উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ২। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
মরণের কাছে বারবার
এসব অলৌকিকত্বকে কোনও দিন পাত্তা না দিলেও, মরণের কাছে বারবার দাঁড়াতে হয়েছে। মরণ যে মরণ! সেই কোন বেলা থেকেই মৃত্যুকে দেখেছি। কাছের দূরের কত মানুষের মৃত্যু যে এ জীবনটার উপর বয়ে গেল! যৌবনের পিঁড়িতে পা রাখতেই কাছে-পিঠের চেনা মৃতদেহগুলো যেন হাতছানি দিতো — আয়, আয়, তোর জন্যেই অপেক্ষায় আছি।
কত বাড়িতে দেখেছি কত নাটক। শহর যখন বোমা-বারুদের গন্ধে ভরপুর, সেই সময় বাবলুর বাবা অসহায় মৃতদেহ হয়ে হাসপাতালে পড়েছিল। অগতির গতি এই উড়নচণ্ডীকেই দলবল নিয়ে ছুটতে হয়েছিল। সে বৃত্তান্তে পরে আসছি। তার আগে কালুর কথা বলে নিই।
আমাদের তখন হাফ প্যান্টের বয়স। সেই সময় পুরো স্কুল জীবনটাই হাফপ্যান্টে কেটে যেত। কলেজে ঢুকলে ফুল প্যান্ট পরার অধিকার জন্মাত। তা সেই বয়সে, আমরা তখন নবম শ্রেণি। তখনই কালু চলে গেল। বীভৎসভাবে। তখনও মৃত্যু সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না।
বাংলার নবাবী আমলের সূর্য অস্ত গেল যে পলাশীর যুদ্ধে, বহু বছর পর্যন্ত তার স্মৃতি ছড়িয়ে ছিল যে গ্রামে, এবং এখনও একটি স্মৃতিস্তম্ভ বিরাজ করছে, সেই বিস্তৃত পলাশীর এক অংশে চিনির কারখানা। সেই কারখানার সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে কর্মীদের আবাসন। এসবই কারখানার মালিকের। আছে হাসপাতাল, সমবায় দোকান, এবং কারখানার মালিকের পৃষ্ঠপোষণায় একটি হাইস্কুল। সেই স্কুল অবশ্য সরকার পোষিত এবং আজও দীপ্যমান। পলাশী সুগার মিল কলোনি নামে সন্নিকস্থ গ্রামের মানুষের কাছে পরিচিত হলেও, আসলে সে ছিল এক উপনগরী। সেই উপনগরীর একদিকে সমবায়িকার পাশেই তাদের দুই কুঠুরি আবাসন। চলতি কথায় কোয়ার্টার। পড়ত পলাশী হাই স্কুলে। আমাদের সহপাঠী। একসঙ্গে খেলাধূলো, এক সঙ্গে ইস্কুল। রবীন্দ্র জয়ন্তী কি স্বাধীনতা দিবস – সবখানেই কালু আছে সঙ্গে। তা সেই কালুও চলে গেল।
সে গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষ দিকের ঘটনা। বাংলা জুড়ে খাদ্য আন্দোলন হয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের কাঁচকলা খাওয়ার পরামর্শের ব্যঙ্গচিত্র ছড়িয়ে পড়েছে, বাম আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তার আঁচ পড়েছে আমাদের উপনগরীর আশেপাশে। না তার সঙ্গে কালুর মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক ছিল না। তার মৃত্যু ছিল আকস্মিক।
খবরটা এলো ইস্কুলের শেষ পিরিয়ডে। যতদূর মনে পড়ছে কেউ একজন আকাশবাণী হয়ে হেডস্যারের কানে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। কালুর সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হয়েছে, তাকে কালিগঞ্জে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সে আর নেই। স্কুলের শেষ ঘন্টা বেজে গেল। আমরা ছুটলাম কালুদের আবাসনে। বেশ ভিড়। আছে বড়রাও, ছোট বড় মেয়েরাও। ছোটাছুটি করছে কৌতূহল – কী করে হল? কী করে হল? মুখে মুখে একটা কাহিনীও তৈরি হয়ে গেল, যা এই উড়নচণ্ডীর জীবন সন্ধ্যাতেও জ্বলজ্বল করছে।
কালু সেদিন ইস্কুলে যায়নি। ক্লাসে প্রেজেন্ট স্যার বলেনি। কেন যায়নি কেউ জানে না। হতে পারে তার মন খারাপ হয়েছিল। তার তো মাঝে মধ্যেই মন খারাপ হত। যেমন আমাদেরও হত। তখন তো আমাদের মন খারাপের বয়স। অথবা তার শরীর খারাপও হতে পারে। সে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের কোয়ার্টারের পাশে সমবায়িকার কাছটিতে। কোম্পানির বেডফোর্ট লরি এসেছিল মাল খালাস করতে। খালি লরি নিয়ে ড্রাইভার কাকু একটু এগোতেই মানে লরির চাকা গড়াতেই, রৈ রৈ চিৎকার ভেসে এলো। লরি থেকে নেমে এসে ড্রাইভার কাকু দেখেন, কালুর মাথা চাকার নীচে। কী করে কী হল? ওই লরি নিয়ে দু-চার জন ছুটল কালিগঞ্জ হাসপাতালে। ছোট হাসপাতাল। সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। ড্রাইভার কাকু সোজা থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
এসব কথা ছুটে বেড়ালো পলাশীর প্রান্তরে। চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিষণ্ণতা। কিশোর-কিশোরীদের মন ভার। এখানে-ওখানে জটলা । নিচু স্বরে নানা কথা।
পরদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গাওয়ার পর। হেডমাষ্টার মশাই দু’-চার কথা বলার পর সকলে বই বগলে বাড়ির পথে। না, সকলেই গেল না। অনেকেই গেল। বাকিরা হেডমাষ্টার মশাইয়ের পেছন পেছন, অন্যান্য মাষ্টার মশাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালের সামনে। ওখানে কালুকে আনা হবে শেষ দেখার জন্য। এলাকার মানুষেরাও আছেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কোম্পানির একটি লরিতে শুয়ে কালু এলো। তার মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত ব্যান্ডেজ বাঁধা। শুধু চোখ, নাক আর ঠোঁটের কিছুটা দেখা যায়। লরির পিছনের ডালা খুলে একটা কাঠের মই লাগানো হল। এই মইয়ে চরে একে একে এক পলকের দেখে নেওয়া। আহা, কালু ঘুমাচ্ছে। কী প্রশান্তি! মনে হয় এই মাত্র ঘুম থেকে জেগে, উঠে বসে বলবে, চল ঘুরে আসি।
সেই শেষ দেখা কালুকে। ওর স্কুলের খাতায় লেখা কাঁলাচাদ নামটা ক্রমশ ধূসর হয়ে গেল। কিন্তু মিল কলোনির, আমাদের বুকে সে থেকে গেল। অনেকদিন। ওদের কোয়ার্টারের সামনে গেলেই মনে হত, কালু দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে এসে বলবে, কোথায় যাচ্ছিস? মনুমেন্টের দিকে যাবি?
মনুমেন্ট এবং তার আশেপাশের জায়গাগুলো ছিল তখন কিশোর কিশোরীদের গল্প-গুজবের জায়গা। তা, সেই কালুও কেমন ছায়ার মতো সরে গেল মন থেকে। গেল কি? সত্যিই যায়! যায় না বলেই হয়তো পরিচিত কারোর মৃত্যুর খবর কানে এলে সটান হাজির হয়ে যাই আজও – কাছে দূরে।
এভাবেই খবর এসেছিল কালুর বাবার। তখন নকশালবাড়ি আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত। চারদিকে থমথমে পরিবেশ। রাত-বিরেতে তখনও বোমার আওয়াজ ভেসে আসে। সিপিআই (এম এল) ভাঙছে। একদিকে বিনোদ মিশ্রদের কেন্দ্রীয় কমিটি, অন্যদিকে মহাদেব ভট্যাচার্যদের গ্রুপ, আবার কৃষ্ণনগরের দক্ষিণদিকে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি যার নেতৃত্বে আজিজুল হক-রা। রাত বাড়লেই শহর ঘরের মধ্যে। মূল শহরের বাইরে অনেক এলাকাতেই বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুতের খুঁটিও বসেনি। কেরোসিন বাতিই ভরসা। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে নিলে কেরোসিনের সাশ্রয় হয়। রেশনের কেরোসিন যা মেলে, তা দিয়ে মাস চলে না। পাড়ার মুদির দোকান থেকে কিনতে হয় বেশি দামে। অনেকদিন ভেবেছি, ছোটবেলায়, রেশনে তো মাপা তেল। সকলেই কেনে। তাহলে মুদির দোকানে তেল আরে কোত্থেকে? তখন হিসেবে মেলেনি। কিন্তু বয়স বাড়তেই স্বয়ং —— শব্দটার সঙ্গে পরিচিতি হতেই সেই না মেলা অঙ্কটার দশে দশ পেয়ে গেলাম।
সে রাতের হেরিকেনের আলোয় মুখে রুটির শেষ টুকরো গুঁজে দিয়েছি। তখনই সদর দরজায় হাঁকাহাঁকি। এঁটো হাতেই এগিয়ে যেতেই এক দঙ্গলের মুখোমু্খি। কি হয়েছে?
-তাড়াতাড়ি চল বাবলুর বাবা মরে গিয়েছে।
-একটু দাঁড়া। হাতটা ধুয়ে আসছি।
বারান্দায় উঠে ডালের বাটিতে চুমুক দিয়ে, হাত ধূয়ে প্যান্ট সার্ট পরে বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই পকেটে পুরে হাঁটা দিলুম। গন্তব্য শক্তিনগর হাসপাতাল।
হাসপাতালের বাবলু অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা পৌঁছতেই হাঁফ ছাড়ল তোরা এসেছিস?
-তোর বাবা কোথায়?
-বেডে দোতলায়।
-ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েছিস?
-হ্যাঁ
-নিয়ে যাবি কিসে? ভেবেছিস?
-না তো! আবার অসহায়তার সঙ্গে তাকাল।
হেসে বললাম, জানতাম। তোর দ্বারা কিছু হবে না। পটলা ভ্যান এনেছে। চ। নামাতে হবে।
সকলে দোতলায় উঠে একটা ট্রলি যোগাড় করে বাবলুর বাবার মৃতদেহ, নিয়ে ট্রলি ঠেলে কিছুটা এগোতেই ওদের সঙ্গে দেখা। হাসপাতালে ওরা প্রায় সবসময় থাকে। ওয়ার্ড বয়ের পোশাক পরেই থাকে। অসহায়ের পাশে থাকে।
ওরা মানে সিপিআই (এম এল) ভেঙ্গে তৈরি হওয়া দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির কমরেডরা। এদের উপস্থিতির জন্যই হাসপাতালের শৃঙ্খলা আছে, কর্তব্য আছে, গাফিলতি প্রায়ই নেই।
ট্রলি ভ্যান ঠেলে যকন আমরা এগোচ্ছি, তকন একজন এসে সামনে দাঁড়াল
-কার বডি?
-এই যে বাবলু, ওর বাবার।
-ডেথ সার্টিফিকেট আছে? দেখি।
বাবলু দেখাল। দেখে নিয়ে বলল, ঠিক আছে।
আবার ট্রলি ঠেলা। আবার আরেকজনের মুখোমুখি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি! আমাদের একটা খবর দেবে তো।
-আবার বিরক্ত করব, সেজন্যই
-বিরক্তির কি আছে। ভ্যান আছে?
-চাঁদর টাদর আছে? ঢেকে নিয়ে যাবে তো? পাগর কিছু আছে?
সত্যিই তো এসব কিছু নেই। মনেও ছিল না। আসলে ভাবনাতেই ছিল না। শুধু উৎসাহ ছিল মৃতদেহটা বাড়িতে আনতে হবে। বললাম না তো!
-বুঝেছি। দাঁড়াও।
সে চলে গেল। প্রথম যে যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাকে নিয়ে এলো। হাতে দুটো সাদা চাদর, একটা লাল কম্বল। সিঁড়ির মুখে ট্রলি নিয়ে এসে একটা চাদরে মৃতদেহ রেখে দোলার মত সকলে ধরাধরি করে নীচে নামোনো হল। হাসপাতালের একজন নার্স আর দু-একজন কর্মীকে ইতস্তত দেখা গেলেও তারা অতিব্যস্ত হয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
পটলার ভ্যান রিক্সায় কম্বল পেতে, তার উপরে চাদর বিছিয়ে বাবলুর বাবার মৃতদেহ শুইয়ে দেওয়া হল। আরেকটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির দুই কমরেডের একজন, যার সঙ্গে পরিচিতি বেশি, গদাই নামে পরিচিত, একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল, টাকা পয়সা আছে? ভাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলল, কবর দেওয়ার টাকা আছে কিনা।
বললাম এসব নিয়ে চিন্তা নেই। ভাইকে বলো পরে দেখা হবে।
-ঠিক আছে। সাবধানে যেও। লাল সেলাম।
-লাল সেলাম
ভ্যান রিক্সা ঠেলে বাবলুর বাবাকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া গেল। ওর বোনেরা একটা ঘরে মেঝেতে মাদুর পেতে রেখেছিল, সেখানে শোয়ানো হল। মাথার কাছে রাখা হল বাইবেল। মোমবাতি আর ধূপ জ্বেলে দেওয়া হল। ওদের মাকে ধরে নিয়ে এসে শবদেহের পাশে বসানো হল। বাবলুর বোনেরাও বসল। পাড়ার দু চারজন মহিলাও এসে গেছে। তারাও বসল। শুরু হল কান্না পর্ব। এটা ধারাবাহিক চলবে কবরস্থ না হওয়া পর্যন্ত। একই সঙ্গে গান, প্রার্থনা ও ক্যাথলিক বিশ্বাস মতে মালা প্রার্থনা।
খ্রিষ্টধর্মে মৃতদেহ বাড়িতে রাখা হয় কবরস্থ না করা পর্যন্ত। সাধারণ নিয়ম হল সূর্যেদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে কবর দিতে হবে। বিশেষ কারণ ছাড়া। শীতকালে তবুও রাতে অসুবিধা হয় না। গরমকালে হ্যাপা কম নয়। বরফ জোগাড় কর, কাঠের গুঁড়োর ব্যবস্থা কর। পলিথিন বিছাও। সে যেন এক মহাযজ্ঞ। আর সকাল বা একটু বেলার দিকে কেউ মারা গেলে ঝড়ের গতিতে সব কাজ সেরে সন্ধ্যের আগেই কবর দেওয়া হয়। এ কাজ লোকজনও জুটে যায়। পাড়া প্রতিবেশিরা সেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসে।
তা সেই মৃতদেহ যতক্ষণ গাড়িতে থাকবে, চলবে গান প্রার্থনা। এরপর পাদরি বা পুরোহিত এসে প্রার্থনা করে যাবেন। সকালে মৃতদেহ স্নান করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন কাপড় পরাতে হবে। সে সব তো পরের পর হবে। এখন চলবে মালা জপ, ধন্যবাদের প্রার্থনা, গান। ধন্যবাদ কেন? না, এই পৃথিবীতে ঈশ্বর তাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই তাকে ফিরিয়ে নিলেন। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে সে চলে গেল। তাকে যে ঈশ্বর নিয়ে গেলেন নিজ নিবেদনে। এ হল খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস। এখানে কোনও যুক্তি নেই, বিজ্ঞান নেই দ্বন্দ্ব নেই। আছে শুধু বিশ্বাস।
কে একজন চা করে নিয়ে এলো। রাত জাগানিয়াদের জন্য দুধবিহীন লাল চা। এলাকার চালু শব্দ র চা বা ফিলে চা। কোথাও বা কালো চা। স্থান নাম যাই হোক, স্বাদ মন্দ নয়। চা পানের পর। দেখা গেল সঙ্গী দুজন উধাও। বাবলুকেও দেখা যাচ্ছে না। নির্ঘাৎ ঘুম মারছে কোথাও। উঠোনে দাঁড়িয়ে বিড়িতে টান দেওয়া শুরু করতেই অন্ধকার ফুঁড়ে বাবলা এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় গিয়েছিলি?
উত্তর পেলাম, বিয়োগ করতে।
-বাবলু আর কানাই কোথায় রে?
-প্রেম করছে?
-বাবলু?
-দ্যাখো মাঠে বসে আছে এলিজাবেথের সঙ্গে।
এলিজাবেথ পাড়ারই মেয়ে। বাবলুর বাপের পাশে বসে ছিল। টুকি মেরে সত্যিই সে নেই। মাথার ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। মনে হলে এখনই ওর পেছনে একটা লাথি কষিয়ে দিই। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে উচ্চারণ করলাম, বাপ মনে পড়ে রয়েছে, আর বাবু প্রেম করে বেড়াচ্ছে। ভালো। বাবলা মৃদু হেসে বলল, এমন সুযোগ আর পাবে? সারারাত্তির প্রেম!
-ডাক তো ওদের।
-কাকে ডাকবে বল? আজকের রাতের মতো ছাড়ান দাও।
-হাবুল আর কানাই কোথায় রে?
-ওহ্, ওরা? দুজনে দু’গরে পারাবত প্রিয়ার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে
-ভাল আছে সব।
ভোরের আলো দেখা দেওয়ার আগেই ময়দান প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। যে যার নিজের বাড়ি চলে গেল। ওদের কয়েকজন আত্মীয় চলে এলো। সক্কাল সক্কাল শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় পর্বের কান্নাকাটি। আমরাও চলে গেলাম ধোপ দুরস্ত হবে। নির্দেশ তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। ওদের এক আত্মীয়কে পাঠানো হল চার্চে, ফাদারকে খবর দিতে। ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হবে। কবর কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক কাজ।
খ্রিষ্টানদের মৃতদেহ কবরস্থ করার আগে বিস্তর কাজ। মৃতদেহ স্থান করানা হবে। তার জন্য বাড়ির চৌহদ্দির এক দিকে কাপড় দিয়ে ঘিরতে হবে। পাড়ার লোকেরাই স্থান করাবে। এসব কাজে দু’চারজন স্বতপ্রণোদিত হয়েও এগিয়ে আসে। স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে শুইয়ে রাখা হবে। ধূপ-মোমাবাতি জ্বলবে। বুকে ছোট আকারের বাইবেল বা জপের মালা। ফুলের মালা। হ্যাঁ, সে সব এসে যাবে। আত্মপরিজন বা প্রতিবেশীরাই নিয়ে আসবে। এসব এসে যায়। কিন্তু কফিন বাক্স লাবে। বাবলুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাবলা গেছে কফিন বাক্সের ব্যবস্থা করতে। ফাদার চলে আসবেন প্রার্থনা করতে। তিনি প্রার্থনা করার পর বলে দিয়ে যাবেন কখন গির্জায় নিয়ে যাওয়া হবে। কফিন বাক্স এলে তার ভিতর মৃতদেহ শুইয়ে, সকলের প্রণাম নিয়ে, যাবে গির্জায়। কফিন বাক্স তখন হাল্কা করে ঢাকা হবে। গির্জায় যাওয়ার পর নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হবে। এখন সাধারণত শববাহী যানে কফিনবন্দী মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সে সব ছিল না। কাঁধে করে নিয়ে যেতে হত। ভারী কফিন বাক্স কাঁধ থেকে কাঁধে বদল হতে হতে পৌঁছে যেতো গির্জায়। সেখানে পুরোহিত শাস্ত্রীয় নিয়মানুসারে প্রার্থনা করবেন। ক্যাথলিকদের আবার খ্রিষ্টযজ্ঞও হয়। অবশ্য কেউ যদি প্রধান পুরোহিতকে অনুরোধ করেন। এটা অবশ্য আবশ্যিক নয়। গির্জা থেকে যাবে কবর স্থানে। কোথাও কাছে, কোথাও দূরে। খুব দূরে হলে সেই সব দিনে ভ্যান রিক্সায় কফিন বহন করা হত।
বাবলুর বাবাকে কাঁধে করতে হয়নি। পটলা ভ্যান রিক্সা ধুয়ে সাফ সুতরো করে নিয়ে এসেছিল। কেউ বলেনি। নিজেই এনেছিল। হাসপাতাল থেকেও তো ও-ই নিয়ে এসেছিল। ভ্যান রিক্সাতেই ভায়া চার্চ কবর স্থানে পৌঁছেছিল বাবলুর বাবা। সেখানের আরেক প্রস্থ সংক্ষিপ্ত প্রার্থনার পর এবং সকলের শেষ দেখার পর কফিন বাক্সের ডালা বন্ধ করা হল। পেরেক মারা হল। কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়ে কবরে নামানো হল। পুরোহিত উচ্চারণ করলেন, ‘তুমি ধূলি থেকে এসেছো, ধূলিতেই গমন কর।’ তিনি হাত বাড়িয়ে আশীর্ব্বাদ যাচনা করলেন ঈশ্বরের কাছে বাবলুর বাবার জন্য। পবিত্র জল ছিটিয়ে দিলেন। একটুকরো মাটি কবরে দিলেন। তারপর সকলে মাটি দিল কবরে।
এসব ক্রিয়াকান্ড তো দেখছি কত বছর! এই যে কবরে মাটি দেওয়া, এটাকেই তো কবর দেওয়ার বদলে বলে মাটি দেওয়া। কিংবা ‘কফিনে শেষ পেরেক’ শব্দবন্ধুও তো এসেছে এই খ্রিষ্টীয় প্রথা থেকে। আচ্ছা, এই যে মৃতদেহ কবরস্থ করা, এটা কি ইহুদি প্রথা? কারণ খ্রিষ্টধর্মই তো ইহুদিদের হাত ধরে প্রচারিত হয়েছে। বিলু নিজেই তো ছিলেন ইহুদি। আবার দেখ, ইহুদি সংস্কৃতি আর বাঙালি সংস্কৃতি কেমন মিলে মিশে খিচুড়ি হয়ে গেছে। বাবলুর বাবাকে কবরস্থ করার পর, বাড়িতেই শাঁখা ভেঙে, সিঁদুর তুলে স্নান করানো হবে। বাবলুর মা বৈধ্যবের নিয়মে চলবে। তবে খ্রিষ্টধর্মে আচরণের স্বাধিনতা আছে। শবানুগমনকারী, বিশেষ করে যারা মৃতদেহ সৎকারের সঙ্গে জড়িত তারা হাত পা ধুয়ে মুখে নিমপাতা কাটবে। কোথাও তো দেখি কবর দিয়ে ঘরে ফেরার পর সদরে —- আগুনে পা ছুঁয়ে ঘরে ঢোকে। এখন অবশ্য শহর-গ্রামে এসব সাবেকি প্রথা হারিয়ে গেছে সময়ের নিয়মে। তবুও হয় তো আনাচে কানাচে কোথাও বয়ে গেছে যেমন রয়ে যায়।
(ক্রমশ)