ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : চব্বিশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
অ্যান্টিগুয়ার চতুর্থ টেস্ট ও ড্র হয়। কার্ল হুপার (অপরাজিত ১৭৮) আর শেষ ব্যাটার কোর্টনি ওয়ালস (৩০) শেষ উইকেটে ১০৬ রান যোগ না করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪৩৮ তুলতে পারতো না। ওয়াকার ইউনিস ৫ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিপর্যস্ত করেন। পাকিস্তানও ৩২৬ এর বেশী তুলতে পারেনি। ইনজামাম ১২৩ না করলে বেকায়দায় পড়তো নির্ঘাৎ।
এরপর শারজায় পেপসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলায় তাঁরা কেবলমাত্র লীগের একটি ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়। বাকি সব ম্যাচেই জিতে যায়। এমনকি ফাইনালও।
এরপরেই আসে ভারতের মাটিতে সিএবি সিলভার জুবিলী টুর্নামেন্ট। এই টুর্নামেন্টের কথা আগেও অনেকবার বলা হয়েছে। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফলাফল হলো তাঁরা প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারায়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হেরে যায়; মাত্র ১৩৯ রানে অল আউট। ভারতকে (১০০) লীগের খেলায় চূড়ান্ত একপেশে ভাবে হারায়। জিম্বাবুয়েকে (৯৯) অতি সহজেই হারায়। সেমি ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারায়। কিন্তু ইডেনের দিন রাত্রির খেলায় ঐতিহাসিক ফাইনালে ভারতের কাছে ১০২ রানে পরাজিত হয়। কুম্বলে ১২ রানে ৬ উইকেট নেন।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে একমাত্র টেস্ট ড্র হলেও ওয়ানডে সিরিজ ২-০ ম্যাচে জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপরেই আসে ঐতিহাসিক ইংল্যাণ্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘরের মাঠে সাম্প্রতিক রেকর্ড রক্ষা করে; আগের চোদ্দটি হোম সিরিজের মধ্যে দুটি ড্র এবং বারোটি জিতেছিল, এবারেও জিতলো। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন রিচি রিচার্ডসন, যিনি সিরিজের আগে অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি এবং স্ট্রাইক বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস এবং কোর্টনি ওয়ালশকে আগের বারো মাসে খেলতে হয়েছে। প্রবীণ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ধারাভাষ্যকার টনি কোজিয়ার ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় উল্লেখ করেন যে বিকল্প বোলাররা “ইংল্যান্ড কে খুব বেশি ঝামেলায় ফেলতে পারবে না।
শেষে দেখা গেল, উইনস্টন বেঞ্জামিন এবং কেনেথ বেঞ্জামিন উভয়ই সিরিজ জুড়ে চমৎকার খেলেছে, যথাক্রমে ১২ এবং ২২ উইকেট নিয়েছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজ ৩-১ ব্যবধানে জিতেছে।
ইংল্যান্ড প্রথম চারটি টেস্টের সবকটিতেই ভালো লড়েছিল, কিন্তু শেষ অবধি পারেনি, যদিও গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের সাথে লড়াই করেছে।
এরমধ্যে যে টেস্ট ম্যাচ হারে সেটি ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ এর মধ্যে দেশের মাটিতে খেলা ৫১ টি টেস্টের মধ্যে ছিল পঞ্চম পরাজয়। যার মধ্যে শেষ ২৪টি টেস্টে এটি পঞ্চম। এটাই ছিল শেষ জয়ী সিরিজ।
ভারতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসে সিরিজ খেলতে। ১৭ অক্টোবর প্রথম ওডিআই খেলায় ভারতকে ৪৬ রানে হারিয়ে দেয়। বোম্বের দ্বিতীয় ওডিআই খেলায় ভারত ৬ উইকেটে জয়ী হয়। এরপর শুরু হয় উইলস ওয়ার্ল্ড সিরিজের খেলা। চার উইকেটে জয়ী হয় ভারত। কিন্তু মারগাও এর নেহরু স্টেডিয়ামে নিউজিল্যান্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১২৩ রানে অল করিয়ে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। জবাবে ১ উইকেটে ২৫ রানে করার পর বৃষ্টির জন্য ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়।
কানপুরের ওডিআই খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৬ উইকেটে ২৫৭ তোলে। জবাবে গুরুত্বপূর্ন সময়ে প্রভাকর (১৫২ বলে অপরাজিত ১০২) ও নয়ন মোঙ্গিয়া (২১ বলে অপরাজিত ৪) ধীমা ব্যাট করে ম্যাচ একপ্রকার ভারতকে হারিয়ে দেয়। তাছাড়া কিপিং করার সময়েও প্রায় অসম্ভব সব কান্ড করেন। কাম্বলি, জাদেজা ও সিধু প্রভাকরের ভুলে রান আউট হন।
পরের ম্যাচে হুপারের ১১১ আর লারার ৬৯ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩০৬/৬ অবধি পৌঁছিয়ে দেয়। এরপর রাজেন্দ্র ধনরাজ ২৬ রানে ৪ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ড (১৭১/৯) কে হারিয়ে দেন।
এরপর ফাইনালে ইডেনে ভারত ২৭৪/৬ তোলে। জাদেজা ৫৪, শচীন ৬৬ ও কাম্বলী ৫৮ অপরাজিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০২ রানে অল আউট।
এরপরে আবার ওডিআই সিরিজ। তৃতীয় ম্যাচে বিশাখাপত্তনমে সিধুর সেঞ্চুরী সত্বেও ভারত (২৬০/৪) জিতলো চার রানে। হুপার ৪৭ বলে ৭৪ করেও জেতাতে পারেননি। চতুর্থ ম্যাচে বারবাটি স্টেডিয়ামে জাদেজার শতরানের জন্য ২৫১/৯ তাড়া করে জিতে নেয় ভারত (২৫৬/২)। জয়পুরের সওয়াই মান সিং স্টেডিয়ামে শচীনের শতরানের জন্য ভারত ২৫৯/৫ তোলে। যদিও জেতে ৫ রানে। রাজু ৪৬ রানে ৪ উইকেট নেন।
এরপর টেস্ট সিরিজ শুরু হয়। প্রথম টেস্ট বোম্বের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ওয়ালস ৭৯ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ভারতকে ২৭২ এ আটকে দেয়। কামিন্স তিন উইকেট নেন। ৯৯ রানে ৫ উইকেট থেকে ২৩৫ এ টেনে নিয়ে যায় সঞ্জয় মঞ্জেরেমার (৫১) ও মোঙ্গিয়া (৮০)। এরপর রাজু (৫/৬০) ও কুম্বলে (৩/৪৮) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৪৩ রানে আটকায়। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার সমস্যায় ভারত। ৮৮/৫ থেকে শচীন ও সঞ্জয় টেনে নিয়ে যান ১৬২ রানে। শচীন ৮৫ রানে আউট হন। কুম্বলে (৪২) ও সঞ্জয় ২৩৭ অবধি টাবেন। এরপর শ্রীনাথ (৬০) ও সঞ্জয় (৬৬) ২৬৫ অবধি নিয়ে যান। রাজেশ চৌহান (৪) ৩০৯ রানে। অবশেষে ভারত ৩৩৩ তোলে। এরপর শ্রীনাথ (৪/৪৮) ও রাজু (৩/৮৫) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৬৬ রানে ফেলে দিয়ে ভারতকে জিতিয়ে দেয় ৯৬ রানে।
নাগপুরের দ্বিতীয় টেস্টে ভারত ৫৪৬/৯ তোলে। শচীন ১৭৯, সিধু ১০৭, কুম্বলে ৫২, মোঙ্গিয়া ৪৪। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯৮/৩ থেকে ৪২৮ করে। জিমি অ্যাডামস ১২৫, হুপার ৮১, লারা ৫০, সিমন্স ৫০ আর মারে ৫৪ করেন। রাজু ৫ টা ও কুম্বলে ৩ উইকেট নেন। এরপর সিধু ৭৬ ও শচীন ৫৪ করলে ভারত ২০৮/৭ তোলে। ভারত ২২ রানে ৩ উইকেট তুলে নিলেও হুপার ৬৭ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৩২/৫ এ পৌঁছিয়ে ম্যাচ ড্র করায়।
মোহালির শেষ টেস্টে অ্যাডামসের ১৭৯ অপরাজিত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৪৪৩ অবধি টেনে নিয়ে যায়। কুম্বলে ৪ টে ও রাজু ৩টি উইকেট পান। জবাবে ভারত ৩৮৭ তোলে। শ্রীনাথ করেন ৫৪। প্রভাকর ১২০। এরপর ৩০১/৩ করে ডিক্লেয়ার্ড দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লারা ৯১, অ্যাডামস ৭৮ ও আর্থারটন ৭০ করেন। জবাবে ভারত ১১৪ রানে অল আউট হয়ে টেস্ট হারে। কেনেথ বেঞ্জামিন ৫ উইকেট নেন।
এর পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যায় নিউজিল্যান্ড সফরে। প্রথমে নিউজিল্যান্ডকে পরপর তিনটি ওডিআই ম্যাচে অনায়াসে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ওডিআই সিরিজের পরে ১৯৯৫ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটি টেস্ট খেলে। প্রথম টেস্টে ড্র করলেও দ্বিতীয় টেস্টে লারা, অ্যাডামস আর জুনিয়র মারের শতরান এবং কোর্টনি ওয়ালসের ম্যাচে ৫৫ রানে ১৩ উইকেট তাঁদের জিতিয়ে দেয়।
এরপরে অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়।
১৯৯৫ এর মার্চ মাসে ওডিআই সিরিজ খেলা হয় । কেনিংটন ওভালের প্রথম ম্যাচে হাড্ডাহাডডি লড়াই হয়। অস্ট্রেলিয়া ৬ রানে হেরে যায়। বুন (৮৫ বলে ৮৫ অপরাজিত) প্রচুর চেষ্টা করেও জেতাতে পারেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হুপার (৮৪) ও লারা (৫৫) ভালো ব্যাট করেন। পোর্ট অফ স্পেনে অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারলো লারার ৬২ সত্বেও। একই মাঠে তৃতীয় ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চরম বদলা নিলো। লারা করলেন ১৩৯। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮২/৫। অস্ট্রেলিয়া দাঁড়াতেই পারলো না। ফিল সিমন্সের বোলিং (৪/১৮) তাদের ১৪৯ রানেই ফেলে দিলো। চতুর্থ ম্যাচে সিমন্স (৮৬) ব্যাট হাতে ও কার্ল হুপার (অপরাজিত ৬৫) ম্যাচ জিতিয়ে দেন। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া প্রচুর রান করে (২৮৬/৯)। মার্ক ওয়া ৭০ এবং মার্ক টেলর ৬৬ করেন। জবাবে বেধড়ক পিটিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪৭.২ ওভারে ৫ উইকেটে ২৮৭ তুলে ফেলে। সিমন্স ৭০, হুপার ৫০ ও অ্যাডামস অপরাজিত ৬০ করেন। সিরিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪-১ এ জিতে নেন।
এরপরে শুরু হয় টেস্ট ম্যাচ। কেনিংটন ওভালের প্রথম টেস্টে অহেতুক দ্রুত গতিতে ব্যাট করতে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ৪৮.১ ওভারে ১৯৫ করে। তারই মধ্যে ৩২টা চার মারে। লারা ৬৫ ও হুপার ৬০ করেন। ৬ রানে ৩ উইকেট থেকে একসময় ১৩০/৩ ওঠে। তারপরেও ১৯৫ এর বেশি ওঠেনি। ব্রেন্ডন জুলিয়েন ৩৬ রানে ৪ উইকেট নেন। গ্লেন ম্যাকগ্রা নেন ৪৬ রানে ৩ উইকেট।
জবাবে অস্ট্রেলিয়া তোলে ৩৪৬। টেলর ৫৫, স্টিভ ওয় ৬৫ আর হিলি অপরাজিত ৭৪ করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাকগ্রা (৫/৬৮) আর শেন ওয়ার্ন (৩/৬৪) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৮৯ রানে আউট করে দেন। জবাবে অস্ট্রেলিয়া বিনা উইকেটে ৩৯ তুলে টেস্ট জিতে নেয়।
অ্যান্টিগুয়ার দ্বিতীয় টেস্টে ওয়ালস (৬/৫৪) অস্ট্রেলিয়াকে ২১৬ রানে আটকে রাখে। কিন্তু লারার ৮৮ ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেউ দাঁড়াতে পারেননি। ফলে তারা ২৬০ রানে অল আউট। বৃষ্টি বিঘ্নিত এই টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ৩০০/৭ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। বুন (৬৭), মার্ক ওয় (৬১) ও মার্ক ওয় (অপরাজিত ৬৫) করেন। বাকি সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮০/২ তোলে। ম্যাচ ড্র।
পোর্ট অফ স্পেনে এইরকম পিচ তখন তো বটেই আগেও ভাবা যেত না। অস্ট্রেলিয়া ১২৮ রানে শেষ। সৌজন্যে ওয়ালস (৩/৫০) ও অ্যামব্রোজ (৫/৪৫)। জবাবে ম্যাকগ্রা (৬/৪৭) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৩৬ এ ফেলে দেয়। এরপর অ্যামব্রোজ (৪/২০), ওয়ালস (৩/৩৫), এবং কেনেথ বেঞ্জামিন (৩/৩২) অস্ট্রেলিয়াকে ১০৬ রানে ফেলে দিলে আর কিছুই করার ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ উইকেটে ৯৮ করে জিতে যায়।
সাবিনা পার্কের শেষ টেস্ট। অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন ১০০ করলেও রাইফেলের বোলিং (৩/৪৮) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৬৫ রানে আটকে দেয়। জবাবে চতুর্থ উইকেটে ২৩১ রান যোগ করেন মার্ক ওয় (১২৬) ও স্টিভ ওয় (২০০)। অস্ট্রেলিয়া তোলে ৫৩১। এরপর রাইফেল (৪/৪৭) ও ওয়ার্ন (৪/৭০) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২১৩ রানে আটকে দেয়। অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ও ৫৩ রানে জিতে সিরিজ ২-১ এ জিতে নেয়।
এই ঘটনার ফলে দেশের মাটিতে টানা ১৫ সিরিজ জয় এর পর থমকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের দৌড়।
সেই ছিল সূত্রপাত। এরপর শুরু হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফেলে যাওয়া জুতোয় পা গলানোর লড়াই। এই লড়াই ওডিআই খেলায় ১৯৮৩ থেকেই শুরু হয়েছিলো।
(ক্রমশ)