উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩৩। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

প্রায় মাস ছয়েক বাদে একদিন রণজিদা ঠাকুরপুকুরে আমার বাসাবাড়িতে হাজির। আমি অবাক, ঠিকানা পেলেন কী করে?

জানলাম এগ্রিমেন্টের সময় ঠিকানা দেওয়া ছিল, সেটা ধরেই খুঁজতে খুঁজতে এসে গেছেন। তিনি চা সহযোগে সামান্য জলযোগ করলেন। নানান কথা হলো। পরিবারের সঙ্গে আলাপ করলেন। তারপর কয়েকটা একশো টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ওয়াজেদ পাঠিয়েছে। ছবিটা ও করবে। তোর বাকি টাকাটা।

আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে টাকাটা হাতে নিয়ে বললাম, একদিন ওর সঙ্গে দেখা করব।

বললেন, ওয়াজেদ আসবে।

সত্যিই সে এলো। এক ঈদের বিকালে। সঙ্গে ওর এক বন্ধু ছিল। বসতে বললাম। বসল না। বলল, আজ একটু তাড়া আছে, অন্যদিন আসবে। ঝোলা থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করে বলল, এটা রেখে দিন।

বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী?

–এই আপনাদের পরিবারের জন্য একটু মাংস। খাসির মাংস আছে। দু-চার কথার পর বলল, ছবিটা সে শিগগির শুরু করছে। খবর দেবে।

না। সে ছবি হয়নি। তারও বছর আটেক পর সে সত্যিই একটা ছবি করেছিল। কিন্তু টাকাটা ফেরত আসেনি। তখন রণজিৎদা আর নেই। কোনও এক দালালের খপ্পরে পড়েছিল। ফলে তার সিনেমা করা সেই প্রথম, সেই শেষ।

হ্যাঁ, রণজিৎদার কথায় ফিরে আসি। প্রবল ঝড়ের মধ্যেও ভাঙা গাছ যে ভাবে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে, রণজিৎদাও চেষ্টা করেছিলেন বেঁচে থাকার। কিন্তু পারেননি। কতদিন বলেছি, আপনার অংশটা বেচে দিলে তো কিছু টাকা পাবেন, একটা ফ্ল্যাট নিলেই চলে যাবে। শুধু আমি নই, ওঁকে যারা চিনতেন এমন অনেকেই বলতেন। বলতেন, নারে হবে না। বুঝতাম কেন হবে না। ওর দাদাও বলতেন মেয়ের কাছে চলে যেতে। যাননি। পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি।  তারাশঙ্করের প্রতিবেশী হওয়ার গৌরব হারাতে চাননি। দোতলাবাড়ির নীচের অংশটুকু যা ছিল তার ভাগের, মেয়েকে লিখে দিয়েছিলেন, তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই।

ততদিনে সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। কলকাতা থেকে ট্রামের বিলুপ্তি ঘটছে ক্রমশ। আড়ে শহরে বৃদ্ধি পাচ্ছে মহানগর। যৌবন খসে গিয়ে প্রৌঢ়ত্বের রূপটান লেগেছে শহরের গায়ে। মানুষ ক্রমশ স্থানুবৎ হয়ে যাচ্ছে, এমন সময় খবর পেলাম রণজিৎদা আর নেই। কোনও একটি সংবাদপত্রে ছোট্ট খবর বেরিয়েছিল, নিতান্ত অবহেলায়। একটা স্বপ্ন মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলো, সে স্বপ্নের ভিতর সম্ভাবনা ছিল এবং সম্ভাবনার আত্মহত্যার গল্প ছিল। রণজিৎ শিকদার ছিলেন সম্ভাবনাকে হত্যার কারিগর। শুধু একটাই আবেগ ছিল তার, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল আর বেকারি বন্ধ হয়ে যাবার ফলে তার স্ত্রীর শেষ সময়ে আর গ্রেট ইস্টার্নের রুটি খাওয়াতে পারেননি।

অমলের রঙিন দিগন্ত

সত্যি সত্যিই অমল রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। না, সে অমলকান্তি নয়, শুধু অমল। অমল মুখোপাধ্যায়। এই তো হাতে গোনা ক’বছর আগে, কত বছর? বছর পনেরো হয়ে এলো প্রায়, নাকি বছর বারো? হতে পারে, ‘সেই কথা রটি গেল’ – অমল নিঃসীম দিগন্তে বিলীন হয়ে গিয়েছে। বড় দুঃখজনক সে ঘটনা। দুপুরের দিকে মুঠোফোনে মর্মান্তিক খবরটি দিল বন্ধু মিহির সরকার। তাকে তার অফিসঘরে পাওয়া গেছিল ঝুলন্ত অবস্থায়। বউবাজার অঞ্চলে এক বিখ্যাত গলিতে ছিল তার অফিসঘর। এখান থেকে বের করতো ‘ভালবাসার দুই দিগন্ত’ নামে কবিতা ও গদ্যের সংকলন। বছরে দুটি সংখ্যা। গ্রন্থাকারে বেরোত। এপার-ওপার দুই বাংলাতেই ভালো বিক্রি ছিল। আসাম আর ত্রিপুরারেও বিক্রি হতো বলে শুনেছিলাম। তার মৃতদেহ পুলিশের কঠোরতা থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিল সাংবাদিক শ্যামলেন্দু মিত্রর হস্তক্ষেপে। শ্যামল ছিল অমল আর মিহিরের বন্ধু। আমারও ঈষৎ। মিহিরও বোধ হয় গিয়েছিল অমলের অফিসে।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে পরিচিত মহলে স্বাভাবিক হা-হুতাশ দু’এক দিনেই থেমে গিয়েছিল। কিন্তু অথৈ জলে পড়েছিল তার স্ত্রী-কন্যা। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি কোনও দিন। সবই শোনা কথা। তার মৃত্যুর কারণ নিয়েও নানা কানাকানি চলেছিল বেশ কিছুদিন। সে নাকি কোনও নারীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল। নানা প্রকার চাপ আসছিল তার উপর। সেই চাপ সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। কারো মতে, অপরাধবোধ ও ঋণের পরিমান বৃদ্ধি। এইসব কথার সমর্থন বা অসমর্থন একদিন বাতাসে মিলিয়ে যায়। কেবল থাকে অমল-স্মৃতি।

জীবনের পথ চলায় অমলকে পেয়েছিলাম বন্ধু হিসাবে। বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা সে জানতো। যাকে ভালোবাসতো, হৃদয় নিংড়ে ভালোবাসতো। ওর সঙ্গে আলাপ গত শতকের আটের দশকের প্রথম পর্বেই। ও তখন আকাশবাণী কলকাতার যুববাণীতে নাটক করে, আবৃত্তি করে। ওর ব্যবহার, মধুর ও আন্তরিক ব্যবহারের জন্য আকাশবাণীর আধিকারিক, শিল্পীদের বেশ প্রিয়। একদিন আকাশবাণীতেই প্রযোজক-শিল্পী-নির্দেশক জগন্নাথ বসু আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমি ‘কিশোর মন’ পত্রিকায়। সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধনের পরিকল্পনায় বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছোটবেলার কথা প্রকাশের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই মোতাবেক জগন্নাথ বসু, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন লেখার জন্য আকাশবাণীতে নিতে হতো। এভাবেই ওদের সঙ্গে বেশ ভালো পরিচয় হয়ে গেল। একদিন জগন্নাথ বসু অমলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ভালো লেখে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *