমান বজায় রাখতে। এর উপরে দেওয়া হবে লোকাল ব্র্যান্ডের চিলি সস আর টমেটো সস। যে ছেলেটা রোল সাজাচ্ছে তার হাতের সুইফটনেস দেখলে আপনার ডেনিস লিলির বোলিং অ্যাকশন মনে পড়বে।

এইবার রোলটা হাতে নিয়ে মুর্শিদ কে স্বরণ করে প্রথম কামড় টা দিয়ে ফেলুন। লাচ্চা পরোটায় মাখানো কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ কুচি, সস আর চিকেন কাবাবের টুকরোর সম্মিলিত আস্বাদ আপনাকে তুরীয় অবস্থানে নিয়ে যাবে যেখান থেকে বর্ষার দিনে আমহার্স্ট স্ট্রীটে কি বেহালা যেতেও আপনার ভয় লাগবে না।

এরকমই একটা সুদিনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কাবাব রোল খাচ্ছিলাম। এমন সময় রাস্তার ধারে বস্তিতে থাকা একটি বাচ্চা এসে হাত পাতলো। রোল খেতে চাইছে। সাত-আট বছরের বাচ্চা। খালি পা। নোংরা বোতাম ছেঁড়া জামা। আরেকটা রোল দিলাম।

বাচ্চাটা গোগ্রাসে রোল খেতে শুরু করলো। আমি চুপ করে দেখছিলাম।আমার তাকানো দেখে দোকানের ছেলেটা বললো,

‘এরা রোজ খেতে পায় না দাদা। যেদিন পায়, সেদিন এভাবেই খায়’।

আমি ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিলাম। হাতে রোল টা ছিল।

কিন্তু কি জানি খুব বিস্বাদ লাগছিল মুখটা। এত বিস্বাদ রোল আগে কখনও খাইনি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *