মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ৩। ফাইভ হান্ড্রেড রুপিস অনলি। লিখছেন আদিত্য ঢালী

0

মগধের সিংহাসন থেকে নন্দদের তাড়িয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য মৌর্য্যযুগের সূচনা করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক স্বর্ণ যুগ। মৌর্য্য বংশের সূচনাতে যাঁর কথা কখনোই অস্বীকার করা যায় না, তিনি ছিলেন চাণক্য। কূটনীতিবিদ চাণক্যই আদতে নাকি চালনা করতেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে। অনেকটা কুরুক্ষেত্রের মাঠে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণের মত। শুধু পরিচালনা করা, বাকি কাজ তো নির্দেশ মত পালন হবে। আমাদের ব্যাঙ্কের নারানদা ব্যাঙ্কের রথ নিজের কাঁধে তুলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শ্রী কৃষ্ণ।

ব্রাঞ্চে ঢুকলেই যেটা সবার আগে চোখে পড়ে সেটা হল নারানদার সামনে লোকজন জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার একটাই দাবী, নারানদাকে লিখে দিতে হবে। লিখতে না জানা ব্যক্তির থেকে লিখতে জানা ব্যক্তি সবার দাবীই সমান। আর নারানদা নির্বাক চিত্তে ক্রমাগত লিখে চলেছে। আমরা মাঝে মাঝে মজা করে বলি, “নির্ঘাত তুমি আগের জন্মে যমরাজের সহকারী চিত্রগুপ্ত ছিলে। না হলে রোজ সারাক্ষণ কেউ লিখে যেতে পারে!” নারানদা চশমার উপর দিয়ে তাকায় আর একটা বাঁকা হাসি হেসে আবার লিখতে শুরু করে, “ফাইভ হান্ড্রেড রুপিস অনলি।”

নারানদার আসল নাম নারায়ণ। নামের ন্যায়ে প্রভু নারায়ণের ধ্যান জ্ঞানে মত্ত। নারায়ণ থেকে অপভ্রংশ হয়ে নামটা যে কবে থেকে নারানদা হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা বোধহয় গোটা গ্রামের কেউই দিতে পারবে না। নারানদা সবার নারানদা। কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবার একটাই ডাক নারানদা। আর সবার এক ডাকেতেই নারানদা হাজির। নারানদাকে ছাড়া ব্যাঙ্ক চালানো একপ্রকার অচল। যেদিন নারানদা ছুটি নেয় সেদিন ব্যাঙ্কে গেলে বোঝা যায় ব্রাঞ্চের দূরবস্থা কতটা। পানীয় জলটুকু পর্যন্ত পাওয়া যায় না। বেলা বাড়লে যখন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, ‘একটু জল পাই, জল পাই’ বলে বলে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন বাধ্য হয়ে ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে জল কিনে এনে খেতে হয়। নারানদা বছরে দু’বার একটানা ছুটি নেয়। সেই ছুটির সময়ে আমাদের কালঘাম ছুটে যায় সব কিছু সামলাতে সামলাতে।

এই যে এত নারানদা নারানদা করছি এবারে প্রশ্ন আসতেই পারে এই নারানদা কে? রোগাটে, লম্বা, দশকের পর দশক ধরে তীব্র রোদে পুড়ে যাওয়া শরীরটাকে দেখলেই বোঝা যায় নারানদা আসলে আর কেউ নয়, পৃথিবীর উৎপত্তি থেকে আমাদের জন্য ফসল ফলানো সেই কৃষক, যাদের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা আদৌ ততটা ওয়াকিবহাল নই। তাই নারানদাও আমার কাছে শুধুমাত্র আমার একজন সহকর্মী। যে মাত্র সাত হাজারি বেতনে সকাল থেকে বিকেল অবধি থেকে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অবধি ব্রাঞ্চের সবটুকু কাজ উতরে দিয়ে যায়।

যে পরিশ্রম নারানদা করে সেই পরিশ্রম একজন যুবকের পক্ষেও করা সহজ নয়। তাই নারানদা মজা করে বলে ও হল চির যুবক। ওর বয়স আমরা কেউই আন্দাজ করতে পারি না। কিন্তু হিসেব করলে দেখা যায় ও আসলে সিনিয়র সিটিজেনের গণ্ডি পার করেছে। কিন্তু ওকে দেখে বোঝা মুশকিল। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার কাছে ও শুধুমাত্র নারানদা। কোনও ফক্কর ছোকরা যদি ওকে নারান দাদু বলে ডাকে ও সেই ছোকরাকে কোণায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ধমক দিতেও ছাড়ে না। কিন্তু সেই ধমকের সুর এতই নরম হয় যে সেই ছোকরাও লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফিক করে হেসে চলে যায়। নারান দাদু নারানদা হয়ে চির যুবকের তকমাতেই ফিরে আসে আবার। নারানদার বয়স নিয়ে আমাদের মধ্যে রসিকতাও কম হয় না। আমরা যতই হিসেব করে ওর বয়স বের করি না কেন ও কিছুতেই নিজের সত্যি বয়সও বলে না আবার আমাদের হিসেবটাকেও মানে না। কিন্তু নারানদার বয়স যতই হোক না কেন এই বয়সেও ও বাইশ খানা লুচি খেতে পারে। রাতের আহারে খান দশেক রুটি খায়, এক সের দুধ খায়, আমাদের পিকনিকে পাঁচশ চালের ভাত খায়। খাওয়ার পরিমাণ দিয়ে যদি ওকে পেটুক বলা হয় তবে ও পেটুক একেবারেই নয়। এই চার বছরে অন্তত এইটুকু বুঝেছি যে ভোর চারটেতে উঠে বিঘের পর বিঘেতে হাল দিয়ে ব্রাঞ্চে এসে ব্রাঞ্চ পরিষ্কার থেকে শুরু করে সকল ফাইফরমাশ ও আগত সকল কাস্টমারের চাহিদা মিটিয়ে দেওয়ার পরও এইটুকু খাওয়া ওর নিতান্ত প্রয়োজন।

ব্রাঞ্চে এলেই দেখা যায় সবটা ভিড় নারানদার কাছে। গোল করে সবাই ওকে ঘিরে রেখেছে আর ও সবারটা মনোযোগ দিয়ে শুনে সবার যা যা প্রয়োজন সবটা করে দিচ্ছে। কারও টাকা জমাতোলার ফর্ম লিখে দিচ্ছে, তো কারও অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম লিখে দিচ্ছে, তো কারও পাসবই হারিয়ে যাওয়ার দরখাস্ত লিখে দিচ্ছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ও যত লেখে আমি যদি এক সপ্তাহ সেই পরিমাণ লিখতে পারি তাহলে আমার তিনটে উপন্যাস এতদিনে লেখা হয়ে যেত। কিন্তু আফসোস আমি সারাদিনের টাকা গোনার ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। ওদিকে নারানদা সন্ধ্যায় ব্রাঞ্চ বন্ধ করে বাজারে গিয়ে ধান বিক্রি করে বাজার করে বাড়ি ফিরে, গরুর দুধ দুইয়ে, মুরগিদের খাবার দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘণ্টা পাঁচেক ঘুমিয়ে ভোর হতেই আবার কাস্তে কোদাল নিয়ে হাঁটা দেয় মাঠের পথে। আমি খেয়াল করে দেখেছি যে লেখা পড়া জানা লোকেরাও নিজেদের এতটা অবিশ্বাস করে যে ওরাও ওদেরটা নারানদাকে ছাড়া আর কাউকে দিয়ে লেখাবে না। এর কারণ যে কী তা এতদিনেও আমি আবিস্কার করতে পারিনি। কাস্টমারদের জিজ্ঞেস করাতে তারা শুধু ফিক করে হেসেছে আর কোনও উত্তর দিতে পারেনি। আমিও আর ঘাঁটাইনি কারণ নারানদার মত শান্ত মাথায় সবকিছুকে সামলে নেওয়ার কৌশল আমার এখনও শেখার বাকি।

এ হেন নারানদা, যার মুখে কখনই কোন কাজের ক্ষেত্রে ‘না’ শব্দটি কখনও বের হয় না, এক ডাক দিলেই যে সদাহাস্য মুখটাকে নিয়ে আমাদের সবার কাছে হাজির হয়ে যায়, কোনও কোনও সময়ে আমাদের ব্যক্তিগত কাজও ও বিনা দ্বিধায় করে দেয়, সেই নারানদার আফসোস একটাই যে ব্রাঞ্চের জন্য এত কিছু করে দেওয়ার পরেও নিজের জমির বিনিময়ে ও চাষের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন পায় না। অথচ চাষ বাবদ সরকারি সমস্ত সু্যোগ সুবিধা পায় কিন্তু ওর নিজের ব্যাঙ্ক ওকে চাষ করার জন্য লোন দেয় না। ব্যঙ্কের বড়বাবুরা নাকি ওর অনেকবার আবেদন নিবেদনের পর ওকে বলেছে একজন ব্যাঙ্ককর্মী হয়ে ও নাকি চাষের জন্য লোন পাবে না। এদিকে আমি কানাঘুষোতে শুনেছি ওর সমতুল্য অন্য কর্মীরা নাকি চাষের জন্য লোন পায়। কিন্তু ওকে কেন দেওয়া হয় না সেই জটিল রহস্যের সমাধান আমি আজও করে উঠতে পারিনি। চাষের লোন না পাওয়ায় ও একটু মুষরে পরেছিল ঠিকই কিন্তু আবার সমহিমায় ফিরে আসে যখন আমাদের সিএসপি এসে বলে তাঁর পুকুরে আগামীকাল মাছ ধরা হবে, সে মাছ নিয়ে আসবে আমরা যেন দুপুরের খাওয়ার বাকি ব্যবস্থাটুকু করে নিই। যেদিন যেদিন দুপুরে মহাভোজের আসর বসে সেদিন সেদিন সকাল সকাল এসে নারানদার কাজ থাকে বাজার করে এনে ভাতের হাঁড়িটা চাপিয়ে দেওয়া। সেদিন ও ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে ব্রাঞ্চ পরিষ্কার করে জল এনে আবার নিজের কাজের যায়গায় ফিরে গিয়েছিল ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে নামিয়ে। রান্না করার ভার থাকে আমাদের সিভিক ভলেন্টিয়ার ভাইয়ের উপর। সেদিন ডাল তরকারির পাশাপাশি মৌরলা মাছের টক, তেল কই আর রুই মাছের কালিয়া ছিল মেনুতে। দুটোর সময় গেট বন্ধ করে আমরা যখন সবাই মিলে খেতে বসলাম, দেখলাম আমাদের বসার আগেই নারানদা সবার পরিবেশন একদম পরিপাটি করে করে রেখেছে। খেয়ে দেয়ে ভরা পেটে কাজ করার ইচ্ছে একেবারে থাকে না। তাকিয়া পেতে ঘুমিয়ে নিতে মন চায়। কিন্তু মন চাইলেই কি আর উপায় হয়! ক্যাশে ফিরে গিয়ে ভিড়টা কাটিয়ে উঠতেই দেখি চোঁয়া ঢেকুর উঠছে বারবার। পেটের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মাথাটাও যেন ঘোরাচ্ছে একটু মনে হচ্ছে। ক্যাশ থেকে বেরিয়ে সোজা বাথরুমের সামনে গিয়ে চোখে মুখে জল দেওয়ার সময় দেখি কোথা থেকে নারানদা আমার পাশে এসে হাজির হয়েছে। আমি রুমাল মুখ মুছে নারানদার দিকে তাকাতেই নারান বলে ওঠে – “খাওয়ার সময়ই দেখেছি খালি তেল মশলাগুলো চেটে চেটে খাচ্ছেন, তখনই বুঝেছিলাম শহরের পেটে কি গ্রামের এত তেল সইবে? ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। এই নিন এটা খেয়ে নিন।” নারানদার জ্ঞান শোনার মত অবস্থা তখন আমার নেই। পেট যেন উপচে উঠেছে। নারানদা যা দিল সেটা নারানদার হাত থেকে ছো মেরে নিয়ে সোজা মুখে ঢেলে দিলাম, মুখে ঢালার আগে দেখিওনি সেটা ইনোর প্যাকেট ছিল। মুখে ঢেলেই জলের বোতল নিয়ে গলায় জল ঢালার পরেই ঘটল সেই অঘটন। কোল্ডড্রিংক্সের বোতল অনেকক্ষণ ঝাঁকুনির পর যদি খোলা হয় তবে ফ্যানা হয়ে কোল্ডড্রিংক্স বোতলের মুখ দিয়ে উপচে পড়ে যায়। আমার অবস্থা হল সেরকম। জল ঢালার সাথে সাথেই সারা মুখ ফ্যানায় ভরে গেল। আমি সেই ফ্যানায় কিছুই না দেখতে পেয়ে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। নারানদা পাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ব্যাপারটা দেখছিল, আমায় হাতড়াতে দেখে শুধু একটাই কথা বলল “গান্ডু নাকি!” কথাটা বলেই মনে হয় ওর বোধহয় মনে হয়েছিল অন্যায় হয়ে গেছে তাই আমার হাত ধরে তৎক্ষণাৎ বেসিনের সামনের নিয়ে গিয়ে মাথাটা বেসিনের মধ্যে রেখে কল চালিয়ে দিল। মাথা ভিজে যেতে, ফ্যানা ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আমার কিছু সম্বিত ফিরল। আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কী ভুল করে ফেলেছিলাম। সেই ভুলের ধকল এতটাই গেছে যে শরীর খারাপও ঠিক হয়ে গেছে। এবারে সবাই যদি এই ঘটনার কথা জানতে পারে আমার প্রেস্টিজ একেবারে মাঠে মারা যাবে। নারানদাকে কাছে ডেকে বললাম, “তোমার ওষুধে কাজ হয়েছে, কিন্তু যা হল সেসব আর কাউকে বলো না কেমন, আমার শরীরটা এতটাই খারাপ করছিল যে আমি খেয়াল করিনি ওটা ইনোর প্যাকেট ছিল।” নারানদা মুচকি হেসে বলল “চিন্তা নেই কাউকে বলব না।”

সেদিন কাজ শেষ করে সবে বাড়ি ফিরব বলে তৈরি হচ্ছি এর মধ্যে দেখি পিওন চিঠি নিয়ে এল। ভোটের ডিউটির চিঠি। আমাদের যাদের ভোটের ডিউটিতে যেতে হয় তারা জানি কোন জন্মের পাপ করে আসার ফল আমাদের ভোগ করতে হয়। অন্ততঃ আমার অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। কিন্তু এই পরিসর আমার অভিজ্ঞতা জ্ঞাপনের নয়, সে নাহয় অন্য কোন পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। কিন্তু নারানদার ভোট করাতে গিয়ে একেবারে রেবেল সুলভ অবতারের গল্প আমরা যেটা শুনেছিলাম সেটা এই পরিসরে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একেই কর্তৃপক্ষের সাথে একটা টানাপড়েন নারানদার লেগেই ছিল চাষের লোন নিয়ে। তার মধ্যেই আসে ভোটের ডিউটির চিঠি। আর এবারে নারানদাকে একেবারে প্রিসাডিং অফিসার পদে দেওয়া হয়েছে। সাধারণত আমরা যখন নিজেদের ডিটেলস ভোটের ডিউটির জন্য পাঠাই তখন সব কিছুর সাথে বিশেষ ভাবে আমাদের পদের উল্লেখ থাকত। ভোটের ডিউটির ক্ষেত্রেও সর্বত ভাবে পদের বিবেচনা করেই ডিউটির দায়ভার দেওয়া হত। ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব থাকে সর্বোচ্চ। সাধারণত কোনও সংস্থার কোনও উচ্চপদস্থ কর্মীকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্ত সেবারে ভুলে হোক বা দায়সারা কাজের জন্যই হোক নারানদাকে দেওয়া হয়েছিল প্রিসাইডিং অফিসারের গুরুদায়িত্ব। নারানদা একেই লোনের আশা করে না পেয়ে মর্মাহত তাঁর ওপর এই গুরুদায়িত্ব পেয়ে ওর অবস্থা খুবই টালমাটাল হয়ে গেল। আমরা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে ভোটের ডিউটিতে পাঠালাম। এটা বলে দেওয়া হল আমাদের ফোন সবসময় ওর জন্য উপলব্ধ থাকবে।

ভোটের দিন আগেরদিন দুপুর থেকে নারানদার ফোন আসা শুরু হল। ভোট গ্রহণ পর্ব অবধি কতবার যে নারানদার ফোন এসেছিল তাঁর ইয়াত্তা নেই। মাঝে মাঝে আমারও বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু কিছু প্রকাশ করার অবকাশ ছিল না। একটা গোটা সিস্টেম যদি এত বড় একটা ভুল করতে পারে তাহলে সেই ভুলের খেসারত দিতে আমাদের হবেই কারণ আমরাও সেই সিস্টেমেরই অংশ। হঠাৎ সন্ধ্যে থেকে নারানদাকে আর ফোনে পাওয়া গেল না। আমাদের ভোট নেওয়ার পর্ব সন্ধ্যেতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নারানদার কিছু বাকি ছিল শেষ ফোনে তেমনটাই বলেছিল। কিন্তু সন্ধ্যে পার করতেই ওকে আর ফোনে ধরা গেল না। আমারও ক্লান্তি ছিল প্রচণ্ড। সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের লোকাল ধরে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন বেলা আটটা। সারাদিন একপ্রকার ঘুমিয়েই কাটল। নারনদার কথা আর মনে পড়েনি। পরদিন অফিসে পৌছে নারানদার খোঁজ করতে দেখি সে পিছনের করিডরে ভাব নিয়ে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে ওর সামনে পৌঁছাতেই ও চায়ের কাপে সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে বলল “বুঝলেন, কাল বাবুদের একদম পিলে চমকিয়ে দিয়ে এসেছি।”

“কেন কী হয়েছে?” — আমি জিজ্ঞেস করলাম।

— কী আর হবে? নিজেরা ভুল করবে, তার দায়ভার নিতে হবে আমাকে আর তারপর বাবুরা কথাও শোনাবে! সব কি মুখ বুজে সহ্য করে নেব নাকি? তারা তাদের মর্জি মতন সব করবে আর ভুগব আমরা।

নারানদার কথায় বেশ একটা রাগ প্রকাশ পেল। বুঝলাম ব্যাটাকে ঝুলিয়েছে ভালোই। নাহলে এত রেগে ও কিছুতেই যায় না যত সমস্যাই আসুক। ধীরে ধীরে ওর রাগ কমতে ও যা বলল তা শুনে আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল, হৃৎপিণ্ড যেন এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।

সব ঝামেলা মিটিয়ে ও যখন ব্যালট বাক্স জমা দিতে পৌঁছায় তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। অগুনতি ফোন করার ফলে ওর নিজের ফোনর চার্জ শেষ হয়ে গিয়ে ওর ফোন সন্ধ্যে থেকেই বন্ধ হয়ে পড়েছিল। চার্জ করার সময় ও সুযোগ কোনটাই ও পায়নি। ফর্মগুলো ফিলাপ করতে গিয়ে বেশ কিছু ভুল করে ও যখন ব্যালট বাক্স নিয়ে পৌছায় তখন সবার জমা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র ওর জন্যই নাকি অপেক্ষা করছিল ওখানকার অফিসাররা। কিন্তু ওর কাজে অনেক ভুল হওয়াতে ওকে নাকি অনেক বকাবকি করে। ও শেষমেশ বাধ্য হয়ে বলে, “একজন পিওনকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন কেন? দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম পড়েছে নাকি?” এই শুনে অফিসার নাকি ওকে বলে, “তুমি আমায় জ্ঞান দিচ্ছ? জানো তোমার চাকরি আমি খেয়ে নিতে পারি?” সাধারণত এই ধমকির পরে অধিকাংশ মানুষই নুইয়ে পড়ে। কিন্তু নারানদা শিরদাঁড়া সোজা রেখে চোখে চোখ দিয়ে বলে, “বালের চাকরি! একটা চাষের লোন পাওয়া যায় না সেটা আবার কীসের চাকরি?” অফিসার নাকি এরপর একটু থতমত হয়ে ওর ভুলগুলো নিজেই সব ঠিক করে দিয়ে সব কিছু জমা নিয়ে নিজের গাড়িতে করে ওকে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। ওর কথা শেষ হতেই আমি প্রায় তারস্বরে চিৎকার করে বলে উঠি “সাবাশ!”

কথায় আছে বঞ্চিতরা সঞ্চিত মাল ঠিক খুঁজে নিতে জানে। সহ্য ক্ষমতা যেদিন ভেঙে যাবে সেদিন আসমানে যতই কালো মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ উঠুক না কেন হকের দাবী আদায় ঠিক করে নিতে জানে মানুষ। এর বেশ কিছু মাস পরে হেড অফিস থেকে ওকে আলাদা করে ফোন করে বলে যে জমির রেজিস্ট্রেশান কাগজ যদি ও আবার বের করে নিয়ে আসতে পারে তাহলে ও লোন নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে। হয়ত কিছু টাকা এতে নারানদার খরচ হবে ঠিকই কিন্তু হকের দাবী তো আদায় হবে। কিন্তু দিনের শেষে ওকে আবার ভোরে উঠে মাঠের কাজ শেষ করে ব্রাঞ্চে এসে সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মাঝে বসে একের পর এক ফর্ম ও লিখে চলবে অবিরত।

“কত টাকা তুলবে তুমি?”

— “পাঁচশ”।

কলমের ডগায় এরপর আবার কোনো এক অজ্ঞাত কারনের রাগ দুঃখ ভালোবাসা আনন্দকে জড়ো করে নারানদারা খসখস করে লিখে চলবে “ফাইভ হান্ড্রেড রুপিস অনলি।”

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *