ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : ছাব্বিশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের পর অস্ট্রেলিয়া দল বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জয়ী হয়। তারই মধ্যে একটা লীগ ম্যাচে জয়ী হয় নিউজিল্যান্ড। বাইসেন্টিনাল কাপে ইংল্যান্ডকে হারায় আর উইলস চ্যালেঞ্জ এ টাই করে পাকিস্তানের সঙ্গে। কিন্তু পরের বেন্সন অ্যান্ড হেজেস কাপ জিততে পারেনি তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়। লিগেও তিনটি ম্যাচ হারে যার একটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। টেক্সাকো ট্রফি সিরিজ ১-১ এ ড্র হয়। নেহরু কাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর শ্রীলঙ্কা ছাড়া ভারত, পাকিস্তান আর ইংল্যান্ড কে হারাতে পারেনি।
১৯৮৯/৯০ এর বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জয়ী হয় তারা, রথম্যানস ট্রায়াঙ্গুলার ও জয়ী হয়। অস্ট্রেলিয়া কাপ অবশ্য হারে। আবার বেনসন অ্যান্ড হেজেস জয়ী হয়। এরপর কেবল অ্যান্ড ওয়ারলেস সিরিজ জয় করে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৪-১ এ।
এরপরে আসে ঠিক বিশ্বকাপের আগের বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ। প্রথম খেলায় অস্ট্রেলিয়া চূড়ান্ত পর্যুদস্ত হয়। ভারত প্রথমে ব্যাট করে ২০৮/৭ তোলে। শ্রীকান্ত ৬০ বলে ৬০ করেন। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ৩৭.৫ ওভারে ১০১ রানে অল আউট হয়। শাস্ত্রী ১৫ রানে ৫ উইকেট নেন। দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতকে (১৭৫) হারায় ৮ উইকেটে। বুন অপরাজিত ১০২ করেন। তবে এই রান তুলতে অস্ট্রেলিয়ার ৪৮.৩ ওভার লেগেছিল। বুন একাই ১৬৮ বল খেলে।
এরপর অস্ট্রেলিয়া (১৭৩) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (১৬৪) হারিয়ে দেয়। প্রবল লড়াই হয়েছিলো। এরপর ভারতকে (১৫৭) ৮ উইকেটে হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। এরপর ভারত আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৫১ হারিয়ে দেয়। কিন্তু পরের ম্যাচে আবার ১২ রানে হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। শেষ লীগ ম্যাচে ভারতকে ৯ উইকেটে হারায়।
এরপর প্রথম ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ২৩৩/৫ তোলে। জবাবে ভারত ১৪৫ রানে শেষ। দ্বিতীয় ফাইনালে ভারত প্রচুর লড়াই করে ৬ রানে হেরে যায়।
বিশ্বকাপের আসর বসে অস্ট্রেলিয়া – নিউজিল্যান্ডে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর জিম্বাবুয়ে ছাড়া অন্য দলকে হারাতে পারেনি তারা। সেমি ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয় অস্ট্রেলিয়া। সবথেকে বড় কথা, শ্রীলঙ্কাকে হারাতে ব্যর্থ হয় অস্ট্রেলিয়া। ২-১ সিরিজ হারে শ্রীলঙ্কার মাটিতে। এরপর বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। ব্যাংক অফ নিউজিল্যান্ড সিরিজে ৩-২ এ জিতলেও দুটি ম্যাচের একটা ১ উইকেটে অন্যটা ৩ রানে জেতে। নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কার কাছে চাপে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। টেক্সাকো ট্রফি ৩-০ য় জিতলেও দুটি খুব ক্লোজ ম্যাচ ছিল। বেনসন অ্যান্ড হেজেস জিতলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালকে তৃতীয় ফাইনালে নিয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে গিয়ে ওডিআই সিরিজ ৪-৪ এ ড্র করে। একটা খুবই ক্লোজ ম্যাচ জেতে। পেপসি অস্ট্রেলিয়া কাপের সেমি ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নেয় তারা।
১৯৯৩/৯৪ সালে সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপে হেরে যায় ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। উইলস ট্রাঙ্গুলার জিতে যায় যদিও। এরই মাঝে, বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপে দুটো দল নামায় তারা। যদিও ক্লোজ ম্যাচ ছিল কয়েকটা। তার ওপর ব্যাংক অফ নিউজিল্যান্ড সিরিজে ভারতের বিরুদ্ধে পরাজয় মেনে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বকাপ ১৯৯৬ এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৪-১ সিরিজ হারে। তাছাড়া বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জিতলেও খুব ক্লোজ কিছু ম্যাচে ফয়সালা হয়। বিশেষ করে ফাইনাল দুটি। শ্রীলঙ্কার উত্থান এই সময় লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়া প্রচুর চাপে ছিল।
বিশ্বকাপে লীগের খেলায় অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কাকে ওয়াক ওভার দেয়, ভারতের বিরুদ্ধে মাত্র ১০ রানে জয়ী হয় আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে হেরে যায়। জিম্বাবুয়ে আর কেনিয়ার বিপক্ষে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে তারা। চেন্নাইয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ক্রিস হ্যারিসের ১২৪ বলে ১৩০ এর জন্য নিউজিল্যান্ডের করা ৯ উইকেটে ২৮৬ রান তাড়া করে। অস্ট্রেলিয়া ৪৭.৫ ওভারে ২৮৯/৪ তুলে জিতে যায় মার্ক ওয়ার ১১০ রানের জন্য।
মোহালির সেমি ফাইনালে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্টুয়ার্ট ল (৭২) আর বিভান (৬৯) দলকে ১৫৩ এ টেনে নিয়ে যায়। শেষে হিলি ২৮ বলে অপরাজিত ৩১ করলে অস্ট্রেলিয়া ২০৭/৮ করে। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪১.১ ওভারে ১৬৫/২ করে ফেললেও চন্দ্রপল (৮০) আউট হয়ে গেলে রিচার্ডসনের ৮৩ বলে অপরাজিত ৪৯ ব্যর্থ হয় ও অস্ট্রেলিয়া ৫ রানে জিতে যায়। ওয়ার্ন (৪/৩৬) তুলে জিতিয়ে দেয়।
ফাইনালে অবশ্য অরবিন্দ ডি সিলভার অপরাজিত ১০৭ শ্রীলঙ্কাকে চ্যাম্পিয়ন করে। এরপর শুরু হয় ব্যর্থতার দিনের। সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপে রানার্স হয় তারা, কার্লটন ইউনাইটেড সিরিজের ফাইনালেই উঠতে পারেনি। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪-৩ এ ওডিআই সিরিজে হারায়। এরপর টেক্সাকো ট্রফিতে ৩-০য় হার, কার্লটন ইউনাইটেড সিরিজে তৃতীয় ফাইনালে গিয়ে জয়, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজে ২-২ ফলে ড্র, সময় টা খুব ভালো যাচ্ছিল না অস্ট্রেলিয়ার। ভারতে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতলেও শচীনের মরুঝড়ে শারজাহ হাতছাড়া হয়, উইলস ইন্টারন্যাশনালে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নেয় তারা। কিন্তু পাকিস্তানে গিয়ে ৩-০ ব্যবধানে ওডিআই সিরিজ জয় করে। শেষ ম্যাচে ৩০০+ তাড়া করে জয়ী হয় ওডিআই ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় দল হিসেবে।
এই প্রসঙ্গে এই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বিখ্যাত আইকন ক্রিকেটার শেন ওয়ার্নের সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক।
প্রথম টেস্ট খেলার সুযোগ পান শেন কিথ ওয়ার্ন ভারতের বিরুদ্ধে। তখন প্রথম শ্রেণির খেলায় ৫ ম্যাচে প্রায় ৭০ স্ট্রাইক রেট আর ৩৮ গড়ে ওয়ার্নের সংগ্রহ ১১ উইকেট, সঙ্গে ১৬- র কম গড়ে ৭৭ রান।
সিডনির সেই টেস্টে ভারত একটুর জন্য জিততে পারেনি। প্রথম ইনিংসে ওয়ার্ন যখন ব্যাট হাতে নামেন তখন অস্ট্রেলিয়া ২৬৯/৮। তিনটে ভারতের অভিষেক হওয়া বাঙালি ফাস্ট মিডিয়াম বোলার সুব্রত ব্যানার্জি ৩টি, প্রভাকর ৩টি ও কপিলদেব ১টি নিয়েছে। ওয়ার্ন নেমে ৭১ মিনিট কাটিয়ে যখন আউট হলেন ২০ করে, তখন অস্ট্রেলিয়া ৩১৩। ওই রানেই ইনিংস শেষ হয়।
সেই রিচি বেনোর পরে কোনও লেগ স্পিনার ভারতকে বেগ দেয়নি। এখানেও তার উল্টো কিছু হলো না। ওয়ার্ন ৪৫ ওভারে ১৫০ রান দিয়ে কেবল রবি শাস্ত্রীর উইকেট পেলেন, তাও তখন দলের রান ৩৯৭। শাস্ত্রী ২০৬। সাড়ে নয় ঘন্টা ব্যাট করে ১৭টা চার ও ২টো ছয় মারেন তিনি। শচীন করেন অপরাজিত ১৪৮। ভারত ৪৮৩ তোলে। ১৭০ রানের লিড।
বাকি সময়ে অস্ট্রেলিয়া কে ১৭১/৮ করে দিয়েছিল ভারত। হয়তো জিতে যেত। কোনও অজ্ঞাত কারণে প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট পাওয়া সুব্রত কে বল করতে দেননি আজহার।
এমন কিছু প্রভাব ওয়ার্ন ফেলতে পারেননি।
এরপরে আগস্ট মাসে অস্ট্রেলিয়া গেলো কলম্বোয় একটা টেস্টের সিরিজ খেলতে। প্রথম ওয়ার্ন নজরে এলেন এই সিরিজে।
হাতুরাসিংঘে, রমানায়েকে আর বিক্রমাসিংঘে(উইকার্মা লেখা থাকতো বাংলা খবরের কাগজে) অসিদের রান ১২৪/৭ করে দেয়। তখন ইয়ান হিলি (অপরাজিত ৬৬) প্রথমে ম্যাকডর্মটকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টম উইকেটে তুললেন ৩৮ রান (৩৯ মিনিটে)। ম্যাকডর্মট আউট হতেই নামলেন ওয়ার্ন (২৪)। নবম উইকেটে ৭৫ মিনিটে যোগ হলো ৪৫। শেষ উইকেটে হুইটনি(১৩) কে সঙ্গে নিয়ে ৪৯ যোগ করলেন হিলি। অস্ট্রেলিয়া ভদ্রস্থ ২৫৬ রান তুললো। হাতুরাসিংঘে ৬৬ রানে ৪ উইকেট ও রমানায়েকে ৫১ রানে ৩ উইকেট নেন।
এরপর মহানামা ৭৮, গুরুসিংঘে ১৩৭, রনতুঙ্গা ১২৭ ও কালুবিতরণে অপরাজিত ১৩২ করায় শ্রীলঙ্কা ৫৭০/৮ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। ওয়ার্ন ২২ ওভারে ১০৭ রান দেয়। ম্যাথু ৯৩ রানে ৩ উইকেট পান।
২১৪ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া লড়াইয়ে ফিরে আসে। বুন, জোন্স, ম্যাথু, মার্ক ও হাফ সেঞ্চুরি করেন, ওয়ার্ন ৩৫, ম্যাকডরমট ৪০, মার্ক টেলর ৪৩ করায় অস্ট্রেলিয়া ৪৭১ রান তোলে।
জয়ের জন্য শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ২৫৮। শেষ দিন হাতে বেশি সময় নেই। টি এর সময় শ্রীলঙ্কা ২৯/২। খেলা শেষ হতে মেরে কেটে যখন ৪৫ মিনিট বাকি, হাতে মাত্র ১৫ ওভার, শ্রীলঙ্কা ১২৭ তুলেছে ২ উইকেট হারিয়ে, এমন সময় একদিকে ম্যাথুজ (২০-২-৭৬-৪) অন্যদিকে ওয়ার্নের ভেল্কি (৫.১-৩-১১-৩) শুরু হলো। মুহুর্তে শ্রীলঙ্কা ১৬৪ রানে শেষ। সেই শুরু হলো ওয়ার্নের।
অস্ট্রেলিয়ার লেগ স্পিন ঐতিহ্য আজকের নয়। শক্ত মাটিতে বল তাড়াতাড়ি ঔজ্জ্বল্য হারায় ও আকৃতি বিগড়ে যায়, বল নরম হয়ে যায়, ফলে স্পিনারদের তখন রমরমা দাপট ছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে। সেই বিশ শতকের প্রথম দিকে আর্থার মেইলি ২১টি টেস্টে ৯৯টি উইকেট নেন। এরমধ্যে দেশের মাটিতে ১০টি টেস্টে ৬০টি। প্রায় সমসাময়িক ক্ল্যারি গ্রিমেট (তিনিও মেইলির মতো লেগ স্পিনার) ছিলেন আরও ভয়ঙ্কর। ৩৭টি টেস্টে ২১৬টি উইকেট নেন। এরমধ্যে দেশের মাটিতে ১৯ টেস্টে ১০৫ উইকেট নেন। অবশ্য ইংল্যান্ডে (১৩ টেস্টে ৬৭) বা দক্ষিণ আফ্রিকায় (৫ টেস্টে ৪৪) মোটেই সাধারণ নয়। স্ট্রাইক রেট ছিল ৬৭.১। গড় ২৪.২১। মনে রাখতে হবে এই পারফরম্যান্স প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের, যখন পিচ অনেকটা ব্যাটিং ফেভার্ড (শুনে মোটেই অবাক হবেন না, ১৯২০-২১ নাগাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ক্রিকেট খেলা চালু হলে, আজ অবধি মাত্র তিনটি মাত্র দশক জুড়ে বোলারদের দাপট দেখা গেছে, ১৯৫০-৫৯, ১৯৯০-৯৯[ভালো করে বললে ১৯৮৬-১৯৯৭] এবং ২০১৫- চলছে এখনও অবধি। এতেই গ্রিমেটের গুন বোঝা যাবে। মেইলীর স্ট্রাইক রেট (৬১.৮) ভালো হলেও গড় সুবিধার নয়(৩৩.৯১)।
আরেক কিংবদন্তীতুল্য বোলার ছিলেন রিচি বেনো। ৬৩টি টেস্টে ২৭.০৩ গড়ে তিনি ২৪৮ উইকেট পান। স্ট্রাইক রেট যদিও ৭৭। বেনো শেষ লেগ স্পিনার যিনি ভারতকে এক প্রকার নাচিয়ে ছিলেন (৮ ম্যাচে ৫২ উইকেট)। তাঁর পরে ভারতকে আর কোনো লেগ ব্রেক স্পিনার সমস্যায় ফেলেনি।
দেখাই যাচ্ছে, ১৯৯২-৯৩ সাল নাগাদ অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অবস্থা খুব সুবিধের ছিল না। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এই সিরিজেই শেষবার টেস্ট খেলেন টনি ডোডমেড, টম মুডি ও ডিন জোন্স।
তাছাড়া টেস্ট ম্যাচে সামান্য হলেও অস্ট্রেলিয়া সমস্যার সামনে ছিল। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপ থেকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ অবধি তাঁদের ৪১টি টেস্টে পরাজয় ছিল দুটি। সাফল্যের হার ছিল ৫৩.৬৫%। কিন্তু ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ অবধি সেই সাফল্যের হার সামান্য কমলেও (৫২.২৭%) পরাজয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮টি।
একদিনের ম্যাচে ৭৫টি খেলায় ৫৫টি জয় ছিল ১৯৮৭ বিশ্বকাপ থেকে-১৯৯১/৯২ বিশ্বকাপের আগে অবধি। পরাজয় হয়েছিল ১৮টি ম্যাচে। ৭৩.৩৩ % সাফল্যের হার। ব্যর্থতার হার ২৪%। কিন্তু ১৯৯১/৯২ সালের বিশ্বকাপে ৮টি ম্যাচের ৪টি জিতে ৪টি হেরে বিদায় নেয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় অ্যালান বর্ডারের। শুধু গাভাস্কারের রেকর্ড ভাঙার জন্যই তিনি খেলে যাচ্ছিলেন। এরপর বেশিদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেননি তিনি।
১৯৯৬ এর বিশ্বকাপের মধ্যে অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়। ৭২টি ম্যাচে জয়ের সংখ্যা নেমে আসে ৪৪ এ। সাফল্যের হার ৬১%। পরাজয় ২৭টি খেলায়। ৩৭.৫% ব্যর্থতার হার।
এই পর্বেই উত্থান ঘটে শেন ওয়ার্নের।
১৯৯২-৯৩ এর মেলবোর্ন টেস্ট। খেলার শেষ দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেতার জন্য দরকার ৩২৭। হাতে আছে ৯ উইকেট। ফিল সিমন্স, রিচি রিচার্ডসন, ব্রায়ান লারা, কিথ আর্থারটন, কার্ল হুপার, জিমি অ্যাডামস ব্যাটিং করা বাকি। লাঞ্চের সামান্য আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৪৩/১। রিচার্ডসন ৫২ রানে আর সিমন্স ৮০ রানে ব্যাটিং। আর দুটো সেশন, জিততে হলে দরকার ২১৬। হাতে ৯ উইকেট। এই সেশনে ১১১ রান উঠেছে। এমন সময় ভেল্কি শুরু হলো ওয়ার্নের। ওয়ার্ন বোল্ড করলেন রিচার্ডসন কে। লাঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৪৪/২। লারা নেমেছেন।
লাঞ্চের পর চোখে সর্ষেফুল দেখলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টি অবধি খেলাই হলো না। ২১৯ রানে শেষ ক্যারিবীয়রা। ওয়ার্ন ৫২ রানে ৭ উইকেট। সিমন্স ১১০ না করলে অবস্থা আরও খারাপ হতো। বলে রাখা ভালো, এই সিরিজের একটা ট্যুর ম্যাচে দু ইনিংস মিলিয়ে ৫ উইকেট নেন ওয়ার্ন। প্রথম টেস্টে তাও সুযোগ হয়নি। যদি পেতেন তাহলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনোভাবেই ম্যাচ বাঁচাতে পারত না। ইয়ান বিশপ শেষের দিকে প্রায় দু ঘন্টা ব্যাট করে ম্যাচ ড্র করিয়ে দেন। ওয়ার্ন থাকলে পারতেন না।
পরের টেস্ট সেই বিখ্যাত সিডনি। যে টেস্টে ২৭৭ করেছিলেন বলে লারা তাঁর মেয়ের নামকরণ করেন সিডনি। স্বভাবতই ওয়ার্ন চূড়ান্ত ব্যর্থ। তার পরের টেস্টে মাত্র এক রানে জয়ী হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুই দশকের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ছে দেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ টেস্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম ইনিংসে অ্যামব্রোজ (২৫/৭) ও দ্বিতীয় ইনিংসে বিশপ (৪০/৬) পুরো ঝাঁঝরা করে দেয় অস্ট্রেলিয়া কে। মাত্র ৩২২ রানের পুঁজি নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের ব্যবধানে জয়ী হয়।
কিন্তু এই সিরিজের ওই একটি ম্যাচ দেখালো ওয়ার্ন কি করতে পারেন।
পরের সিরিজ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ওয়ার্ন তিন টেস্টে ১৭ উইকেট পান।
এরপরেই অস্ট্রেলিয়া খেলতে যায় ইংল্যান্ডে। শেন ওয়ার্নের ‘স্পিনের জাদুকর’ হওয়ার সূত্রপাত হলো এই সফর থেকে। প্রথম টেস্ট ছিল ওভারে ৩-৭ জুন। প্রথম টেস্টের আগে ৫টি প্রথম শ্রেণির খেলায় ওয়ার্নের উইকেট সংখ্যা ছিল ১৯। কোনও odi বা লিস্ট এ (ঘরোয়া ওয়ানডে) ম্যাচে তাঁকে খেলানো হয়নি।
প্রথম দিন অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করতে নেমে ৫ উইকেটে ২৪২ তোলে। দ্বিতীয় দিন ২৯৯ রানে অল আউট হয়। টেলর ১২৪ আর স্লেটার ৫৮ না করলে অবস্থা খুব খারাপ হতো। পিটার সাচ কেরিয়ারের সেরা (৬৭/৬) পারম্যান্স করেন। লাঞ্চের সময় ইংল্যান্ড বিনা উইকেটে ১১। প্রথম উইকেটে ৭১ রান তোলেন গুচ (৬৫) ও আথার্টন (১৯)। হিউজের বলে আথার্টন আউট হতেই নামলেন গ্যাটিং। বল করতে এলেন শেন ওয়ার্ন। তখন ২৭ ওভারের পুরোনো বল। ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট ডেলিভারী শেন ওয়ার্নের।
ডান হাতি গ্যাটিং দেখলেন ওয়ার্ন ওভার দ্য উইকেটে গিয়ে একটা লেগ ব্রেক দিলেন। বলটা আসছিল সোজা, কিন্তু ড্রিফট করে ডান দিকে সরে গেলো, অভিজ্ঞ গ্যাটিং বাঁ-পা লেগের দিকে নিয়ে গেলেন প্যাড ও ব্যাটকে একসঙ্গে করে, যাতে বল সোজা এলে প্যাডে লাগে, তাহলে বলটি যেহেতু লেগের বাইরে পড়েছে তাই এলবিডব্লিউ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, যদি আরও টার্ন করে, তাহলে ব্যাটে লাগবে, ব্যাট যেহেতু নীচু করা, বলটিতে ক্যাচ উঠবে না।
কিন্তু বলটা লেগে আরও টার্ন করে পড়লো বোলারদের করা পায়ের তৈরী পিচের ওপর ক্ষতের ওপর, আরও টার্ন করে বলটি অস্বাভাবিক ভাবে অফ স্টাম্পের বেল ফেলে দিয়ে গেলো। গ্যাটিং হতভম্বব, আম্পায়ার ডিকি বার্ড বিস্ফারিত নেত্রে দেখছেন কী হলো!
একেই বলে বল অফ দ্য সেঞ্চুরী। লেগ স্পিন পুনরায় জন্মালো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
এরপর ওয়ার্ন পিছনে ফিরে তাকানোর কথা ভাবেননি। ৫টি টেস্টে ৩৪টি, বাকি প্রথম শ্রেণির খেলায় আরও ৪১টি উইকেট তুলে নেন ওয়ার্ন।
এরপরের ঘটনা বলবার আগে ১৯৮৬/৮৭-৯৮/৯৯ টেস্টে তাঁদের অবস্থান আলোচনা করা যাক।
(ক্রমশ)