খড়কুটোর জীবন : হারিয়ে যাওয়া মুখগুলি । পর্ব ১৩ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
ডোবার পাশে ছোটো ছোটো অসংখ্য তাল গাছ। কোনোটা সোজা হয়ে হাত পাঁচেক উঠেছে। কোনোটা বেঁকে গেছে ডোবার জল খাবে বলে। সবুজ পত্র বিছিয়ে পুরোটাই যেন তালসাড়ি বিচ। পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে মেঠো পথ। এর মধ্যে ডোবার ঈষাণ কোণে তেমাথাতে এক যুবক বট। আর পশ্চিম দিকে পথের পাশেই বিশাল কদম। আর ডোবার উত্তরে টিন- টালির পাকা দেওয়ালের অনুচ্চ পাঁচিল আর পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা বাড়ি। রাস্তার দিকে আলকাতরা লাগানো কাঠের বড়ো দরজাওয়ালা একটা টালির ভাঙাচোড়া দোকান ঘর। আর এই বাড়ির মালিক নন্দলাল প্রামাণিক। লোকে বলে নন্দ নাপিত। নাপিতকে যে নরসুন্দর বলে তা পরে জেনেছিলাম। আমি নন্দ নাপিতকে দাদু বলে ডাকতাম। বাবা জামাই বলতো। কেননা নন্দ নাপিতের বিয়ে হয়েছিলো আমাদের গ্রামেই ফকির প্রামাণিকের বোন ঝুড়িবালার সঙ্গে। আমরা বলতাম ঝুড়ি ঠাকমা । বাবা তাকে পিসি বলে ডাকতো। আমার মেজ আর ছোটো দাদুকে নন্দ নাপিত মেজদা আর ছোটদা বলে ডাকতো। পারিবারিক একটা সম্পর্ক ছিলো একটা।
তো এই নন্দ দাদু গ্রামে সমস্ত ক্ষৌরকার্য করতো। আমরা এখন যেমন সেলুনে বা পার্লারে গিয়ে নগদ পয়সার বিনিময়ে নিজেদের সুন্দর করি নন্দ দাদুর ব্যপারটা ছিলো একটু অন্য রকম। তিনি ছিলেন গ্রামের জেউ-এর নাপিত। ব্যাপার টা হলো এই রকম — নন্দ দাদু গ্রামের পরিবারগুলির সারা বছরের ক্ষৌর কর্ম করবেন। পরিবর্তে প্রতিটি পরিবারের পুরুষ সদস্য সংখ্যা পিছু নির্ধারিত পরিমাণের শস্য তিনি পাবেন । দেখতাম ধান কিংবা গম উঠলেই নন্দ দাদু বস্তা হাতে বাড়ি বাড়ি পৌছে যেতো। সংগ্রহ করতেন ধান, গম বা অন্যান্য ডাল শস্য। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এগুলির উপরেই তাকে সারা বছর ভরসা করতে হতো।
এছাড়াও তাঁর কিছু অন্য উপার্জন ছিলো। গ্রামে কোনো পরিবারের পূজা, শ্রাদ্ধ বা মাঙ্গলিক ক্রিয়াতেও তার ডাক পড়ত। কেননা নাপিত- বামুন ছাড়া এসব সম্ভব হতো না। কারোর বাড়িতে পূজা হলেই নন্দ দাদুকে দেখতাম ফুল, বেলপাতা, বেলকাঠ, হোমের বালি, কলাপাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়ে পূজা শুরুর আগেই হাজির হতেন। পূজা শুরু হলে ঠাকুর মশাই-এর জোগাড়ের কাজ করতেন। কখনো গঙ্গা জল জোগাচ্ছেন তো কখনো পঞ্চপ্রদীপের সলতে ভেজাচ্ছেন সর্ষের তেলে, কখনো নারকেলের ছোবড়া কেটে মাটির ধুনুচিতে ধুনোর আগুন করছেন — এই রকম কতটা কাজ। হাঁকডাক করে বাড়ির গিন্নীর কাছে চেয়ে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। পূজা শেষে দেখতাম তিনি পেয়েছেন একটা নতুন গামছা, সিধে আর কিছু প্রসাদ। যে প্রসাদে আমরা ছোটোরা অনেক সময় ভাগ বসাতাম। তিনি হয়তো কারোর বাড়ির পূজা শেষে বাড়ি ফিরছেন রাস্তায় আমাদের দেখে বলতেন প্রসাদ নিয়ে যা। একটা কদমা বা বাতাসা বা একটা ঠোঁটে কলা ধরিয়ে দিতেন পরম স্নেহে। এসব কাজের জন্য তিনি নগদ অর্থ সামান্যই পেতেন। কেউ মারা গেলে ক্ষৌরকার্যের দিন তিনি চলে যেতেন পুকুর পাড়ে। গোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা একে একে পুকুরের জলে মাথা ভিজিয়ে তার সামনে বসে পড়তো। একই হাতে তিনি প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের মাথা নেড়া করে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে নখ খুঁটে কার্য সমাধা করতেন। মেয়েদের অশৌচ মুক্ত করতে নরুণ দিয়ে বাঁ-হাতের নখ খুঁটে দিতেন। এর জন্য তিনি কিছু অতিরিক্ত অর্থ পেতেন জেউ-এর বাইরেও । এছাড়াও কারো সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সাত দিনের দিন তিনি নতুন মা আর নব জাতকের নখ খুঁটে পরিশুদ্ধ করে দিতেন। একে গ্রামে বলে আঁচি কামানো। সাধ ভক্ষণ বা পাঁচফলে বা বারব্রতে বা বিবাহ কার্যে থাকতো তার উজ্বল উপস্থিতি। বিবাহের দিন নববরের ক্ষৌরকার্য তিনিই করতেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে আসতেন ঝুড়ি ঠাকুমা। বাড়ির সমস্ত মেয়েদের আলতা পরিয়ে দিয়ে যেতেন। গৃহপ্রবেশ বা জাতকর্ম বা পুকুর প্রতিষ্ঠাতেও হাজির থাকতেন নন্দ নাপিত। গ্রামের বারোয়াড়ীর বিভিন্ন পূজাতেও তিনিই মধ্যমণি। এসব কিছুর জন্য যে তিনি সব সময় পয়সা পেতেন তা নয়। ভালোবেসে গ্রামের সমস্ত মাঙ্গলিক কর্মের একজন হয়ে উঠতেন তিনি। তখন গ্রাম্য সমাজটাই ছিলো এমন। যাকে এখন স্বার্থসর্বস্ব সমাজ বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
রাস্তা দিয়ে যখন সকাল বা একটু বেলার দিকে যেতাম দেখতাম কদম তলাতে বা বট তলার ছায়ায় বসে নন্দ দাদু কামাচ্ছেন। একজনের চুল কাটছেন তো আর একজন বসে বসে জল দিয়ে দাড়ি ভেজাচ্ছে, কেউ হয়তো নরুণ দিয়ে নখ কাটছে। লাইনেই আছে সকলে। নন্দ দাদু আমাদের একেবারে ছোটো ছোটো করে চুল ছেঁটে দিতেন। যাতে ছ’মাস আর তার কদম তলায় গিয়ে বাঁশি না বাজায়। একবার সুজিত কাকা চুল কাটিয়ে বাড়ি গিয়ে আয়নাতে মুখ দেখে বাঁশ নিয়ে ছুটে এসেছে নন্দ দাদুকে মারবে। কারণ তার চুলের ছাঁট হয়েছিলো টেনিদার নির্দেশে প্যালারামের যমন হয়েছিলো ঠিক তেমন। সে যাত্রায় প্যালারামের যেমন বউভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি, তেমনি সুজিত কাকার শ্বশুর বাড়ি যাওয়া স্থগিত হয়ে গিয়েছিলো।
রবিবার বৈকালে বড়ো আন্দুলিয়া হাটে নন্দ দাদু শানওয়ালা কাম ক্ষৌরকার। ছুরি, কাঁইচি, খুর নানান জিনিসে তিনি ধার বা শান দিতেন। গোলাকার চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে শান দেওয়া আর আঙুলে ধার পরীক্ষা করা। কবির কথায় ‘আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত প্রভাত রশ্মি সম’। সেই তেমন তীক্ষ্ণ ধার উঠতো দাদুর শানে। এরই মাঝে নানান গ্রাম থেকে আসা লোকের সঙ্গে গল্পগুজব। সন্ধ্যায় হাট করে শানের চাকতি কাঁধে ফিরতেন দাদু। দাদুর নেশা ছিলো দুধ চা আর বিড়ি। হাট থেকেই কিনে আনতেন বিড়ির পাতা, তামাক আর গোলাপি সুতো। দাদুকে দেখতাম অবসর সময়ে বিড়ির পাতা কাঁইচি দিয়ে কেটে ভিজে কাপড়ের টুকরোতে মুড়ে রাখতেন। তারপর সময় মতো পুরাতন একটা কুলোতো সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে বিড়ি পাকিয়ে বাঁধছেন। আমি মাঝে মাঝে পাশে বসে পঁচিশটা করে বিড়ি নিয়ে সুতো দিয়ে জড়িয়ে তাড়া বাঁধতাম। সে এক মজার কাজ।
দাদু গত হয়েছেন প্রায় বিশ বছর আগে। তবু এখনো তেমাথার বট তলাতে গেলে মনে হয় বিড়ি মুখে নীচু হয়ে দাঁড়িয়ে দাদু কারোর চুল ছাঁটছেন। কদমতলাটা এখন ফাঁকাই থাকে। কচি তাল গাছ গুলো অনেকেই সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মারছে। কেউ কেউ ডোবার জলে শেষের শয্যা নিয়েছে। ঝুড়ি ঠাকুমাও দূর গাঁয়ে মেয়ের বাড়িতে মারা গেছেন। পরিচিত বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। সেখানে নতুন বসতি গেড়েছে নতুন মানুষ। তবু হারিয়ে যাওয়া সেই মুখ যক্ষ হয়ে আছে স্মৃতির গোপনে।
(ক্রমশ)