রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ১৪। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য
ক্ষীরের পায়েস
আমার এই ৪৬ বছরের জীবনে যে রান্নাঘরটির কথা না বললে রান্নাঘরের গল্প সম্পূর্ণ হবে না, এবার তার গল্প।
এই রান্নাঘরের মালকিনকে আমি প্রথম দেখি এক শীতকালীন সন্ধ্যায় তাঁর বড়ছেলের বাসায়। আমরা গিয়ে দরজার কড়া নাড়লে তিনি দরজা খুলে এক লহমা দাঁড়ালেন। নায়িকার মতো হিলহিলে শরীরে সেদিন তিঁনি গোলাপী রঙের সাধারণ ছাপা শাড়ী পরেছিলেন। শাড়ীর সৌন্দর্য, কে পরেছেন, কেমন ভাবে পরেছেন তার উপরই যে নির্ভর করে, তাঁকে দেখে আমার সেই কথাই মনে হচ্ছিল… তাঁর দুধে আলতা গায়ের রঙ সেই শাড়ির সাথে মিশে গেছিল, আর তেমনি টানা চোখ, তেমনি গোলাপী ঠোঁট… গোধূলি বেলার আলোতে এমন এমন অসামান্য সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটু যেন থমকে গেছিলাম…
এই মানুষটির রান্নাঘরে আমি প্রথম যেদিন পা রাখলাম, সে ও এক সন্ধ্যার সময়, সে ছিল এক রান্নাপুজোর সন্ধ্যা। আমার কোলে তখন ছয়মাসের রোদ্দুর। তাঁর রান্নাঘরটি তেমন কিছু বৈশিষ্ট্যের ছিল না, সাধারণ সাদামাটা রান্নাঘর, কিন্তু অতি আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল সেই রান্নাঘরের ব্যবস্থাপনা। তাঁর এই বিষয়টিতে আমার চিরকালীন মুগ্ধতা থাকবে।
তাঁর রান্নাঘরটি ছিল সিঁড়ির নীচে। সিঁড়ির ঠিক তলার অংশে রাখা থাকত কাঠের তৈরি বাসনের তাক। সেই তাকের পাশে জানালা। জানালার এপাশে একটি ছোট ওয়াশ বেসিন, সেই বেসিনেরই উপরে অ্যাকোয়াগার্ড। বেসিনের পাশে কলঘরে যাওয়ার দরজা। এই দরজা বরাবর ভিতর দিকে ছিল গ্যাসের টেবিল। কাঠের টেবিলের উপরে অ্যালুমিনিয়ামের চাদর লাগানো ছিল। এর উপর একটা লোহার ফ্রেমের মধ্যে গ্যাসের দুই বার্নারের উনুনটি বসানো থাকতো। অমন গ্যাসের উনুন বসানোর লোহার ফ্রেম আমি আর কোথাও দেখিনি। তাঁর কাছে শুনেছিলাম একেবারে প্রথম দফার গ্যাস কানেকশনের সময় এই লোহার ফ্রেম দেওয়া হয়েছিল। এই টেবিলের নীচের দিকে আরো দুটি তাক ছিল। সেই তাকের উপরের ধাপে থাকতো চায়ের বাটি আর এতবড় একটা স্টিলের মগ। এদের ঠিক পাশেই রাখা থাকতো একটি পাঁচ লিটারের প্রেসার কুকার। নীচের তাকে কম ব্যবহার হওয়া বাসনকোসন, যেমন বেশ বড় গামলা হাঁড়ি, এসব থাকতো। গ্যাসের টেবিলের ডানদিকে থাকতো গ্যাসের সিলিন্ডার। এই সিলিন্ডারের গোল হাতলকে ঘিরে থাকতো তিনখানা ন্যাতা। একটা খুব বেশি তেল ময়লা মোছার জন্য, একটা হালকা নোংরা মোছার জন্য, আরেকটা আপৎকালীন ব্যবহারের জন্য। গ্যাসের টেবিলের উপরে ছিল একটা ছোট কাঠের দুই ধাপের তাক। এই তাকের একটা ধাপে থাকতো চায়ের কাপ এবং প্লেট। নিচের ধাপে রান্নার মশলা… নুন চিনি হলুদ জিরে ধনে, আর চা-পাতা। আনাজপাতি কাটাকুটি করার জন্য ছিল বঁটি। সেই বঁটি থাকতো সিঁড়ির তলায় সবচেয়ে নীচু অংশের দেওয়াল ঘেঁষে। আর রান্নাঘরের যাবতীয় ভাঁড়ার থাকতো শোওয়ার ঘরের দুটি দেওয়াল আলমারি আর একটি মিটসেফে।
এই ছিল তাঁর রান্নাঘর। সাধারণের চেয়েও সাধারণ। কিন্তু এই রান্নাঘরের চমক ছিল অন্য জায়গায়।
সকালবেলা উঠে প্রথমেই রান্নাঘরে চা করা হত। ব্যবহৃত চায়ের পাতা গুলি নিয়ে গিয়ে রাখতাম রান্নাঘরে ওপাশে টানা বারান্দার কোণে একটা মাটির মালসায়। সকাল বিকেলের চা পাতা ছাড়া অই একই মালসায় জমা পড়ত সেদ্দ ডিমের খোসা। মালসা ভর্তি হয়ে গেলে ওগুলি চলে যেত সামনের বাগানে, এবার ওরা গোলাপ গাছের সার হবে।
চা পানের পর শুরু হত রান্নার জন্য আনাজপাতি কোটা। ডালনার আনাজ ঝোলের আনাজ পাঁচমিশালি তরকারির আনাজ যে আলাদা নিয়মে কাটতে হয়, তা আমি এঁর কাছেই শিখেছি। ডালনার পটল না চিরে গোল গোল ডুমো করে কাটা, আর ঝোলের পটল পেট চিরে আবার তাকে আড়াআড়ি করে পোঁচ দিয়ে কাটতে হয় এ আমি জানতামই না। আনাজ কাটার পর আনাজের খোসাগুলিকে একটু বেশি ছোটো ছোটো টুকরো করে সিঁড়ির লোহার রেলিং এ ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগে তুলে রাখতাম। ঐগুলি এবার সহায়িকা দিদির পোষা গরু খাবে। কোনো কোনো দিন হয়ত সহায়িকা দিদি ভুলে গেলেন আনাজের খোসা নিতে, তখন সেই খোসা ভর্তি ব্যাগ চলল পুকুর পানে। খোসাগুলি এবার মাছেদের খাবার হবে।
রান্নার জন্য যে মাছ, বাজার থেকে আসতো, তাদের ধুয়ে মাছের আঁশ-পোঁটা গুলি ফেলতে যেতাম পাঁচিলের ওই কোণে। ওখানে দুটো হুলো আর মেনি চোখ বুঝে ধ্যান করতো, এমন সময় আমি যেতাম সুজাতা হয়ে পায়েসের থালা হাতে! ওদের কী আর তখন ধ্যানে মন থাকে!!?
এইবার রান্না চড়বে। এর মধ্যে প্রায় আধঘন্টা আগে চাল, ডাল ভিজিয়ে রাখা হয়েছে। আনাজ কাটাও সারা। সিঁড়ির রেলিং এ আরেকটি ঝোলানো ব্যাগ থেকে বেরোবে প্লাস্টিকে মুড়ে রাখা আনাজপাতি সিদ্দ করার কাপড়। পুরোনো সাদা ধুতি মাপমতো চৌকো করে কেটে সেই কাপড় তৈরি হত। এক-একটি কাপড়ে এক-একটি তরকারির আনাজ রেখে তাদের কাপড় মুড়ে বেঁধে ফেলা হত। ডাল ও বাঁধা পড়তো অমন একটি কাপড়ে।
সমস্ত কাপড় মোড়া আনাজ ডাল এবার গিয়ে ঢুকবে সেই পাঁচ লিটার প্রেসার কুকারের পেটে। তাতে পরিমাণ মতো জল দিয়ে, সব তরকারি আর ডালের পোঁটলা ভরে বসানো হবে গ্যাসের উনুনের উপর। দুটি সিটি পড়লে গ্যাস বন্ধ হবে। এদিকে প্রেসার কুকার চাপানোর পর পরই আরেকটা উনুনে কড়াই বসেছে মাছ ভাজার জন্য। মাছভাজা সারা হতে হতে প্রেসারকুকারের ঢাকনা গিয়েছে খুলে। এখন একেকটা বাটিতে একেকটা তরকারির সব্জি ঢেলে তাতে প্রয়োজনীয় মশলাগুলিও দিয়ে দেওয়া হত। সব্জি সেদ্দর জলটুকু যাবে ডালের বাটিতে। এবার তো টপাটপ কড়াইতে তেল আর ফোড়ন পড়বে, আর চট করে সেই তরকারি রান্না হয়ে যাবে। এতে গ্যাসও বাঁচল, রান্না করার সময় ও লাগলো নামমাত্র। তাঁর হাতের গুণে এইসব রান্নার স্বাদ ও হত দারুণ! আমরা তো চেটেপুটে খেতাম।
খুব গুছিয়ে ভাত বাড়তেন তিঁনি। চূড়ো করা ভাত, ভাতের পাশে কোনো একটা ভাজা বা তরকারি, লেবুর টুকরো সহ স্যালাড পর পর থাকতো। পাশে থাকতো বাটিতে করে মাছ বা মাংসের ঝোল। ডাল বা অন্য তরকারিগুলি পাতেই দিতেন। আর শেষ পাতে চাটনি থাকলে আমাদের খাওয়া যেন শেষ হতেই চাইতো না, আরেকটু চাটনি, আরেকটু বসে বসে গল্প…
খাওয়া দাওয়ার পর কুড়োবাড়া নিয়ে আমি আবার যেতাম সেই পাঁচিলের পাশে, সেই হুলো এবং মেনির কাছে।
খেয়ে ওঠার পর আবশ্যিক ভাবে খেতাম জোয়ান এবং মৌরি। সেই জোয়ান আর মৌরির শিশি যে কত আগের! কত না যত্নে তাদের তিঁনি রাখতেন। খেয়ে উঠে মাঝেসাঝে দাঁত খোঁটার দরকার পড়তো। সেটিও তাঁর নিজের তৈরি। দেশলাইয়ের পুড়ে যাওয়া কাঠির পোড়া অংশটুকু তিঁনি ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলে, বাকি অংশের একটি দিক সূঁচালো করে কেটে নিতেন। দেশলাইকাঠি না জমলে নারকেলপাতার কাঠি ও ব্যবহার করতে দেখেছি দাঁতখোটা বানানোর জন্য।
রাতের বেলা খাওয়া দাওয়ার পর পাতকুড়ানো গুলি ফেলতে যাওয়া যেত না। অথচ পুরোনো বাড়ির আনাচ কানাচ থেকে ঠিক ইঁদুর বেরিয়ে সবকিছু ছত্রখান করবে, সেইজন্য সব এঁটোকাটা বাটিতে ভরে তিনি প্রেসারকুকারের মধ্যে চালান করে তার মুখ এঁটে দিতেন। ইঁদুররা যতই ঘুরঘুর করুক কিছুতেই আর সেগুলিকে হস্তগত করতে পারতো না।
এই ছিল তার রান্নাঘরের ব্যবস্থাপনা। প্রতিটি জিনিসের একশো শতাংশ ব্যবহার ছিল তাঁর প্রধান ভাবনা। এসব কথার কথা তো অনেক শুনেছি, কিন্তু তাকে যে এমন করে ব্যবহারিক জীবনে ও আনা সম্ভব, তাঁর রান্নাঘরে না এলে আমি বিশ্বাস করতেও পারতাম না।
তাঁর এই নীতিতে ভরপুর বিশ্বাস রেখে আমি এই রান্না ঘরেই একবার তৈরি করে ফেলেছিলাম এঁচোড়ের কচুরি। কী এক কারণ বশত: সেদিন এঁচোড়ের তরকারি একেবারেই জমলো না। তখন সেই তরকারিকে ঠেসে মেখে জম্পেস করে গুঁড়ো মশলা নুন মিষ্টি ছড়িয়ে আমি একটা পুর বানালাম, তাই দিয়ে বানালাম এঁচোড়ের কচুরি। স্যালাড সহযোগে পরিবেশন করলাম। বেশ প্রশংসিত হয়েছিলাম মনে পড়ে। আর একবার বানিয়েছিলাম ইলিশ মৌলি। রান্নার পর গরম গরম তা একেবারেই ভালো খেতে লাগলো না, কিন্তু ফ্রিজে রাখার পর তার স্বাদ এমন খুলে গেল যে আমরা সবাই খুব চমৎকৃত হয়েছিলাম। এই রান্নাঘর থেকেই আমি খেয়েছি পৃথিবীর সেরা স্বাদের পায়েসটি এবং তার রন্ধন প্রণালী শিখেওছি। প্রেসারকুকারে এইটুকুমাত্র সময়ে যে এমন স্বর্গীয় স্বাদের ক্ষীরের পায়েস বানানো যে সম্ভব, তা আমি না দেখলে এবং চাখলে ভাবতেও পারতাম না!
এই অসামান্য রান্নাঘরটি আমার প্রাক্তন শাশুড়ি মায়ের।
(ক্রমশ)