অপসৃয়মান লোকসঙ্গীত ধারা ‘বালিকা সঙ্গীত’ | লিখছেন রামামৃত সিংহ মহাপাত্র
লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লোকসংগীত।লোকসংগীতের মাধ্যমেই সমকালীন সমাজ সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে ধরা পড়ে। ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্বে’ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন “ভাষা সাহিত্য,জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে সংস্কৃতি প্রতিফলিত তাহার পশ্চাতে সচেতন বুদ্ধির ক্রিয়া প্রত্যক্ষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু যেখানে বুদ্ধির লীলা সক্রিয় থাকিলেও অপ্রত্যক্ষ, কিংবা বুদ্ধিই যেখানে একমাত্র নিয়ামক নয় সংস্কৃতির সেই প্রকাশ ধরা পড়ে চারু কলায় ও সংগীতে। এ বিষয়ে ভাষা-সাহিত্য ও জ্ঞান–বিজ্ঞান অপেক্ষা চারুকলা ও সংগীতের আবেদন একদিকে যেমন সূক্ষ্মতর,অন্যদিকে তেমনি প্রত্যক্ষতর এবং পরিধি হিসাবে বিস্তৃততর।
তাই লোকসংস্কৃতির অন্যান্য বিষয় গুলির তুলনায় লোকসংগীতের প্রসার ঘটেছিল সর্বাপেক্ষা বেশি।এই লোকসংগীত গুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রচিত হয়েছিল সমাজের দরিদ্র ও নিরক্ষর শ্রেণীর লোকেদের দ্বারা। ফলত এই গান গুলির মাধ্যমে উঠে এসেছিল সমাজের খেটে খাওয়া মানুষদের দুঃখ কষ্টের কথা। এই গান গুলির ভাষা ছিল সমাজে প্রচলিত কথ্য ভাষা। অর্থাৎ এই গান গুলির শিকড় সমাজ সভ্যতার আদিতে প্রোথিত থাকলেও বিস্তার ঘটেছিল সমসাময়িক সময় পর্যন্ত। তাই সহজেই গ্রহণীয় হয়ে ছিল এই গান গুলি। R.V.Williams তাঁর ‘Folksong Encyclopedia Britanica’(14 th Edition, 1932) গ্রন্থে বলেছেন “A folksong is neither new nor old; it is like a forest tree with roots deeply buried in the past, but which continuously pulls forth new branches, new leave, new fruit….”. এই লোকসংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় ধারা হল কীর্তন।
কীর্তন
কীর্তন শব্দটি এসেছে ‘কৃত’ ধাতু থেকে।যার অর্থ প্রশংসা বা গুণ বর্ণনা। দশম-একাদশ শতকে চর্যাগীতিতে সমবেত রূপে গাওয়ার রীতি থাকলেও সর্বসাধারণের মধ্যে ভক্তি প্রচার করে কীর্তন গান প্রথম শ্রী চৈতন্যদেবই করেন। কীর্তন মূলত দুই প্রকার- নামকীর্তন ও লীলাকীর্তন। নামকীর্তনে ভগবান শ্রী হরির নাম ও তাঁর অশেষ করুণার কথা গীত হয়। অন্যদিকে লীলাকীর্তনে শ্রীকৃষ্ণের রূপ, গুণ, মহিমা ও তাঁর বিবিধ মনোহারী লীলার কথা বর্ণিত হয়। মূলত রাধা-কৃষ্ণ এবং গোপী ও শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী নিয়ে যে পালা গান গীত হয় তা লীলাকীর্তন। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যদেবকে নিয়েও লীলাকীর্তন রচিত হয়েছে। লীলাকীর্তনের উল্লেখযোগ্য পালা গুলি হল – গোষ্ঠ, মান, মাথুর, নৌকাবিলাস, নিমাই সন্ন্যাস, রাস ইত্যাদি। কীর্তনকে নাটকীয় ও আকর্ষণীয় করার বাসনা থেকেই সৃষ্টি বালিকা সঙ্গীত ।
বালিকা সঙ্গীত
লীলাকীর্তনের একটি বিশেষ ঘরানা ঝাড়খণ্ডী। ঝুমুর গানের যে সুর তার সাথে কীর্তনের সুর মিশিয়ে এই ঘরানার সৃষ্টি। বালিকা সংগীত গাওয়া হয় কীর্তনের এই ধারাতেই। কীর্তনের সাথে সমানে পাল্লা দেওয়া এই সংগীত ধারার সাথে কীর্তনের মূল পার্থক্য কীর্তন গাওয়া হয় একক কণ্ঠে, কিন্তু বালিকা সঙ্গীত নেচে, গেয়ে, অভিনয় করে পরিবেশন করে কুশীলবরা। এর জন্য লীলা কীর্তনের আঙ্গিকে পালা রচনা করা হয়। পালা রচনা করেন দলের মূল পরিচালক। কুশীলবদের কাছে যিনি মাস্টার নামে পরিচিত। এই মাস্টারকে হতে হয় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনিই একাধারে পালা রচনা করেন, সুর দেন, মঞ্চ সাজান, অভিনয় শেখান এবং দল পরিচালনা করেন। দলের মোট সদস্য হয় ১৮-২০ জন। ৮-১০ জন মূল কুশীলব। প্রত্যেকে বালিকা এবং যাদের বয়স চৌদ্দ বছরের মধ্যে। প্রসঙ্গত বালিকা সংগীতে অভিনয়ের ক্ষেত্রে বালকদের কোনো ভূমিকা থাকে না। পুরুষ চরিত্রের অভিনয়ও সম্পাদিত হয় বালিকাদের দ্বারাই। দলে বাজনদার থাকে ৫-৬ জন। বাজনদারদের মধ্যে বাঁশি, কর্ণেট, হারমোনিয়াম, তবলচি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অনান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানোর লোক থাকে দলে। চরিত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী সাজানোর জন্য এক বা দু’জন মেকআপম্যান এবং দল পরিচালক ও একজন সহযোগী পরিচালক নিয়ে গঠিত হয় বালিকা সঙ্গীতের মূল দল।
ষাট সত্তররের দশক ছিল বালিকা সংগীতের রমরমা সময়। মূলত দুর্গাপুজো, রাস, কার্তিকপুজো ও সরস্বতীপুজো ছিল বালিকা সঙ্গীতের উৎকৃষ্ট মরসুম। বালিকা সঙ্গীতের জনপ্রিয় পালাগুলি হল- মান, মাথুর, নিমাই সন্ন্যাস, সীতার বনবাস, রাম-রাবন পালা, লক্ষ্মণ বর্জন, মহিষাসুরমর্দিনী প্রমুখ। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পালা নিমাই সন্ন্যাস। সাংবাদিক ও লোকগবেষক প্রভাসচন্দ্র পাত্র তাঁর বাল্যকালের স্মৃতি শুনিয়েছেন। নিমাই সন্ন্যাস পালা দেখতে দেখতে দর্শকদের চোখে জল এসে যেত। বিশেষত নিদ্রামগ্ন বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে নিমাই এর বিদায় নেবার দৃশ্যে যখন সুরেলা কিশোরী কন্ঠ গেয়ে উঠত ‘জন্মের মতো চললাম তবে।’ এক অদ্ভুত আবেগঘন মুহূর্ত তৈরী করতো। বেশিরভাগ পালা গুলিই রচিত হতো পঞ্চম অঙ্কের। পালা পরিবেশিত হতো চার-পাঁচ দিন ধরে। এক এক রাতে পরিবেশিত হতো তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় ধরে । সংলাপ রচিত হতো পদ্য ছন্দ্যে।সাথে থাকতো নাচ ও গান।নাচ ও গান একসাথে পরিবেশিত হওয়ায় একে অনেকে ‘অপেরা’ র সাথেও তুলনা করেছেন । অনেকে তুলনা করেছেন গীতিনাট্যের সাথে।এক অনন্য সুন্দর লোকায়ত গীতিনাট্য হল বালিকা সঙ্গীত। পালা শুরু হয় মাস্টারের গৌরচন্দ্রিকার মাধ্যমে।তার সাথে থাকেন জুড়িদার।গৌরচন্দ্রিকার পর শুরু হয় মূল পালা।তার আগে প্রয়োজনীয় সজ্জায় সজ্জিত করে তোলা হয় বালিকাদের।কিশোরী কন্ঠ যখন গেয়ে ওঠে –
একদিন কাটিয়া আকাশি,হয়ে
আত্মবিশ্বাসী
এসেছে মথুরাপুরে
আমরা সন্ধান করে জানতে
পারিলাম
কুব্জা রেখেছে ধরে।
মোহিত হয়ে আবেগ প্রবন হয়ে পড়ে দর্শক।বা যখন দু হাত তুলে নাচতে নাচতে কিশোরী কন্যা গায়-
ঘরে ঘরে মান কে না জানে
মান করিলে সোহাগ বাড়ে
ঘরে ঘরে মান কে জানে ।কিংবা গায় –
মান করেছেন বিনোদিনী
চিন্তিত তাই চিন্তামণি।
শুনতে শুনতে মান অতিমানীতার গণ্ডী ছেড়ে দৈনন্দিন দুঃখ কষ্ট ভুলে দর্শক জাপটে ধরে বালিকা সংগীতের ভালোলাগা টুকুকে।এই ভালোলাগাই বছর বছর বায়না করে আনে বালিকা সংগীতের দল।মাস্টার মন দেন পালাকে আরও আকর্ষনীয় করার দিকে।এক সময় বালিকা সংগীতের রমরমা বাজার ছিল সিমলাপাল ব্লকের লক্ষ্মীসাগর ,বিক্রমপুর, পুখুরিয়া প্রভৃতি গ্রামে।
সিমলাপাল ব্লকের বালিকা সঙ্গীতের সেকাল-একাল
বাঁকুড়া জেলার খাতড়া মহকুমার অন্তর্গত ব্লক সিমলাপাল।ষাট ও সত্তরের দশকে এই ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে বালিকা সঙ্গীত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর উৎপত্তি ব্লকের অর্ন্তগত লক্ষ্মীসাগর গ্রাম।লক্ষ্মীসাগরে বালিকা সংগীতের দল প্রথম গঠন করেন পরাণচন্দ্র দাস।শোনা যায় তিনি উৎসাহ পেয়েছিলেন মেদিনীপুর জেলার বিনপুর থেকে আগত বালিকা সঙ্গীতের দল দেখে।তিনি নিজে ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির;দক্ষ ছিলেন বহুবিধ বাদ্যযন্ত্র বাজানোয়।বালিকাদের নিয়ে গানের দল গড়ায় তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।বালিকা সঙ্গীতের দল গড়ার পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল– মেয়েদের গলা ছেলেদের তুলনায় সুরেলা যা গানের দল গড়ার সহায়ক। বালকদের তুলনায় বালিকারা স্বভাবতই শান্ত । বয়ঃসন্ধিকাল বলে ছেলেদের গলার স্বর ভেঙ্গে যাবার সম্ভবনা থাকে।স্বাভাবিক ভাবে বয়ঃসন্ধিকালে বালকদের বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে,যাদের নিয়ে বাইরে পালা করতে যাওয়া সমীচীন বোধ করেননি পরাণচন্দ্র ।তাই বালকদের পরিবর্তে বালিকাদের নিয়ে তিনি দল গড়েন। তাঁর সহযোগী হন অনিল চঁন্দ ও নারায়নচন্দ্র ডুমর্যা এবং তার বালক পুত্র ভক্তরঞ্জন ডুমর্যা ।এদের মধ্যে গান রচনা করতেন অনিল চঁন্দ।তাঁর রচিত পালা নিমাই সন্ন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলে উৎসাহিত হয়ে তিনি রচনা করেন রাধা কৃষ্ণের প্রেম ও বিরহ নিয়ে মান এবং মাথুর।তখন রমরমা বাজার ছিল বালিকা সঙ্গীতের । যদিও তখনও তা অচ্ছুৎ ছিল নয়া সমাজের উচ্চ বর্ণের লোকেদের কাছেও। তখন বালিকাদের মধ্যে বিদ্যালয়ে যাবার প্রবণতা কম থাকায় অভিনয়ের প্রয়োজনে বালিকা পাওয়া সহজলভ্য ছিল।বরং দলে সুযোগ পাবার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা লেগে থাকতো ।বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও ডাক আসতো মেদিনীপুর জেলার গোয়ালতোড়, বিনপুর, দাসপুর, দইজুড়ি প্রমুখ জায়গা থেকে।মরসুমের সময়গুলিতে একটা রাতও বিশ্রাম পেতেন না শিল্পীরা।নিমাই সন্ন্যাস পালায় বিষ্ণুপ্রিয়া রুপে বাসন্তী চঁন্দ ও নিমাই রুপে অঞ্জলী ডূমর্যার অভিনয় জনপ্রিয় হয়েছিল। তাদের মুখে ‘দয়া করে একবার এসো গৌর হে/এসো এসো ভাই, শ্রী গৌর নিতাই/একবার এসো গৌর হে/এসো মম হৃদি মাঝে।’ শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো গা ভেঙ্গে আসা শ্রোতা।নিঃসন্তান পরাণচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর দলের দায়িত্ব নেন নারায়ন চন্দ্র ডুমর্যা।লক্ষ্মীসাগরের বালিকা সঙ্গীতের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দল গড়েন বিক্রমপুরের ক্ষিতিশ সৎপথী,পুখুরিয়া গ্রামের গুণাকর কর্মকার। গুণাকর কর্মকারের সহযোগী ছিলেন নিতাই কর্মকার। কুশীলবদের মধ্যে মধ্যমণি ছিল গুণাকর কর্মকারের মেয়ে জবা কর্মকার।গুণাকর কর্মকারের মৃত্যুর পর দল ভেঙ্গে যায়। ক্ষিতিশ সৎপথী জীবিত তবে বালিকা সংগীত ছেড়ে তিনি অনেকদিন আগেই ঝুকে পড়েছেন মনসা যাত্রার দিকে।
লক্ষ্মীসাগরে আজও টিমটিম করে চলছে বালিকা সংগীতের দল। দল চালান বৃদ্ধ ভক্তরঞ্জন ডুমর্যা,তার সহযোগী দুজন কার্তিক দাস এবং মানিক কর্মকার।বালিকা না মেলায় সংগীতের এই ধারা টিকিয়ে রাখতে তারা পাড়ি দিয়েছেন দূরবর্তী গ্রাম মাচাতোড়ায়।মেয়েদের পড়াশুনায় আগ্রহ বৃদ্ধি বালিকা না পাবার কারণ। বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম সহজলভ্য হওয়ায় বালিকা সংগীতে আগ্রহ হারাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম।
পাশাপাশি প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বালিকা সংগীতের এই ধারাকে আলো,ভাষ্য, মঞ্চ দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে বাঁকুড়া জেলার ইঁদপুরের রঘুনাথপুর পড়াশিডাঙ্গার ‘পুষ্পাঞ্জলি অপেরা।’এই অপেরার মাস্টার মধুসূদন বাউরি।দলের ম্যানেজার অর্জুন মাল।মূল গায়িকা স্থানীয় বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণীর কলা বিভাগের ছাত্রী সোমা মাল। তার অভিনীত ‘মাথুর’ পালা এই অঞ্চলে বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। তার গলায়, “আমি কোথায় গেলে পাবো দেখা বলো দয়াময়/তোমার প্রেম জলে ভাসালে নাকি কৃপা হয়/আমি সকল আশা ছাড়িনু এবার স্মরণ লইনু চরণে।” শুনতে দূর দূরান্ত গ্রাম থেকে হাজির হন দর্শকেরা।
ভক্তরঞ্জন ,মধুসূদন বা অর্জুন দল চালান নেশায়।সেখান থেকে আর্থিক লাভ প্রায় হয়না বললেই চলে।আর্থিক অনটন,কুশীলবদের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও দল চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
সাক্ষাৎকারঃ ভক্তরঞ্জন ডুমর্যা, প্রভাস পাত্র, দিলিপ পাত্র
সহযোগিতাঃ অনিরুদ্ধ ডাংগুরিয়া, পার্থসারথি গোস্বামী।
ঁ পরাণ চন্দ্র দাসের দল আমার গ্রামে বিগত পঁচিশ বছর ধরে পালা করে চলেছে।আমরা সকলে এই গানবাজনায় আপ্লুত।