সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১৯। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

তিন
মিজুতানি, স্টলের এবং অন্যান্য গবেষকদের কাজ থেকে জানা যাচ্ছে, তথাকথিত ‘পরিত্যক্ত’ শিশুদের ঘিরে সায়েব উপনিবেশগুলোয় যে ত্রাণ ও উদ্ধারের রাজনীতি তৈরি হচ্ছিলো, তার কেন্দ্রে বর্ণবাদ অর্থাৎ রেসিজম-এর প্রচ্ছন্ন বা সরব উপস্থিতি ছিলোই। ‘অনুপযুক্ত’ পারিবারিক বৃত্ত থেকে শিশুকে বিচ্ছিন্ন করে ‘উপযুক্ত’ নতুন বাড়িতে নিয়ে আসা মানে দিশি অশ্বেতাঙ্গ মায়ের কাছ থেকে তাকে দূরে পাঠানো। বাপ সচরাচর সাদা চামড়া সায়েব, তাকে বড়জোর দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাভিচারি কুলাঙ্গার বলে গাল পাড়া যেতে পারে, কিন্তু পাপের আসল উৎস দিশি মা, অর্থে আদ্যোপান্ত বর্বর ও অ-সংস্কৃত এক পরিবেশ, যাতে ‘নেটিভ’ দুর্গন্ধ ময়লা মিশে আছে, এত গভীর সে মিশাল, হাজার ধুলেও ময়লা যাবার নয়। নয়, কেননা শ্বেত-অশ্বেত, আমরা-ওরা, সায়েব-দিশি, ইত্যাকার চালু ঔপনিবেশিক দ্বিত্বধারণায় ‘নেটিভ’ ময়লার এই গল্প আগাগোড়া মিশে থাকে, ফলে গ্রাহাম সায়েবের মতো সমাজ সংস্কারকের পক্ষেও অন্যরকম কিছু ভাবা সম্ভব হয়নি। য়ুরোপীয় রক্ত শরীরে বইছে যে শিশুর, দিশি মায়ের কাছে সে থাকে কি করে? ‘শিশুত্রাণ’ বা বাচ্চা বাঁচানোর যে প্রকল্পে সায়েবি প্রশাসক ও সমাজ সংস্কারকদের বিস্তর সময় ও পয়সা গিয়েছে, উনিশ শতক থেকেই যে প্রকল্পে একের পর এক অনাথশালা ও দাতব্য ইস্কুল তৈরি হতে থাকে, তার মূলে দিশি মায়ের ভয়। মানে, হিন্দু ও মুসলমান মায়ের দল য়ুরোপীয় বাপের সন্তানদের নষ্ট করে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, তাদের অন্যত্র পাঠাও। উপনিবেশের সর্বত্র, দিশি মা-দের কিভাবে দোষী বানিয়ে ফেলা হতো তা নিয়ে বিশদ আলোচনা ও তথ্য পাওয়া যাবে অ্যান লরা স্টলের-এর বইতে, কার্নাল নলেজ অ্যান্ড ইম্পিরিয়াল পাওয়ার, য়্যুনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ২০০২ সালে। দিশি মেয়েদের সঙ্গে সায়েব ছেলেদের মেলামেশা ও যৌনতা জনিত এই সমস্যা, আদতে ভারতে সায়েবসাম্রাজ্য স্থাপনের গোড়ার দিক অর্থাৎ কোম্পানি আমল থেকেই ছিলো। ইউরেশিয়ান সম্প্রদায়ের গোড়াপত্তন এবং সে সম্প্রদায়ের শিশুদের য়ুরোপীয় শিক্ষাদান উদ্দেশ্যে অনাথশালা ও দাতব্য ইস্কুল তৈরির আদিপর্ব নিয়ে লিখেছেন ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার জে হয়েস, তাঁর পুয়োর রিলেশানস, দি মেকিং অব এ ইউরেশিয়ান কমিউনিটি ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ১৭৭৩-১৮৩৩, বইতে। টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস থেকে এই বই ছাপা হচ্ছে ১৯৯৬ সালে।

স্টলের ও হয়েস-এর কাজের সূত্র ধরে মিজুতানি খুঁজে দেখতে চাইছেন, কিভাবে ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনার মধ্যে সায়েবি নীতিভাবনা ওতপ্রোত, যে নীতিভাবনা বলে, দিশি মেয়েরা কার্যত নীতিহীন এবং উচ্ছন্নে যাওয়া ব্যভিচারিণী, য়ুরোপীয় সায়েবদের কাজ হচ্ছে এদের এড়িয়ে চলা। কোম্পানিরাজ শেষ হলো, মহারাণীর রাজত্ব শুরু, সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো বটেই, অন্যান্য জায়গাতেও সায়েবরা কুলাঙ্গারসুলভ কাজকর্ম করতে থাকলেন, মানে, কালো, বাদামি কি হলদে চামড়ার মেয়েদের ফাঁদে পড়তে থাকলেন। ফলে যা হবার হলো, ইউরেশিয় জাতের ‘দো-আঁশলা’ বর্ণসঙ্কর জনসংখ্যা বাড়তে থাকলো।

তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির থিরুভেল্লুরস্থিত জনৈক রেভরেন্ড জে এচ মেয়নার্ড পাদ্রিসায়েবের লেখা ১৮৯০ সালে মাদ্রাজ টাইমস পত্রিকায় ছাপা এক প্রবন্ধ উদ্ধৃত করেছেন মিজুতানি। ওই লেখায় মেয়নার্ড বলছেন, এই যে পাল পাল ইউরেশিয় জন্মাচ্ছে ও নিতান্ত কুকুরবিড়ালের মতো, দিশি মেয়েদের কাছে পালিত হচ্ছে যেমনতেমন করে, তাদের কি হবে? এই পাপের জন্য দায়ী কে বা কারা? য়ুরোপীয় জাতের সম্মান এদের জন্য ধুলোয় লুটোচ্ছে না? এই ইউরেশিয় শিশুকুলের দায়িত্ব সত্ত্বর সরকার বাহাদুর গ্রহণ করুন, এদের পিতা হয়ে উঠুন, সরকারহুজুরে মেয়নার্ডের আর্জি। স্টলের বলছেন, ঔপনিবেশিক সমাজের ভিতর অবধি চারিয়ে গিয়েছিলো ভয়, সাদা চামড়া(যেহেতু বাপ সাদা) শিশুদের এইভাবে ওই হতভাগা দিশি মেয়েগুলোর জিম্মায় ফেলে রাখলে, জাতজম্মো সব নষ্ট হয়ে যাবে। মিজুতানি বলছেন, কালিম্পং-এর হোম শুরু করার পিছনেও এই ভয় কাজ করছিলো। দিশি হোক, ইউরেশিয় বা অবরে সবরে এক আধজন য়ুরোপীয়, সব মেয়েরাই(মানে এক্ষেত্রে মায়েরা) সমান বিপজ্জনক, ক্ষতিকর, ধরে নেওয়া হয়েছিলো। মেয়েরা, মায়েরা যে বয়ে যাওয়া উচ্ছন্নে যাওয়া ঘরগেরস্তি চালায়, সেখানে বড় হয়ে উঠলে বাচ্চাদের কি গতি হবে? ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কি করবে তারা? সুতরাং, ওইরকম মা নয়, ওইরকম ঘরবাড়ি নয়। বাবা হিসেবে সরকার ওরফে রাষ্ট্র তো আছেই, তার প্রতিনিধি হয়ে বিরাজমান স্বয়ং ডক্টর গ্রাহাম, এবার ঠিকঠাক মা কিছু জোগাড় করে আনলেই, এই বাচ্চাগুলো য়ুরোপীয় রক্তের মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে, নিজেদের জাতের ও সাম্রাজ্যের মানও রাখবে। গ্রাহাম সায়েবকে বর্ণবাদি মানে রেসিস্ট বলে গাল দেওয়াটা কঠিন। হোমের আবাসিকদের যতই নেটিভ বহির্জগতের সঙ্গে সংশ্রবশূন্য জীবাণুবিহীন নিরাপদ পরিসরে নিয়মবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলা হোক, দিশি লোকজনের সঙ্গে গ্রাহাম নিজে নির্বাধ মেলামেশা করতেন। মৃত্যুর অব্যবহিত আগে তিনি বলতে শুরুও করেন, ভারতীয় সমাজের মধ্যে এদেশীয় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের আত্মীকৃত হতেই হবে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে জীবন্ত সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে এই সমাজভুক্ত মানুষেরা। রবীন্দ্রনাথ যখন মংপুফেরৎ কালিম্পং-এ আসছেন, গ্রাহাম তাঁর গুণমুগ্ধ, তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপচারিতা চলেছে। এসব সত্ত্বেও, সাম্রাজ্যের প্রয়োজন ও ব্রিটিশ শাসনের মর্যাদা গ্রাহামের কাছে সর্বাগ্রগণ্য, বরাবর। ১৯০৬ সালে কলকাতায় এক বক্তৃতায় গ্রাহাম বলছেন, ইউরেশিয় সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনের সবচাইতে কদর্য দিক। যেহেতু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা শাসকের সঙ্গে একরকম আত্মীয়তা বন্ধনে আবদ্ধ, এবং নিজেদের তারা খ্রিস্টান বলেই মনে করে, এদেশিয়রা ওদের দেখে ভাবে, য়ুরোপীয় সমাজ ওইরকমই, এদের আর মান্য করার কি আছে! শুধু তাইই নয়, গ্রাহাম ভাবতেন, ইউরেশিয় সমাজের কারণেই ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের প্রচার হচ্ছে না।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *