রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ১২। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য

0

(গত পর্বের পর)

রূপকথার রান্নাঘর

নিজের বাড়ি শব্দ দুটির মধ্যে একটি প্রশান্তি আছে। ছোটবেলা থেকে বিয়ের আগে অবধি চার বার বাড়ি বদল করে তারপর নিজের একটি বাড়ি হয়েছিল। বিয়ের পর সেই বাড়ি আর নিজের থাকলো না, হয়ে গেল বাপের বাড়ি। আর বিয়ের পর আটবার বাসা বদলানোর পর এই নিজের বাড়ি হতে যাচ্ছে, তাও আবার নিজের নামে, সেই অনুভূতির তুলনা হয় না। নিজের বাড়িতে নিজের রান্নাঘর মানে তো আরো স্পেশাল ব্যাপার। যখন এই সিদ্ধান্ত আমরা নিলাম, তখন দুজনের চাকরিই পাকা নয়, মূলত টিউশনিই ভরসা। প্রাক্তনের এক ছাত্রের বাবা ব্যাঙ্ক থেকে লোনের ব্যবস্থা করে দিলেন। সারা বারুইপুর চষে ফেলার পর শেষমেশ রবীন্দ্রনগরে মজা খালের পাশে চৌকোণা একটি জমি আমদের খুব পছন্দ হয়ে গেল। নিজের বাড়ির কথা লিখতে বসে শুধু রান্নাঘরের কথা লিখতে পারবো কিনা জানিনা। এই বাড়ির সাথে আমার আবেগ অনুভূতি এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে অমন নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন। এইবাড়ি শুধুমাত্র একটি ইঁটের গাঁথনি দেওয়া চার দেওয়াল নয়, এই বাড়ি আমার আত্মজাগরণের তীর্থক্ষেত্র। এই বাড়ি না থাকলে আমার নতুন আমি কে আজ আবিষ্কার করতে পারতাম না। বাড়িটিকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু সেটিও আমার কাছে শুভ হয়েছিল। ওই বাড়িতে এখন যাঁরা আছেন তাঁদের সর্বৈব ভালো হোক কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা করি। লেখাটি একটু দীর্ঘ হয়ে যাবে হয়তো।

যাইহোক, বাড়ি তথা রান্নাঘরের কথায় ফিরি। ২ কাঠা জায়গা, সেখানে বাড়ি হবে। আমাদের  চাই বিশাল একটা লিভিং রুম যেখানে চাইলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলবে আর মাঝে সাঝে আমাদের ঘরে  গান-কবিতার আসর বসবে, আমার চাই বড়ো একটা রান্নাঘর আর আমার প্রাক্তনের দাবী ছিল, যাইহোক আর তাইহোক, গ্যারেজ রাখতে হবেই, সে গাড়ি কিনবে। এইটুকু জায়গা আর এতবড় স্বপ্ন। “গোরুটা একপোয়া দুধ দিয়েছে, উপেন খাবে বিপিন খাবে তাকে একটু দিতে হবে/ নন্দলাল কোলের ছেলে তাকে একটু দিতে হবে/ আমার আবার পোড়া মুখে দই না হলে রোচে না তাকে একটু দিতে হবে…”!  সব্বাইকে দিতে হবে। আমাদের প্ল্যান নিয়ে যে প্ল্যানারের কাছে যাই, তাঁরা হাল ছেড়ে দেন বা যাহোক একটা প্ল্যান গছিয়ে দ্যান, যাতে এইটুকু রান্নাঘর, একটা সোফা রাখার মতো লিভিং রুম… খালি তাঁরা কায়দা করে একটা বড় গ্যারেজ বিভিন্ন দিকে বার করে প্ল্যান দেখাতে লাগলেন। তখন আর কী করা নিজেকেই মাঠে নামতে হল। “Homes and garden” বা House and garden”,এমন নামে একটি পত্রিকায় তখন বিশাল বিশাল বড়লোক মানুষদের বাড়ির প্ল্যান ছাপা হত। কলেজস্ট্রিটের পুরোনো দোকান থেকে কিনে আনা সেইসব পত্রিকায় আমার বইয়ের তাক ভরে উঠল। কিছুতেই আর সমাধান আসে না। শীতের ছুটির বিকেল ঝুঁঝিয়ে নেমে আসছে, আমি আমার প্রাক্তন সেইসব পত্রিকাগুলিতে আমাদের স্বপ্নের বাড়িটিকে খুঁজে ফিরছি, আর সেইসময় বাসাবাড়িতে মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে শেষ গোধূলির কনে দেখা আলো… আমাদের উঠে গিয়ে আর আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না… আলো-আঁধারির চৌখুপিতে বসে বসে আমরা ভাবনার ভেলায় যেন ভেসে চলেছি…  আজ লিখতে বসে সেইকথা মনে পড়ছে খুব।

শেষ পর্যন্ত সমাধান এল  একটি পত্রিকায় মেজেনাইন ফ্লোরে রান্না ঘর দেখে। ব্যস, আর সমস্যাই রইল না। আমাদের বড় লিভিং হল, গ্যারেজ ও বেশ জম্পেশ, আর গ্যারেজের উপর মেজেনাইন ফ্লোরে এই এত্তবড় কিচেন কাম ডাইনিং ও হলো। এই প্ল্যান ছকে প্ল্যানারকে দিয়ে বানিয়ে ফেলা গেল। লিভিং রুমের সাথে সিঁড়ি ঘরটিকে ওপেন রাখায়, সেটি অসম্ভব সুদৃশ্য একটি ব্যাপার তৈরি করল, কোনো অনুষ্ঠান করলে, সিঁড়িটি গ্যালারির মতো কাজ করবে এমন হল। আর রান্নাঘর নিয়ে আমার স্বপ্ন তখন পাখা মেলছে। মেজেনাইন ফ্লোরের উপর অনেকটা জায়গা। সেখানে বেশ L আকারের রান্নার প্ল্যাটফর্ম থাকবে, আর রান্নাঘরে দুটি দেওয়াল পুরো ওপেন রেখেছিলাম। যাতে উপর থেকে রোদ এবং হাওয়া অনায়াসে আমার রান্নাঘরে আসতে পারে। ঝলমলে একটা রান্নাঘরের প্ল্যান ছিল। কিন্তু বাড়ি শেষ করতে করতে টাকা কম পড়ল, আমার রান্নাঘরের শুধু কাঠামোটুকুই হল। তাতে না পড়ল টালি, না রঙ, না কিচ্ছু। যাহোক করে একটা ছোট গ্যাসের টেবিল বানানো হল, পাশে একটা বেসিন। আর আমি করকরে দেওয়ালে পেরেক পুঁতে চারটে লোহার তারের র‍্যাক ঝুলিয়ে নিলাম। তবে একটা ইনডাকশন ওভেন আমি সংযোজন করেছিলাম এই নতুন রান্নাঘরে।

শেষ ভাড়াবাড়ির রান্নাঘরের পাশে এই রান্নাঘর খুব সাধারণ হয়ে গেল। কিন্তু, স্বপ্নটুকু তো বেঁচে ছিল, ভাবতাম কোনো একদিন এই রান্নাঘর ঠিক আমার ভাবনার মতো হবে। এইসময় আমার প্রাক্তন একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন, ফলে অধরা স্বপ্নরা আরো পাখা মেললো। কিন্তু অন্যের চাকরিতে নিজের ভাবনায় স্বপ্ন দেখার কারণেই তা আর হয়ে উঠল না। স্বপ্ন দেখতে হলে ছেঁড়া কাঁথাটিও নিজের অর্জিত টাকায় কেনা হওয়া চাই, এ আমার জীবনের শিক্ষা।
যাইহোক, আমার নতুন বাড়ির রান্নাঘরের দুই দেওয়াল খোলা ছিল। তাতে অ্যালুমিনিয়ামের জানালা বসাব এমন প্ল্যান ছিল, কিন্তু টাকা বাড়ন্ত থাকায় করা হয় নি। ফাঁকা গ্রীল দিয়ে যথেচ্ছভাবে খালপাড়ের ধেড়ে ইঁদুররা অবাধে যাতায়াত শুরু করলো। বড়বড় ইঁদুর গুলো কী করে কে জানে মিটকেসের কাঠের ছিটকিনি খুলে ফেলতে পারতো! ওরা আমার সাধের টাপারওয়্যার কেটেকুটে পুরো তছনছ করে দিল। সমস্ত বিস্কুটের কৌটো ডালের কৌটো এমনকি সর্ষে জিরার মশলার কৌটোগুলি পর্যন্ত ছাড়লো না। কুট্টু ছোট বলে তখন আমি বিষ দিতে ভয় পেতাম, আর, ওরা আমাকে অত্যাচার করে করে অতিষ্ঠ করে তুলছিল। তারপর একদিন অসময়ের ঝড়বৃষ্টিতে আমার রান্নাঘরের ছাদে প্রচুর জল জমে গেল। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল রান্নাঘরের ছাদে জলের পাইপের মধ্যে ইঁদুররা সপরিবারে মরেছে। আট/ দশ খানা ছোটবড়মাঝারি সাইজের মরা ইঁদুর বেরোলো। এই ঘটনার পর থেকে ইঁদুরের উৎপাত পুরো বন্ধ হয়ে গেল। কে ওদের এই দুর্ঘটনার খবর দিয়েছিল কে জানে!
বাড়ি বানানোর পর বেশ একটু টানাটানির মধ্যে পড়ে গেলাম। বাড়ির EMI, ছেলেদের পড়াশুনা ইত্যাদি নিয়ে বেশ মাপজোকের সংসার তখন। বাড়ি করে স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হল বলা যায়। ফলে তখন টুকটাক ঠোকাঠুকি শুরু হতে লাগলো আমাদের দাম্পত্যে। এই ঠুকঠাক আর থামল না। তারপর তো একটানা ঝড়-ঝঞ্ঝা, একটানা ভাঙন কাহিনী। সাধের রান্নাঘরের দিকে তখন আর তাকাতে ইচ্ছে করে না। ভয়ঙ্কর কষ্টকর অবস্থায় এমন করে বছর দুই কাটলো। অর্থনৈতিক কষ্ট নয়, মানসিক কষ্ট। ১৮ই ফেব্রুয়ারী ২০১৭ সালে আমার প্রাক্তন আমাদের এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তখন আমার হাতে জমানো টাকা কিচ্ছু নেই। পার্শ্বশিক্ষিকার চাকরি করে হাতে ৭২০০ টাকা পাই। সঙ্গে দুই ছেলে। সুদীর্ঘ ছয়/সাত মাস অই সামান্য টাকায় জীবন চলেছে আমাদের তিনজনের। মা বাবা কারো কাছে বলি নি, যে অসুবিধা হচ্ছে। একটা চ্যালেঞ্জ ছিল যে পারি কিনা। এই ভীষণ উত্তাল সময়টুকু বয়ে যেতে হবে, এইটাই ছিলা ভাবনা। ছয় সাত মাস পর আমরা পরস্পর যোগাযোগ করে মিউচুয়াল ডিভোর্সের জন্য কেস ফাইল করি। প্রাক্তনও ছেলেদের জন্য টাকা পয়সা পাঠানো শুরু করেন।
এই ছয়- সাত মাসের সময়টুকু ভাগ্যিস এসেছিল আমার জীবনে। নাহলে, নিজেকে নতুন করে জানা হত না। সেইসময় রান্নাঘরের উপাদান বলতে চাল এবং আলু, জলখাবার বলতে মুড়ি এবং চিঁড়ে। সকালে উঠে মুখ ধুয়ে চান করে সেদ্দ ভাত বসিয়ে দিতাম। ব্যাস আমার আর তখন অন্য কোনো কাজ নেই। আমি এরপর আশিস স্যারের গান শুনতে বসে যেতাম। প্রায় একঘন্টা সময় গান শুনে কিছুটা রেওয়াজ করে সামান্য সেদ্দ ভাত খেয়ে স্কুলের পথে হাঁটা দিতাম বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় চার সাড়ে চার কিলোমিটার রাস্তা, দুইবেলায় মোট আট কিলোমিটার রাস্তা রোজ হেঁটেছি। বিকেল বেলায় ফোনের পিডিএফ হাঁটকাতে বসতাম, প্রচুর বই এইসময় পড়া শুরু করলাম। বিদেশী সাহিত্য পড়া শুরু হল এই সময়, পিডিএফ থেকেই। রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে পড়া শুরু করলাম। গীতবিতান আমার প্রাণের সমস্ত কথার যেন লিখিত রূপ, এই ভাবনা তখন আমাকে শিহরিত করতে শুরু করেছে। সংসার জীবনে গল্পের বই পড়ার জন্য গালাগাল খেতাম, এখন যদৃচ্ছা বই আর গান নিয়ে অসামান্য কিছু রান্নাবান্না আমার মনের মধ্যে অহরহ হতে থাকলো। এই রান্নাবান্নার থেকে পুষ্টি আহরণ করা আমার প্র‍য়োজন ছিল, তাইই এমন ঘটেছিল হয়তো।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *