রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ১৩। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য
এই সময়ে একবার গ্যাস ফুরিয়ে গেল। খারাপ সময়ে সবসময় দেখেছি আরো কিছু খারাপই ঘটে। ইনডাকশান ওভেনটি ও কাজ করা বন্ধ করলো। গ্যাস কেনার টাকা তখন আমার কাছে নেই। বাড়িতে খাবার বলতে চাল আলু। মুড়ি চিঁড়ে খেয়ে কাঁহাতক আর থাকা যায়! তখন বাড়িতে ছিল প্রায় ছয় সাত মাসের জমিয়ে রাখা খবরের কাগজ। কি মনে করে তাদের বেচা হয় নি। তার অনেক আগেই অবশ্য আমাদের কাগজ কেবল সব কিছু বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তো সেই সমস্ত কাগজের ডাঁই আমাদের বিপদতারণ হয়ে উঠল। দুটো ইঁট পেতে পথের ধারের মানুষদের মতো উনুন তৈরি করলাম। প্রেসার কুকারে চাল আলু জল দিয়ে বন্ধ করে বসালাম সেই ইঁটের উপরে। আর, কাগজের পর কাগজ পুড়িয়ে চললাম। মোটামুটি দেখলাম প্রায় দেড় দুকেজি কাগজ লাগলো প্রেসার কুকারের দুটি সিটি পড়তে। কালো ঝুল প্রেসার কুকার ইঁট থেকে নামিয়ে ভালো করে ধুয়ে যখন দেখলাম, ভাত রাঁধা সত্যি সত্যি গেছে, আমার আর ছেলেদের তখন সে কী আনন্দ! এমন করে প্রায় দিন পনেরো চলেছিল আমাদের। এর মধ্যে সম্ভবত একটি চাকরির পরীক্ষায় গার্ড দিয়ে ছয়শত টাকা পেলাম, আমার আনন্দ দেখে কে! বহুদিন পর চিকেন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। প্রেসার কুকারে মশলা তেল আলু জল সবশুদ্ধ দিয়ে কাগজের জ্বালে সেদিন মাংসও রেঁধে ফেললাম। বহুদিন পর সেদিন ছেলেদের মাংস ভাত খাওয়াতে পেরে আমার বিশ্বজয়ের আনন্দ হয়েছিল। অসম্ভব তৃপ্ত হয়েছিলাম বলাবাহুল্য। আমার রান্নাঘরের দেওয়ালে কালোকালির দাগ পড়ল। সে দাগ আমার অহংকার।
এদিকে লোনের বাড়ির কিস্তি না জমা পড়ার কারণে ব্যাঙ্ক থেকে তখন নিয়মিত হানা দিতে শুরু করলো। আমার একান্ত অনুরোধে সেইসময়ের ব্যাংকের ম্যানেজার আমাকে কিছু সময় দিলেন, বাড়িটি বিক্রি করে যাতে লোন শোধ করতে পারি। অনেক চেষ্টার পর একসময় বাড়িটি বিক্রি করতে পারলাম। ব্যাঙ্কের লোন শোধের পর কিছু টাকা রয়ে গেল, যা দিয়ে পরে ফ্ল্যাট কেনা গেছিল।
বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল সুতরাং এবার এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় এল। আমরা তিনজনে ঠিক করলাম, সবচেয়ে কম পরিমাণ জিনিস নিয়ে আমরা চলে যাবো। সবার আগে বাদ দেবো সমস্ত বাসনকোসন। সবচেয়ে স্মৃতিবিজড়িত ব্যাপার বলে আমিই ওগুলিকে বাদ দেব স্থির করলাম। অপ্রয়োজনীয় জামাকাপড় লোকজনকে দিয়ে দিলাম। বিশেষত শাড়ি তখন আর আমি পরতে চাইলাম না। শাড়ি পরা অবস্থায় নিজেকে আয়নায় দেখলে চরম বিরক্তি আসতো। একটা খাট কিনেছিলাম, সেটা ভেঙে যাচ্ছে দেখে সারানোর ইচ্ছে রইল না। একদিন একজন বিক্রিওয়ালাকে ডাকা হল। হাতে করে ধরে ধরে বেচে দিলাম আমার হাতাখুন্তি, আটা মাখার গামলা, জলের গ্লাস, ভাতের থালা, বাটি, হাঁড়ি, কড়াই, চাল ধোয়ার ঝাঁঝরি,অজস্র তরকারি ঢালার বড় বাটি ঢাকনা, প্রেসারকুকার… সব। ইঁদুরে খাওয়া, না খাওয়া সমস্ত টাপারওয়্যার দূর করে বেচে দিলাম। এমনকি বাসন রাখার লোহার তাকগুলিকেও রেহাই দিলাম না। ভাঙা খাট না সারিয়ে বেচে দিলাম। শাড়িগুলিকে বাসনওয়ালীর কাছে দিয়ে নতুন চালের ড্রাম নিলাম।
সঙ্গে চলল আমাদের বইগুলি, বইয়ের তাক, একটা লোহার খাট, আলমারি, আলনা, কয়েকটি জামাকাপড় আর একমাত্র রান্নাঘরের জিনিস, ফ্রিজ। ফ্রিজ ছাড়া রান্নাঘরের কোনো জিনিসপত্রই আর সঙ্গে আনিনি।
এইবাড়ি থেকে সাময়িকভাবে আমরা একটি ভাড়াবাড়িতে উঠলাম। মাত্র দুইমাস আমরা সেখানে ছিলাম। যথারীতি সেই ক্ষুদ্র রান্নাঘর, রানিং ওয়াটার নাই, এই এতটুকু একটা গ্যাসের টেবিল…কাজ চালানোর জন্য একটা প্রেসার কুকার, খান দুই থালা আর একটা গামলা আর একটা খুন্তি কিনেছিলাম।
দুইমাস পরে আমরা আমাদের এখনকার বাসস্থান ফ্ল্যাটে চলে যাই। বাড়ি বিক্রির অর্ধেক টাকা আমার প্রাক্তন দাবী করেন নি, এ টাকা তাঁর প্রাপ্য ছিল। আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। ব্যাঙ্কের লোন শোধের পর বাকী টাকা একত্র করে ফ্ল্যাটটুকুই কেনা গেল। আমি আর বড়ছেলে মিলে অনেক ঘুরে এবং খুঁজে তবে এই ফ্ল্যাটটি পেয়েছিলাম। সত্যি সত্যি নিজের ঘরে নিজের রান্নাঘর হল এবার। আবার সেই প্রথমবারের মতো নতুন করে কিনলাম হাঁড়ি, কড়া খুন্তি গামলা আরো যা যা কিছু লাগে সব… এবারে সঙ্গী আমার দুই ছেলে। এই বাড়িতে আসার পরে পরেই আমি প্রাথমিক শিক্ষিকার চাকরি পেলাম। ছেলেদের ভরণপোষণ এখন একা নিজেই সামলাই, একফোঁটা সাহায্য কারো কাছ থেকে নিই না। নিজের মতো করে নিজের অর্জিত টাকায় একটু একটু করে রান্নাঘর সাজাচ্ছি। রান্নাঘরের দেওয়ালে নতুন টালি বসিয়েছি, রান্নাঘরের পাথরের গ্যাস টেবিল টি বেশ প্রশস্ত, ইংরেজি এল আকৃতির। এই রান্নাঘরে অনায়াসে দুইজন কাজ করতে পারে। এখন আমি আর টাপার ওয়্যার কিনি না। ছোট বড় নানামাপের কাঁচের বয়ামে রান্নাঘর সাজাচ্ছি। একটা এক্সজস্ট ফ্যান লাগিয়েছি, ইচ্ছে আছে ওটিকে কিচেন-চিমনি দিয়ে রিপ্লেস করার। একটি মিক্সি মেশিন কিনেছি, আগের ফ্রিজ খারাপ হওয়ায় কিনেছি ছোট একটি ফ্রিজ। এখন হাতে টেনিস এলবো হয়েছে, রান্না সেভাবে করতে পারি না, কিন্তু ছেলেদের রান্না শিখিয়েছি, ওরা আমার রান্নাঘরের যত্ন করে।
(ক্রমশ)