পরিবেশকর্মী হত্যা : একটি আলেখ্য। পর্ব ১। লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0

বিশনয়গণহত্যা থেকে বালিমাফিয়াপরিবেশকর্মীহত্যা এবং ভারতবর্ষ

কর্ণাটকের কালি নদীর জল কালো। আক্ষরিকভাবে কালো। ঐতিহ্যগতভাবে কালো। কারণ ১৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কালি ইজ আ ভিক্টিম অফ অ্যান এজ-ওল্ড এক্সপ্লয়েটেশন। উত্তর কন্নড় জেলার ডান্ডেলি সংলগ্ন এই কালির ওপর ছ ছ’টি বাঁধ, যার সপ্তম প্রোজেক্টটি রূপায়নের সময় আরও তীব্র পরিবেশকর্মী অজিত নায়েকের লড়াই। ৫৭ বছরের অজিত মানেশ্বর নায়েক একজন আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট, আইনজীবী। বাঁধের পর বাঁধে ক্রমশ কর্ণাটকের আদিগঙ্গা হয়ে যাওয়া কালি নদীর ওপর পড়া স্থানীয় পেপারমিলের বিষাক্ত বর্জ্য, নদীখাতে অবৈধ স্যান্ডমাইনিং। গোটা ডান্ডেলিতে ধানক্ষেত জুড়ে ছড়ানো ছেটানো হেভি-মেটাল রেসিডিউ। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে বেশ কিছু গবাদি পশুর মৃত্যু, যাদের পাকস্থলীতে পাওয়া গেল দিস্তে দিস্তে পেপার পাল্প। এইসব, সমস্তকিছু নিয়ে লড়াই, কালি বাঁচাও আন্দোলনের প্রেসিডেন্ট অজিতের। খুব বেশিদিন টানতে পারেননি। ষাট ছোঁওয়া হয়নি। সাতান্ন পেরোচ্ছিলেন। ২০১৮, ২৭ জুলাই। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাত সাড়ে নটায় অজিতের গাড়ির ওপর অতর্কিতে আক্রমণ, ভেতরে নিথর অজিত। ‘আঙিনায় যে আছে অপেক্ষা করে তার …’। স্ত্রী, দুই পুত্রসন্তান এবং কালি নদী। অজিত মানেশ্বর নায়েক ২০১৬ সালে খুন হওয়া দেশের ১৬ জন পরিবেশকর্মীর একজন। এর ছ বছর আগে আরেক আলোচিত হত্যার শিকার গুজরাটের জুনাগড়ের পরিবেশকর্মী অমিত জেঠোয়া। গির অরণ্যের বেশ কিছু সিংহের রহস্যমৃত্যু, বারদা অভয়ারণ্যের সীমানা লাগোয়া অঞ্চলে একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরির এক্সপ্যানশন, বিপন্ন অলিভ-রিডলে কচ্ছপের ভবিষ্যৎ আরও সঙ্কটাপন্ন করে দেওয়া একটি শিপইয়ার্ড প্রোজেক্ট, ভাবনগরের জলাজমিতে এলোপাথাড়ি এনক্রোচমেন্ট, গিরের গা ঘেঁষেই কোদিনার অঞ্চলের সংরক্ষিত এলাকার ভেতর অবৈধ মাইনিং লবি, বহ্নি গ্রাসল্যান্ডে বিপন্ন চিঙ্কারা হরিণের ওপর চলা বলিউডি মেরি-মেকিং বুলেট-বুলেট খেলা – অমিতের নেতৃত্বে লাগাতার আন্দোলন এবং আরটিআই। ২০১০-এর ২০ জুলাই এক রাজনৈতিক নেতার ভাড়াটে দুই বাইক আরোহী কন্ট্রাক্ট কিলারের গুলিতে শেষ এই বছর চৌত্রিশের সদাহাস্যমুখর ক্রুসেডার।

 

কালি নদীর একাংশ (ছবিসূত্র – উইকিমিডিয়া কমন্স)

২০১৬-র গ্লোবাল উইটনেস পত্রিকার ‘ডিফেন্ডার্স অফ দ্য আর্থ’ রিপোর্টে সে বছর পরিবেশকর্মী হত্যার তালিকায় ভারতকে রাখা হয়েছিল ছ’ নম্বরে। ২০১৫ সালে ৬টি হত্যার পর ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ১৬। সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট ২০২১-এর ভিত্তিতে। ২০২০-র চারটি হত্যা ২০২১-এ বেড়ে হয়ে গেছে ১৪। এখনও স্থান ছয়েই। যদিও বার্ষিক হত্যাবৃদ্ধির নিরিখে ব্রাজিলের পরেই আছে ভারত। ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর ১৭৩৩টি হত্যার মধ্যে ভারতে সংখ্যাটি ৭৯।

ডান্ডেলির কথাটা দিয়ে শুরু হয়েছিল। পরিবেশ আন্দোলন এবং আরটিআই কর্মীদের থাকার পক্ষে ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে যাওয়া ভারতবর্ষের আরও অনেক বিপজ্জনক স্থানের মধ্যে অন্যতম এই ডান্ডেলিকে ‘ভিরুঙ্গা অফ ইন্ডিয়া’ বলা যেতে পারে? কথা বললেই চুপ করিয়ে দেওয়া! কারণ এই ডান্ডেলিতে ২০১২ সালের ৭ মে  ক্রোকোডাইল পার্কের কিছু কুমীরকে মাংস খাওয়ানোর ইচ্ছে হয়েছিল স্থানীয় পৌরসভাকর্মীর বাড়িতে আসা একটি ষোলোজনের ফান-লাভিং টিমের। অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর অফ ফরেস্ট মদন নায়েক তেড়ে আসেন। ধ্বস্তাধস্তি। ষোলো বনাম একের অসম লড়াই। মদন আঘাত নিয়ে ক্রিটিকালে চলে গিয়ে তার পরের দিন শেষ।

সাম্প্রতিকতা থেকে পিছিয়ে গিয়ে সম্ভবত প্রথম পরিবেশ শহীদের ট্র্যাজিক লেগ্যাসির গল্পটা এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন। ১৭৩০, ১১ সেপ্টেম্বর। খেজরালি ম্যাসাকার। রাজস্থানের মারোয়াড়ের মহারাজা অভয় সিং যোধপুরের জেহনাদ সহ বেশ কিছু গ্রাম নিয়ে তৈরি এস্টেটের দায়িত্বভার দিলেন ঠাকুর সুরাট সিংকে। মহারাজার নতুন প্যালেস ফুলমহল তৈরির পরিকল্পনা করা হল। তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর চুন। চুনাপাথরের জোগান ছিল, কিন্তু সমস্যা হল সেই চুনাপাথরকে পুড়িয়ে চুন তৈরি করার জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট জ্বালানির। এবং তার জন্যেই দরকার অজস্র কাঠ। অজস্র গাছ। হাত পড়ল বিশনয় কমিউনিটির ওপর। ১৪৮৫ সালে গুরু জাম্বেশ্বরের হাতে তৈরি ২৯টি নীতির ওপর ভিত্তি করে চলা প্রহ্লাদপন্থী বা বিশনয়দের লেগ্যাসি, যেখানে প্রথম ও শেষ কথা পরিবেশবাদ। নিরামিষ আহার, তালাব, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি করে বর্ষার জল সংরক্ষণ, স্থানীয় ‘ওরেন’ অর্থাৎ সামাজিক বনসৃজন, বৃক্ষচ্ছেদনে নিষেধাজ্ঞা, মাটির উর্বরাশক্তি ও জলধারণক্ষমতায় প্রচণ্ড ক্ষতি করা ইন্ডিগো প্ল্যান্টেশনে তীব্র আপত্তি থাকা এই বিশনয়দের গ্রামে সুরাট সিংয়ের আদেশপ্রাপ্ত মন্ত্রী গিরিধর ভাণ্ডারীর লেঠেল সৈন্যরা প্রথমেই এলেন জেহনাদে রামু বিশনয়ের বাড়ির সামনের অসংখ্য খেজরি গাছের প্লটে। এই খেজরি গাছ অর্থাৎ প্রোসোপিস সিনেরারিয়া ১৪৭৬ সালে খরা আক্রান্ত যোধপুরে বিশনয় কমিউনিটির ইতিহাস তৈরির ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অত্যন্ত কম জল গ্রহণ করা এবং মাটির নিউট্রিয়েন্ট-ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম বাহক এই খেজরি গাছকে চিনতে ভুল করেননি জাম্বেশ্বরের উত্তরাধিকারীরা। এখনও খেজরি গাছ তাঁদের কাছে পূজ্য। সেই খেজরির ওপর হাত পড়ায় গণহত্যার শুরু। রামুর স্ত্রী অমৃতা দেবী বিশনয় এবং তাঁর তিন মেয়ে আসু, রত্নী এবং ভাগু পরপর গাছ জড়িয়ে ধরলেন। অমৃতা বলেছিলেন – ‘সির সান্থে রুখারে তো ভি সস্তো জান …’ – যার অর্থ – ‘কাটা মাথা কাটা গাছের চেয়ে অনেক সস্তা’। লেঠেলধারীদের ঘুষের লোভ, শারীরিক বলপ্রয়োগ এবং শেষমেশ কুঠার। অমৃতা এবং তিন কন্যাসন্তানের মাথা আলাদা হয়ে গেছিল। খবর পেয়ে আশেপাশের ৮৩টি গ্রাম থেকে এলেন আরও অজস্র বিশনয়। জড়িয়ে ধরলেন এক একটি করে গাছ। পরিণতি একই। মোট ৩৬৩টি মাথা, শরীর, আলাদা। এই বীভৎস ব্লাডবাথের খবর চলে গেছিল মহারাজা অভয় সিংয়ের কাছে। শোনা যায়, অভয় নিজে এসে ক্ষমা চান, কোনওদিন বিশনয় এবং তাঁদের খেজরি গাছের লেগ্যাসিকে ছোঁবেন না বলে শপথ নেন। সেই জেহনাদ পরে এই ঘটনার স্মরণে নাম পায় ‘খেজরালি’, ৩৬৩ জন স্মারকস্তম্ভ হয়ে থেকে যান। ভাদ্রের শুক্লা দশমীর রাতে অমৃতা দেবীর গ্রামে মেলা বসে। বর্তমান মনে করে অতীতকে। ২০১৩ থেকে এই ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় অরণ্য শহীদ দিবস হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। পরিবেশ আন্দোলনে, পরিবেশ হত্যার ক্রনোলজিতে এই বিশনয় স্রেফ এক গণহত্যা না, এপিক। চিপকো এবং আপিকো আন্দোলনসহ যেকোনও ‘বৃক্ষ জড়িয়ে ধরো’ ভাবনার শেকড় …

খেজরালি গ্রামে ৩৬৩ জন বিশনয়ের নামে স্মৃতিস্তম্ভ (ছবিসূত্র – উইকিমিডিয়া কমন্স)

 

শেকড় থেকে জমি অধিকার। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে ল্যান্ড রাইটস মুভমেন্ট গায়ে লেগে আছে। অরণ্যের অধিকার রক্ষা, অরণ্য বাঁচাও আন্দোলন। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়ের ডোংরিয়া কোন্ধ আদিবাসীর লড়াইকে সেক্টারিয়ান বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় এলোপাথারি আক্রমণ চলছে। যেমন, ২০১৬-র ২৭ ফেব্রুয়ারি ফেক এনকাউন্টারে নিয়মগিরির অবৈধ জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গলা ফাটানো মান্ডা কাটরাকার হত্যা। মান্ডা স্থানীয় কিছু ছেলেদের নিয়ে সালাপ বা ক্যারিওটা ইউরেন্স গাছ থেকে ট্রাডিশনাল পানীয় সালাপ রস সংগ্রহ করতে গেছিলেন। প্রাপ্য ছিল বুলেট। ওড়িশারই গাঞ্জাম জেলার কুমারবন্ধ গ্রামের সওরা কমিউনিটিদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অরণ্য অধিকার নিয়ে সোচ্চার আদিবাসী আন্দোলনকর্মী আদাঙ্গু গোমাঙ্গো ছিলেন বামপন্থী অল ইন্ডিয়া কিষান মজদুর সভা এবং লোক-সংগ্রাম মঞ্চের নেতা। ২০১৬-র ২৩ মে পঞ্চান্ন বছর বয়সী নিরস্ত্র এই নেতাকে তাঁর বাড়ির বারান্দায় ঘুমের মধ্যে শেষ করে দেওয়া হয়। অথবা ২০১৬-র ২৯ আগস্ট। ঝাড়খণ্ডের রামগড়ের গোলা অঞ্চলে গোলা পাওয়ারপ্ল্যান্ট তৈরিতে ইনল্যান্ড পাওয়ার লিমিটেডের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে প্ল্যান্টের মালিকের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছিল হাজার তিনেক স্থানীয় মানুষ। মালিকপক্ষ সামনে এলো না। হতাশ, ক্রুদ্ধ জনতাকে সামলাতে পুলিশি গুলি। নিহত দশরথ নায়েক এবং টুডু মাহাতো। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে হাজারিবাগের কাছে বাড়কাগাঁওয়ে এনটিপিসির মাইনিং এবং তার জন্য জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘ বিবাদ, ‘কফন সত্যাগ্রহ’, স্থানীয় নেতৃত্বের গ্রেপ্তার, এবং সেখান থেকে পুলিশ-আন্দোলনকারীর হিংস্র কনফ্রন্ট। জখম দুপক্ষের ভেতর শেষমেশ নিহতের তালিকায় নাম চার গ্রামবাসীর, আন্দোলনকারীর। অথবা খুব টাটকা ২০১৮-র কুখ্যাত স্টারলাইট কপার স্মেল্টিং ইন্ডাস্ট্রি এবং তার লাগাতার পরিবেশখাদক চেহারা। ১৯৯৭-এর সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাস লিক, এবং সেখান থেকে একশ’র কাছাকাছি মানুষের হসপিটাল অ্যাডমিশন। ২০১৩-র প্রায় ৮৪টি গ্যাস লিকের ঘটনা। এবং ২০১৮। সেই স্টারলাইট নিজেদের ক্ষমতা বছরে ৪ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ টন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রবল প্রতিবাদ তুতিকোরিনের রাস্তায়। পুলিশি ফায়ারিং। ২২ থেকে ২৩ মের মধ্যে ১৪টি হত্যা, যার অধিকাংশই মাথার গুলি, পেছন থেকে বীভৎস পুলিশি বারবারিজম।

২০২২-এর এপ্রিলে ‘দ্য সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপল’-এর রিপোর্টে ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত অবৈধ মাইনিং আটকাতে পুলিশ ও পরিবেশকর্মী হত্যার পাশাপাশি স্যান্ড-মাইনিং সংক্রান্ত ওপেন পিটজনিত কারণে দুর্ঘটনা, মাইনিংরত শ্রমিকদের ডুবে যাওয়া – এইসমস্ত কারণ মিলিয়ে স্যান্ড-মাইনিং জড়িত কারণে সামগ্রিক নিহতের সংখ্যা ৪১৮, যার ভেতর ৯৫টি মৃত্যু উত্তর ভারতে। মধ্য ও পশ্চিম ভারতে ৪৫ এবং পূর্বভারত ও দক্ষিণ ভারতে সংখ্যাটি যথাক্রমে ৪১ ও ১৫। হিসেব করে দেখা গেছে, গোটা পৃথিবীতে বছরে ৫০ বিলিয়ন টন বালি উত্তোলন করা হয় নদীগর্ভ থেকে, যা দিয়ে একটা ২৭ মিটার উঁচু ও ২৭ মিটার চওড়া প্রাচীর তৈরি করা যেতে পারে। পরিবেশবিদ সুমেইরা আব্দুলালির মতে, গোটা দেশে কোথাও বালি-উত্তোলনের কোনও নির্ভরযোগ্য এবং নিরপেক্ষ রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে না। যার ফলে – ‘উই আর মুভিং ইন ডার্কনেস, উই ডোন্ট ইভেন আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট দ্য ইমপ্লিকেশন্স অফ রিভার স্যান্ড মাইনিং আর’। এবং ভয়ঙ্কর এটাই, যে অতিমারী পরবর্তী সময়ে বেকারত্বের অজুহাতে, অর্থনীতি চাঙ্গা করার ছুতোয় এই স্যান্ড-মাইনিং হুহু করে বেড়ে গেছে। বাঁধের পর বাঁধ এই স্যান্ড-মাইনিং-এ চলে যাওয়া বালি প্রতিস্থাপন করতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মোহনাসংলগ্ন এলাকাগুলিতে এই বালি উত্তোলনে নদীঘাত গভীর হয়ে হুহু করে ঢুকছে লবনাক্ত জল। বালিস্থিত অণুজীব কমে গিয়ে মাটির স্বাস্থ্যের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াচ্ছে সবকিছু। এবং সবচেয়ে বড় কথা নদীর স্বাভাবিক গতির হেরফের ঘটছে হামেশাই। শেষ হয়ে যাচ্ছে বিপন্ন ঘড়িয়াল, কচ্ছপ। সুমেইরাদের এইসমস্ত আন্দোলনে পরিবেশকর্মী থেকে পুলিশ আধিকারিক যত্রতত্র মাফিয়া-শিকার হচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের কিহিমের বালি উত্তোলন আটকাতে গিয়ে ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে দুবার প্রায়-প্রাণঘাতী হামলা হয় সুমেইরার ওপরে। দ্বিতীয় আক্রমনের আগেই পরিবেশকর্মীদের ওপর লাগাতার আক্রমণের জন্য সুমেইরার নেতৃত্বে একজোট হয়ে কাজ করা শুরু করেছিল তাঁর হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠান ‘মিত্রা’ (মুভমেন্ট এগেইন্সট ইন্টিমিডেশন, থ্রেট, রিভেঞ্জ এগেইন্সট অ্যাক্টিভিস্টস)।

 

স্যান্ড-মাইনিং বিষয়ে তথ্যচিত্রে সুমেইরা আব্দুলালি (ছবির মাঝে, সূত্র – ভারত সংবাদ অনলাইন)

এবং এই বালি-মাফিয়াতন্ত্র গত দশ বছরের অধিকাংশ পরিবেশকর্মীহত্যা ও হত্যাপ্রচেষ্টার নেপথ্য-ভিলেন। প্রসঙ্গত, শুরুতেই অজিত নায়েককে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তার চারবছর পর আরেক ভিক্টিম বছর চল্লিশের আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট রঞ্জন কুমার দাসের কথা বলা হয়নি। ওড়িশার তালাসাঙ্গা অঞ্চলের ‘জন সূচনা অধিকার অভিযান’-এর নেতৃত্ব দেওয়া রঞ্জন এলাকার স্যান্ড-মাইনিং, অবৈধ ইট ভাটা, ভিতরকণিকা ন্যাশনাল পার্কের কোর এরিয়ায় রাজ্য সরকারি মদতে নির্মিত অবৈধ রেসর্ট, ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্টের খাতে দেওয়া অর্থে ম্যানগ্রোভ লাগানোর প্রোজেক্টে একটি বেসরকারি সংস্থার উপর আর্থিক তছরুপের অভিযোগ – এইসমস্ত নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। ২০২০-র ৩১ জানুয়ারি স্তব্ধ করে দেওয়া হয় তাঁর মুখ। চল্লিশ ছুঁচ্ছিলেন রঞ্জন। বলা হয়নি নয়ডার রাইপুর অঞ্চলের বছর বাহান্নর পালে রাম চৌহানের কথা। যমুনা তীর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বালিমাফিয়াদের বিরুদ্ধে সোচ্চার পালেরাম শহরে শীত ঢোকার ঠিক আগে ২০১৩-র সেপ্টেম্বরের শেষে ঘরে খাটিয়া পেতে শুয়েছিলেন। বাইরের আকাশে তারা ছিল না। ছিল বাইকের শব্দ, তিন আততায়ী এবং বুলেট। বালি, পাথর – অবৈধ মাইনিং-এর পরিচিত ছবি এবং সেই প্রসঙ্গেই আক্রান্ত বহু বনকর্মী, পুলিশ। ২০১২-য় ডান্ডেলির বনকর্মী মদন নায়েকের কথা বলেছি। বলিনি আরও অনেকের কথা। ২০১২-র মার্চে মধ্যপ্রদেশের চম্বলের মোরেনা অঞ্চলের কুখ্যাত বানমুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনে অবৈধ স্টোন মাইনিং রুখতে স্টোন বোল্ডার ভর্তি ট্র্যাক্টর ট্রলি চালিয়ে দেওয়া হয় বছর তিরিশের তরুণ আইপিএস অফিসার নরেন্দ্র কুমারের শরীরের ওপরে। স্ত্রী আইএএস অফিসার, গোয়ালিয়রের অ্যাডিশনাল কালেক্টর মাধুরানী তখন সন্তানসম্ভবা। সন্তান দেখতে পেল না সে কোন অসমসাহসীর ঔরসে এলো। তিন বছর পর ২০১৫-র এপ্রিলে এই কুখ্যাত মোরেনাতেই অবৈধ বালি বোঝাই ট্রাক্টর আটকাতে প্রায় একইভাবে চলে যান আরেক কন্সটেবল বছর আটত্রিশের ধর্মেন্দ্র সিং চৌহান। ২০১৬-র মার্চে শিকার আরেক নরেন্দ্র, নরেন্দ্র কুমার শর্মা। গোয়ালিয়র থেকে আট কিলোমিটার দূরে রাইরু অঞ্চলের সুশেরা কোঠি স্কোয়ার এরিয়ায় স্পেশাল আর্মড ফোর্স ভর্তি টিম নিয়েও অবৈধ বালিভর্তি ট্রাক তাড়া করতে গিয়ে খুন হন ফরেস্ট গার্ড নরেন্দ্র। তামিলনাডুর বেশ কিছু নদীখাতে যথেচ্ছ স্যান্ড মাইনিং এবং তার বলি ২০০০ সালে কান্নালুর অঞ্চলের কর্মী ধাস, ২০১২ সালে মিত্তাধারকুলামের কুমার, ২০১৪ সালে কোঙ্গারায়াকুরিচি অঞ্চলের স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবসহায়ম, ২০১৭ সালে কারুঙ্গুলাম অঞ্চলের চেলাপ্পা এবং ২০১৮ সালে পেরুঙ্গুলম অঞ্চলের বিয়াগাপ্পান ও সেইবছরই নাম্বিয়ার নদী উপত্যকায় নৃশংস খুন হওয়া বছর তেত্রিশের ঝকঝকে তরুণ স্পেশাল পুলিশ কন্সটেবল জগদীশ দুরাই।

চম্বল নদীর ধারে বিপন্ন ঘড়িয়াল এবং যথেচ্ছ স্যান্ড-মাইনিং (ছবিসূত্র – ইন্ডিয়া টুডে)

 

শেষ কোথায়? এ লেখা যখন শেষ করছি, তখনই, ২০২৩-এর নভেম্বরের শেষ রাতে বিহারের গন্ডক, শোন, গঙ্গা, কোশী নদী উপত্যকায় বালি-মাফিয়া রাজত্ব এবং একাধিক পরিবেশকর্মী হত্যার কথা পড়ছি। পড়ছি তামিলনাডুর মুরাপ্পানাডুর আগারাম গ্রামের থামিরাবারানি নদী উপত্যকার বালিমাফিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় লাগাতার হত্যার হুমকি শুনে চলা কৃষক বালাকৃষ্ণন। মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চের আদেশে পুলিশি প্রোটেকশন নিয়ে মাঠে গরু চড়াতে যেতে হয় বালাকৃষ্ণনকে। তাও কতদিন? পালেরাম চৌহানের ছেলে যুবক আকাশ চৌহান বীভৎস ঝুঁকি নিয়ে ২০১৭ সালে ব্রনওয়েন রিড ও সাবিত্রী চৌধুরী পরিচালিত ‘লাইন ইন দ্য স্যান্ড’ তথ্যচিত্রে অস্ট্রেলীয় ক্যামেরাকে দেখিয়ে দেন পিতার ঘর, স্মৃতিতে আনেন ব্লাডশট, দেহ শনাক্তকরণের করুণতম মুহূর্ত। বাইটে আকাশ মুখ আবছা করে দিতে বারণ করেন। ভয় করে না? আকাশ তথ্যচিত্র-নির্মাতার চোখে চোখ রেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলেন – ‘নো, আই অ্যাম ফাইটিং ফর মাই ফাদার …’। নিয়ার-ফেটাল উদাহরণও কম কিছু? ম্যানগ্রোভ সার্ভে করার সময়ে মুম্বইয়ের কন্দর্প-দহিসার জমি মাফিয়াদের হাতে কনজারভেশন অ্যাকশন ট্রাস্টের কর্মী দেবী গোয়েঙ্কা ও তাঁর সহকর্মীদের ওপর হামলা, পাউরি-গাড়োয়ালে অবৈধ টিম্বার মাইনিংয়ের প্রতিবাদ করায় শিশুসন্তানসহ দম্পতি কবিতা ও শিব প্রসাদের ওপর আক্রমণ ও ক্রমাগত শাসানি, গুজরাটের বাপিতে ইউনাইটেড ফসফরাসের প্রস্তাবিত কীটনাশক কারখানার ওপর স্টোরি করার প্রতিবাদে সাংবাদিক বিট্টু সেহগাল, রামোজি রাও ও শৈলেন্দ্র যশোয়ান্তের ওপর আইনি নির্যাতন, কুদ্রেমুখ ন্যাশনাল পার্কের অবৈধ মাইনিং নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পরিবেশবিদ বিজ্ঞানী ডক্টর উল্লাশ করন্থের দিকে ছোড়া লাগাতার অপপ্রচার – হত্যা, নির্যাতন চলছেই। এবং মহারাষ্ট্রের কিহিমে নিজের গ্রামের ক্ষয়ে যাওয়া বালির স্তূপের এককালীন স্মৃতি-মুহূর্ত ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক সুমেইরা আব্দুলালি বলছেন – ‘উই আর মুভিং ইনটু ডার্কনেস, উই আর মুভিং ইনটু ডার্কনেস, উই আর মুভিং ইনটু …’

 

 

 

ঋণস্বীকার

১. Bindra, Prerna Singh. Frontline of a New War: Environmentalists Under Threat. Conservation India. August 2, 2010.

২. Decade of Defiance. Global Witness. September 29, 2022.

৩. Defenders of the Earth. Global Witness. July 13, 2017.

৪. India Fourth Deadliest Country for Environmental Activists, Says Report. The Wire. July 14, 2017.

৫. Hemalatha, Karthikeyan. Murder of activist in India highlights growing risk to environmental defenders. Mongabay. August 16, 2018.

৬. Kumar, Naveen. Sand Mining in India – Grain of Despair: Failure of Regulatory Machinery. SCC Online Blog. February 8, 2023.

৭ Natesh, Dr. S. When Amrita Devi and 362 Bishnois sacrificed their lives for the Khejri tree. Sahapedia. September 15, 2020.

৮ Shalinee Kumari. New platform unites tech and activism to monitor sand mining in India. The Third Pole. August 9, 2023.

৯. Singhai, Arshika. Sumaira Abdulali: An environment activist who survived two deadly attacks and turned a non-issue like sand mining into a global one. Bharatsamvaad. October 15, 2022.

১০. Sudhakar, P. With police, politicians in cahoots illegal sand mining gets money and murder. The Hindu. April 27, 2023.

১১. 2022: Riverbed Mining Destroying Indian River Eco-system & Freshwater Species. South Asia Network on Dams, Rivers and People. January 20, 2023.

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *