সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

সাতাশ মাইল থেকে বড় রাস্তা ধরে একটু পিছনে আসা। সরু পথ পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে নদীতে নামছে। নদী আসার আগে পাহাড়ি ঢালের একজায়গায় খানিক সমতল, অনেকগুলো ঘরবাড়ি জট পাকিয়ে আছে। এটা আর একটা গ্রাম। রিয়াং। ওই জায়গাটায় এককালে তিস্তা ভ্যালি রেলপথের রিয়াং স্টেশন ছিলো, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ বইতে যার কথা লিখেছেন মৈত্রেয়ী দেবী, রংলি রংলিওট নিয়ে তাঁর ছোট্ট বইতে রুমার গডেন-ও। মংপু, তাকদা, এসব জায়গায় রেলে করে আসতে হলে রিয়াং-এ নামতেই হতো, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং মংপু আসাযাওয়ার পথে স্টেশনে নেমেছেন, বসেছেন। খুব ছোট ব্যাপার নয়, ড্যাশ সায়েবের গ্যাজেটিয়ারে দেখছি ১৯৪২-৪৩ সালে হাজার ছয়েক লোক রিয়াং থেকে ট্রেন ধরেছেন বা রিয়াং-এ ট্রেন থেকে নেমেছেন। 

 

উঠে যাওয়া রিয়াং স্টেশন, কোনক্রমে থেকে যাওয়া রিয়াং গ্রামের ঠিক নিচেই তিস্তায় এসে পড়ছে রিয়াং নদী। মংপু থেকে সিটং যেতে হলে যে রিয়াং নদী পার হতে হয়, তিস্তা ভ্যালির বড় রাস্তায় লোহাপুলে যাকে আবার পেরুতে হয়, সেই নদী। পাহাড়-ভাঙা উন্নয়ন আছেই। তৎসহ, পুরো এলাকায় সারাবছর এলাহি ও ধুন্ধুমার পর্যটন চলছে। সকাল থেকে রাত গাড়ি ছুটছে, লোক নামছে ছবি তুলছে এটাসেটা খাচ্ছে, খাওয়া শেষ হলে বোতল প্যাকেট থালা বাটি ফেলে রাখছে বিশ্রামের, খাবার জায়গায়। রাস্তার ধারে, পাহাড়ি ঢালে, গাছের ফাঁকে ও ডালপালায়, লালনীলহলদেসবুজ, সোনালি-রুপোলি প্লাস্টিক চকচক ঝলমল করছে, একসময় নিচের নদীতে গিয়ে পড়ছে। তা সত্বেও রিয়াং-এর জল আশ্চর্য রকমের স্বচ্ছ। থাকবার কথা নয়। লোহাপুল থেকে তিস্তা অবধি নদীর যে অংশ, নদীখাতের মধ্যেই সেখানে বছরের পর বছর 

ডাই করে রাখা হয়েছে বাঁধ বানাতে গিয়ে বেরুনো তাল তাল পাহাড়প্রমাণ কাদামাটি, তদুপরি দশ কিসিমের নির্মাণসামগ্রী, মাটি কাটবার পাহাড় ভাঙবার জন্য দাঁতালো দৈত্যাকার হলুদ-বাদামি জেসিপি মেশিন, বালিপাথরকাদা আনানেওয়া করবার জন্য ঘটাং ঘট গোঁ গোঁ করা ডাম্পার লরি। কি আশ্চর্য কি অলৌকিক, নদীটাকে মেরে ফেলা যায়নি। মরতে না চাওয়া, না মরা রিয়াং দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী এসে তিস্তায় পড়ছে। 

 

রিয়াং পড়ছে তিস্তায়, পূর্ব থেকে আসছে রিল্লি বা রেলি। তিন নদী যেখানে মিলছে, বড় ভালো লাগার, আনন্দের ঠাঁই। তিন নদীর তিন রকমের তিন রঙের ধারা, উচ্ছল কলস্বীনি তিস্তা, কখনো সবুজ কখনো নীল, রিল্লির সবুজাভ-ধূসর পাক খাওয়া জল, ধীরপ্রবাহিনী স্বচ্ছতোয়া রিয়াং। সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে বনে ঢাকা পাহাড়ের বেষ্টনী কিছু আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তিন নদীর মাঝখানে জন্মেছে চওড়া বেলাভূমি, রুপোলি-সাদা নরম বালি, নানা রঙের ছোটবড় পাথরে ভর্তি। উত্তর-পশ্চিমের যে খাড়া ঢাল সাতাশ মাইলের বড় রাস্তার মাথা অবধি ঠেলে উঠছে, সেখানে নুনমাটি। নুন চাটতে ওপর পাহাড়ের বনজঙ্গল থেকে নেমে আসে বড় শিং-ওয়ালা কালচে নীল সম্বর। পাহাড়িরা বলেন জরায়া। বাঁধ বানানোর কাজ শেষ, লকগেট বন্ধ হবার সব ঠিক, হবামাত্র নুনমাটি পাহাড় নদী বন জলের তলায় চলে যাবে যে কোনদিন, বড় রাস্তার ওপরের বলবাখানি বা উনতিস(উনতিরিশ) মাইল গ্রামের এক বৃদ্ধ খুব দুঃখ করেছিলেন। বাঁধ হবে, জল আসবে, কি হবে  বেচারা জরায়াদের? কোথায় নুন পাবে তারা? কোথায় যাবে? 

 

শুধু সম্বর? তিস্তার জল ছিলো মহাশের বা মহাশোল মাছেদের পছন্দের বাসা। তিন রকমের মহাশোল পাওয়া যেতো, সোনালি, লাল পাখনা, তামারং। সায়েবরা তাঁবু ফেলে দিনের পর দিন বসে থাকতেন মাছ ধরবেন বলে। সায়েবদের পরে, সৌখিন পাহাড়িরাও। তিস্তায় বাঁধ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না, কিছু বলুন, আপত্তি করুন বা প্রতিবাদ, এসব বলতে কালিম্পং- এর এম এল এ সায়েবের কাছে দরবারে যাওয়া হয়েছিলো। সায়েব বলছি বটে, আসলে নির্বিরোধী লেপচা মানুষ। আদর করে বড় হোটেল-এ নিয়ে বসালেন। বড় হোটেল হলে কি হয়, বর্ষার সময় বা সদ্য বর্ষবিদায় ঘটেছে, লাউঞ্জের দামি সোফায় ভ্যাপসা জলপচা গন্ধ, বিকেল গিয়ে সন্ধ্যা নামছে, ঘরে ঝাপসা আধো-অন্ধকার, এম এল এ আদবোজা চোখে কথাবার্তা শুনছেন, মাঝে মাঝে হুঁ হাঁ করছেন, কাছে এলে মুখ ও গা থেকে ভকভক কড়া গন্ধ আসছে, সম্ভবত সস্তা হুইস্কির। বেরিয়ে এলাম, সঙ্গের পাহাড়ি বন্ধুরা বললেন, আরে হুঁশ থাকলে ও তো সারাদিন নিচে নদীর পারে বসে থাকে, মহাশোল ধরবে বলে। নদী নষ্ট হয়ে যাবে, তবু তেমন কিছু বললো না।    

 

এ জে ড্যাশ লিখিত বা সংকলিত   দার্জিলিং জেলার শেষ সায়েবি গ্যাজেটিয়ারে বলা আছে, রিয়াং ও তিস্তার সঙ্গমবিন্দুতে সব চাইতে বড় মহাশোল ধরা হয়েছিলো। এক একটার ওজন ছিলো ৫২ থেকে ৫৪ পাউন্ড, অর্থাৎ ২৩ থেকে ২৪ কেজি। রিচি ও মেক্লেজন সায়েবের যৌথ প্রচেষ্টায় এই সাফল্য অর্জিত হয়েছিলো, ড্যাশ জানাচ্ছেন। 

 

আইনে আছে, বড় বাঁধ গোছের নির্মাণকাজ করতে গেলে, আশপাশের পরিবেশ ও মানুষজনের ওপর কী সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া, বিশদ সমীক্ষা করে সবাইকে জানাতে হবে। এ প্রক্রিয়াকে সাদা বাংলায় এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, সংক্ষেপে ইআইএ বলে। সাতাশ মাইলের, কালিঝোরার বাঁধের বেলাতেও সমীক্ষা অর্থাৎ ইআইএ হয়েছিলো। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টারমশাইরা করেছিলেন। দুর্জনে বলে, প্রথম সমীক্ষাটা বাঁধমালিকরা ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সমীক্ষার ফলাফলে বিভিন্ন ও অজস্র প্রতিক্রিয়ার যে হাড় হিম করা বয়ান উঠে এসেছিলো, তা দেখার পর সরকারি ছাড়পত্র পাওয়া কঠিন এমনকি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে এই বিবেচনায়। এমনিতে ছাড়পত্র দেওয়ার সরকারি কমিটিতে বিবেচক মানুষজন থাকেন। খনি হোক বা বাঁধ, রাস্তা হোক, কিম্বা সেনাছাউনি বা কারখানা, কিচ্ছুটি কোনকালে আটকান না, বিশেষ কাজটা যদি সরকারি হয়। তিস্তার যে বাঁধের কথা বলছি, সেগুলো সরকারি। তারপরেও এই–মানে, ব্যাপারটা কত ভযঙ্করই না ছিলো! যাই হোক, দূর্জনে আরো বলে, বাঁধওয়ালারা সমীক্ষার কাগজপত্তর ফেরত পাঠানোর পর সমীক্ষা করনেওয়ালাদের ওপরালা, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঝটিতি বৈঠক ডাকলেন, সেখানে মাষ্টারমশাইদের(” মাষ্টারমশাই” কথাটি এক্ষেত্রে লিঙ্গ- নিরপেক্ষ অর্থে প্রযোজ্য) বলা হলো, ওহে বাপুসকল, ব্যাপার গুরুতর, এই রিপোর্ট দিলে বাঁধওয়ালারা একটি পয়সা ঠেকাবে না বলছে, অতএব সত্বর তোমরা রিপোর্টটি ভদ্রগোছ করে ফের বানাও। তা-ই করা হলো। ২০০২ সালের শেষাশেষি যে রিপোর্ট জনসমক্ষে পেশ হলো, তাতে বলা আছে, পাহাড় কাটাকাটি, জল আটকানো ইত্যাদি কাজের ফলে কিছু গাছ নষ্ট হবে, কিছু বন ডুববে, রাস্তাঘাটও খানিক ভাঙবে ধসবে বটে, তবে সেসব এমন কিছু নয়। বন যা যাবে তার বিনিময়ে নতুন বন লাগিয়ে দেওয়া যাবে অন্য কোথাও। 

 

পূর্ব হিমালয়ের নরম মাটিতে বাঁধ নির্মাণের কাজ, সুতরাং সমীক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের জিম্মা ছিলো সরকারি ভূতত্ত্ব সমীক্ষা বিভাগের কাছে। তাঁরা যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, ইআইএ থেকে বেমালুম বাদ দেওয়া হলো। কি করে কি করে যেন বাদ দেওয়া অংশটা হাতে এসে গিয়েছিলো। হাঁ করে দেখি, সরকারি ভূতত্ববিদরা সাফ বলছেন,  তিস্তা উপত্যকার নরম পাহাড় কাটা ও ফাটানোর ফলে যত্রতত্র ধস নামবে। পুরোনো ধস নতুন চেহারায় দেখা দেবে, যে অঞ্চলে আদৌ ধস ছিলো না, সেখানেও পাহাড় ধসবে। দুই, দীর্ঘদিন ধরে জল ধরে রাখার ফল, নরম ঝুরো মাটির পাহাড়ি ঢালের মধ্যে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকবে, ধসের বিপদ বাড়বে বহুগুণ। তিন, বড় রাস্তা অর্থাৎ দশ নম্বর রাজমার্গটিও টিকবে না। 

 

বাদ পড়া রিপোর্ট নিয়ে মেলা চিৎকার হয়েছিলো। লাভ হলো না। ইআইএ রিপোর্টের দ্বিতীয় খণ্ডে(এনভায়রমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান বা ই এম পি) বলা থাকে সম্ভাব্য ক্ষতি ঠেকাতে কী করা হবে। এক্ষেত্রে বলা হলো, রাস্তায় এবং বাঁধের কিনারে কিনারে কংক্রিটের দেয়াল(গার্ড ওয়াল) তোলা হবে, ধস নামবে না। মহাশোল মাছের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে বলা হলো, বাঁধের তলায় ফাঁকা জায়গা রেখে মাছ যাতায়াতের মই বানানো হবে। সেই মই বেয়ে অকুতোভয় ও অমর সোনালি লাল তামাটে মহাশোল মাছেদের ঝাঁক  নদীতে ঘুরে বেড়াবে, যেমন বেড়াতো। অকাট্য ও খাসা সব যুক্তি, সন্দেহ কি? ছাড়পত্র যথাকালে এসে গেলো। খানিক ভয় দেখিয়ে খানিক টাকাকড়ি দিয়ে আশপাশের গুটিকয় গ্রামের লোকজনকে চুপ করিয়ে দেওয়া হলো। কাটাখোঁড়ার কাজ শুরু হলো। সেটা ২০০৩-৪। বছর দুয়েকের মধ্যে, ২৭ মাইলের বড় রাস্তা থেকে নদী অবধি লম্বা খাড়া ঢাল, যেখানে নুন চাটতে আসতো সম্বর হরিণরা, দুমড়ে মুচড়ে পিন্ড হয়ে যাবতীয় দেয়াল টেয়াল সুদ্ধ নিচের নদীতে পড়ে গেলো। শিরদাঁড়া-বাঁকা ডাইনোসরের মতো, আগাগোড়া কংক্রিটে ঢাকা পাহাড়টা বেঁকেচুরে কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন?

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *