সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৯। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
থানার মধ্যে রানিমূর্তি যেখানে রাখা, তার পাশের দেয়ালে একটা ছবি। ১৯০৫ সালে তোলা সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে মহারানি চকের মধ্যে খিলানকার্নিশ মন্ডিত তিব্বতি আবহে রাণী স্বমহিমায় বিরাজমান, আশেপাশে দু তিন জন পাহাড়ি, পিছনে ধূধূ পাহাড়, খাদ। বাড়িঘর নেই। ছবি তোলা হয়েছে ১৯০৫ এ, মূর্তি বসেছে ১৯০২-এ। উল্লেখ্য, রাণী ভিক্টরিয়া মারা যাচ্ছেন তার আগের বছর, ১৯০১-এ। মূর্তি স্থাপন উপলক্ষে প্রচুর ধূমধাম হয়েছিলো। গ্রাহাম সায়েবের হোম বলে যে ইস্কুল ও বাড়িঘর দেয়লো পাহাড়ের নিচের ঢালে অদ্যাবধি বর্তমান, তার পুরোনো (১৯০২ সাল) ইস্কুল পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে রানিমূর্তি স্মারক সৌধ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের বর্ণনা ছিল:
১৯০২ সনের ৪ঠা নভেম্বর দিনটি কালিম্পং-এর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। কারণ, ওই দিনে এই গ্রামে ছোটলাট বাহাদুরের পদার্পণ ঘটিয়াছিল।…মাননীয় লাটসায়েব মহাশয় পূর্বাহ্নেই পঁহুছিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত আসিয়াছিলেন, প্রধান সচিব মিষ্টর বকল্যন্ড মহাশয়, রাজশাহীর প্রধান কমিশনর মিস্টর মেরিডিয়ন মহাশয়, দার্জিলিং-এর ডিপুটি কমিশনর মিস্টর ওয়লশ মহাশয়….প্রথম যে অনুষ্ঠান ছোটলাট বাহাদুর অলঙ্কৃত করেন, তাহা হইলো সম্রাজ্ঞী ভিক্টরিয়ার স্মারকসৌধের উন্মোচন। জিলাস্থ প্রজাদিগের চাঁদাদ্বারা নির্মিত, কলিকাতার আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত হাভেল সাহেব দ্বারা তিব্বতি-নেপালি শৈলী অনুযায়ী পরিকল্পিত এই সৌধের খোদাইকাজ সিখিম লামা দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। সর উডবর্ন বলেন, এই স্মারকসৌধটি প্রথম এই অঞ্চলে পুরাপুরি নির্মিত এইরুপ স্থানীয় সৌধ। তিনি বলেন, ‘যে বিশুদ্ধ ও উৎকৃষ্ট রুচিবোধের পরিচয় এই সৌধ বহন করিতেছে, তাহা প্রত্যেকের প্রশংসা অর্জন করিয়াছে।’….
যে সাম্রাজ্যে সূর্য নাকি অস্ত যেতো না, ভেঙেচুরে ছত্রাখান হয়ে গেলো, যাবতীয় পদচিহ্ন সমেত ছোটলাট বড়লাট এই সায়েব ওই সায়েব উবে গেলেন, মহারাণী চক থেকে মহারাণী হাওয়া হয়ে গেলেন, ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হওয়া দূরস্থান, ইতিহাসটাই লোপাট হয়ে গেলো। ওদিকে শূন্য় ও পাহাড় ভরাট করে বাড়ির পর বাড়ি গজালো, কালক্রমে রাণী থানায় কাঁচের বাক্সে ঠাঁই পেলেন বটে, তাতে মরা ইতিহাস জ্যান্ত হলো কি? সন্দেহ আছে।
ইতিহাসের কথায় মনে পড়লো, একটু আগেই গ্রাহাম সাহেবের হোম ও ইস্কুলের কথা হচ্ছিলো। গীর্জা ও পুরোনো গীল্ড মিশন এলাকা থেকে নেমে এসে বাঁদিকে চলে গেছে আলগাড়া, পেডং হয়ে তিব্বত যাবার প্রাচীন পথ। পেডং থেকে উৎরাই পথ নেমে যায় ঋষি নদীর দিকে। নদী পেরিয়ে সিকিম, কিছুটা গেলে সিকিমের রংলি বাজার। সেখান থেকে পুরোনো ক্যারাভান পথ চলে যাচ্ছে জেলেপ লা বা জেলেপিলা গিরিপথ অভিমুখে। লা মানে পাহাড় টপকানোর জায়গা, পথ, পাস। হিমালয় পাহাড়ের মূল স্তর পেরিয়ে ওপারে ছবির মতো চুম্বি উপত্যকা, ফারি দূর্গ। সে উপত্যকার একদিকে ভুটান, অন্যদিকে তিব্বত। বিশ শতকের গোড়ার দিকে, কিছু পরেও, সায়েবরা এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছেন প্রধানত এই পথ দিয়ে। দার্জিলিং পাহাড় ও তিস্তার পুব পাড়ের কালিম্পং দখলে আসার পর থেকেই, এটাই তুলনায় সোজা পথ ছিলো। কালিম্পং-এ মিশনের কাজ শুরু হবার আগে অবধি চুম্বি উপত্যকায় যেতে হতো ডুয়ার্সের বক্সাদুয়ার হয়ে, অনেক পাহাড় ভেঙে, বনবাদাড় ঠেঙিয়ে, ঘুরপথে। নচেৎ ঢুকতে হতো সিকিম বা নেপাল হয়ে, দূর্গম উঁচু গিরিপথ পেরিয়ে। সায়েবরা মিশন ও শাসন নিয়ে অখ্যাত অজ গাঁ কালিম্পং-এ এসে বসলেন, ঘরবাড়ি বানালেন, পাহাড়ের গভীর ভিতরে ঢুকে ধর্ম প্রচার শুরু করলেন, বন আবাদ করে প্রজা বসিয়ে চাষবাস চালু করলেন। জংলী জুমিয়া লেপচারা দলে দলে ন্যায়ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকলেন। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মিশনের ঘরবাড়ি, নতুন গীর্জা এসব তৈরি হতে থাকলো। তিস্তা থেকে রিল্লি, রিল্লি থেকে নিম্বং, কাফের। ঘিস উপত্যকা। এসব জায়গায় এই সেদিন অবধি হেঁটে যেতে হতো, কোথাও কোথাও এখনো হাঁটতে হয়। কালিম্পং-এর ভিতর দিককার লোকজন, ক্ষেতখামার, বনজঙ্গল এসবের কথা পরে বলা যাবে। আপাতত যে কথাটা বলা দরকার, গ্রাহাম সায়েবের উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতা না থাকলে, অত তাড়াতাড়ি কালিম্পং পাহাড়ের চেহারা বদল ঘটতো কিনা সন্দেহ। শহরও গড়ে উঠতো না বোধহয়। ১৯০১ সাল নাগাদ, কালিম্পং-এ মেরেকেটে হাজার লোকের বাস। আর মাত্র বছর চল্লিশের মধ্যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার আগেই জায়গাটা হিল স্টেশান হিসেবে বিখ্যাত, দেশ বিদেশের মানুষের ভিড়, তিব্বতি বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র।
(ক্রমশ)