সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

গত পর্বের পর

নিচ থেকে মুখ ঘুরিয়ে সামনের শহরের দিকে তাকাই। দূরবীন পাহাড় থেকে ডেলো বা ডেয়লো পাহাড় অবধি বিস্তৃত যে গিরিশিরা বা রিজ, তার মাথায় মাথায়, এবং দুদিকের ঢাল প্রায় পুরো ঢেকে কালিম্পং শহরের ঘরবাড়ি হোটেল দোকান ছড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। ডানদিক অর্থাৎ রিল্লি নদী উপত্যকার দিক, বাঁ অর্থাৎ তিস্তা উপত্যকা। দূরবীন নামটা কোথ্বেকে এলো, কে জানে। সায়েবসরকারের পুরোনো কাগজপত্রে কিছু বলা নেই। রিংকিংপং পথ সমেত দূরবীন এলাকার সেনাবসতিগুলোও পুরোনো অর্থাৎ সায়েব আমলের নয়। দার্জিলিং জেলার পুরোনো সেনাছাউনি বা ক্যান্টনমেন্ট বলতে তিস্তার ওপারের জলাপাহাড় আর লেবং। তিব্বত নিয়ে সায়েবদের যথেষ্ট  উদ্বেগ ছিলো। তবু, সীমান্ত এলাকায় স্থায়ীভাবে সেনা বসানোর কথা তাঁরা ভাবেননি। দার্জিলিং এর দুটো গ্যাজেটিয়ার-এর একটাতেও ভুটানের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া তিস্তার এপারের এলাকায় সেনাবসত বা মিলিটারি স্টেশন তৈরির কথা বলা হয়নি। ধরে নেওয়া যায়, কালিম্পং শহর ও লাগোয়া পাহাড়ের যাবতীয় সেনাবসত গড়ে উঠছে সায়েব-পরবর্তী সময়ে। চিনের সেনাবাহিনী পাকাপাকিভাবে তিব্বত দখল করে নেবার পর তরুণ দলাই লামা যখন পালিয়ে আসছেন ভারতবর্ষে, তথাকথিত চিন ভারত যুদ্ধ শুরু হচ্ছে ১৯৬২-তে।  

 

সেনাবসত না থাক। কালিম্পং বলে যে জায়গাটা, সায়েবদখলে আসবার আগে সেখানে একাধিক গ্রাম ছিলো, ভালো চাষবাস হতো। এটা জানা যাচ্ছে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ভুটানে প্রেরিত দূত ‘মান্যবর (অন’বল)’ অ্যাশলে ইডেন(সেই ইডেন, যিনি সিকিমকে উচিত শিক্ষা দিতে পাঠানো সামরিক অভিযানের নেতা ছিলেন)  সায়েবের পাঠানো রিপোর্ট থেকে। ১৮৬৪ সালের বিশে জুলাই  ভারত সরকারের বিদেশ দপ্তরের সচিব কর্নেল এচ এম ডুরান্ডকে লেখা এই রিপোর্টে বলা ছিলো–

 

.৯ (জানুয়ারি) তারিখে তিস্তা হইতে…আরোহণ পর্ব শুরু হইলো। চড়াই কঠিন নহে। চাষাবাদ হইতেছে এমত কতিপয় গ্রামের মধ্য দিয়া দিনশেষে ৩৭৭৩ ফুট উচ্চ কালিমপুং গ্রামে পহুছিলাম।…এই স্থানে…নিকটবর্তী গ্রামগুলিন দর্শন করিলাম। গ্রামস্থ বাসিন্দাসকল আমাদিগকে দেখিয়া সাতিশয় আহ্লাদ প্রকাশ করিলো…ডিম্ব, কুক্কুট, কমলা ও বিবিধ সবজি আদি উপহার রুপে দিয়া আপ্যায়িত করিলো। দেশের এই অঞ্চলটিতে  কৃষির যথেষ্ট প্রচলন রহিয়াছে, বুঝা যায়, বাসিন্দার সংখ্যাও অল্প নহে। আমাদিগের সীমান্তের নিকটে অবস্থিত হইবার কারণেই সম্ভবত ইহারা বোটান সরকারের বিশেষ পরোয়া করে না, আমাদিগের সহিত বাণিজ্য করিতেও ইহাদের আপত্তি ছিলো না।…স্বদেশিয় সরকারের প্রতি ইহাদিগের তীব্র বীতরাগ এবং দার্জিলিং-এ আমাদিগের শাসনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ…ইহাদের একমাত্র ইচ্ছা, আমাদের শাসনাধীন হয়…

 

কালিম্পং থেকে বার হয়ে ইডেন দামসাং দূর্গে পৌঁছোন, সেখান থেকে লাভা হয়ে আমবিয়ক। সেসব গল্প পরে হবে। আপাতত কালিম্পং শহর ঘুরে দেখা চলুক। বলছি বটে শহর, অথচ ১৮৬৫ সালে সায়েবদখলে আসবার পরেও অন্তত বেশ কিছুকাল জায়গাটার তেমন গুরুত্ব ছিলো না।   হান্টার লিখিত বাংলার সংখ্যাতাত্বিক 

বৃত্তান্তের দার্জিলিং খন্ডে কালিম্পং-এর উল্লেখমাত্র নেই। থাকার কথা নয়, সদ্য সায়েবদখলে আসা তিস্তার বাঁপাড়ের সমস্ত পাহাড়কেই তখন ডালিংকোট বলে ডাকা হতো। ডালিং বা ডালিংকোটের গল্পও পরে।

 

দার্জিলিং শহরের পত্তন নিয়ে নানান তর্ককাজিয়ার কথা বলা হয়েছে; সিকিমের কাছ থেকে পুরো দার্জিলিং পাহাড় কিকরে কিকরে বের করে নেওয়া হলো সেই আখ্যান, তৎসহ  লয়েড এবং ক্যাম্পবেল বৃত্তান্ত। দার্জিলিং সায়েবী বঙ্গের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিলো এককালে, কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলমলে ছায়ায় যত্নে বসানো সৌখিন কুলীন রংদার হিল স্টেশন, তাকে নিয়ে বিস্তর হইচই লেখাপত্র গল্পগাছা, কালিম্পং সে তুলনায় কিছু বা এলেবেলে, সৎ ছেলেমেয়ে যেমন হয় আরকি, কিম্বা দুয়োরাণীরা। তবে কিনা গল্পের নিজের-পরের সুয়োদুয়ো কুলীন-অকুলীন হয় না, বয়সে এবং সায়েবি বংশমর্যাদায় খাটো হলে কি হয়, ডেয়লো দূরবীনের দুই পাহাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা কালিম্পং-এর মহল্লায় মহল্লায় অসংখ্য ছোটবড় গল্প জমে আছে। ইংরেজ-আইরিশ-স্কটদেশি সায়েবদের তো বটেই,  সায়েবদের মতো বাঙালিদের, ‘নেটিভ’ লেপচা-ভুটিয়া-তিব্বতি এবং পড়োশি গোর্খা রাজত্ব থেকে নিয়ে আসা পাহাড়িদের, এবং আরো আরো অনেকের। সেই অনেকদের মধ্যে বাস্তবিক রাজামহারাজা, সায়েবি বৌদ্ধ ভিক্ষু, তিব্বতি বনে যাওয়া সায়েব ও আধা-সায়েব ইত্যাদিরা সামিল।  আলাদা আলাদা করে সে গল্পের কিছু কিছু বলাপড়া হয়েছে, বহু গল্প অপঠিত নতুবা অধুনাবিস্মৃত, দুষ্প্রাপ্য। পড়া এবং না পড়া রাশিরাশি গল্পের কয়েকটা ছোট করে বলাপড়া যাক। দার্জিলিং-কালিম্পং সুদ্ধ আমাদের তামাম পাহাড় সমতল জুড়ে ইদানিতে চিমনি-ফায়ারপ্লেস হেরিটেজের(অর্থাৎ কিনা কোথাও গোটাভাঙা আধ-একটা চিমনি কী ফায়ারপ্লেস থাকলেই হেরিটেজজ… বলে দৌড়োতে হবে) বান ডেকেছে। বলা তো যায় না, এ বাজারে পুরোনো গল্পের কদর হলেও হতে পারে।    

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *