পুনর্ভবাপুত্র। ধারাবাহিক উপন্যাস। দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন আহমেদ খান হীরক।
ইচিং বিচিং চিচিং চো
যাকে পাবি তাকে ধো…
বাড়িটা আমাদের ছিল ঢালের ওপর। জংলামতো জায়গায়। বর্ষায় তো জঙ্গলই মনে হতো। আর গলি। এই গলি ভেঙে ওই গলিকে পাশ কাটিয়ে বাজারের দিক থেকে ঢুকতে হতো বাড়িতে। কিন্তু শুনে নির্জন মনে হলেও বাড়িটা মোটেও নির্জন ছিল না। হইহল্লা সব সময় লেগেই থাকত।
আব্বা-আম্মার সংসারে আমরা চার ভাই তিন বোনের উৎপাত তো ছিলই; সাথে ছিল পাশের বাড়ি থেকে চলে আসা চাচাত ভাই-বোনদের দল। এ ওর থেকে দুই বছরের বড় তো সে হলো এক বছরের ছোট। মানে পিঠাপিঠি একে অপরের হতে হতে সবচেয়ে ছোট জনের থেকে সবচেয়ে বড় জনের বয়সের পার্থক্য গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ১৪/১৫ বছরের। কিন্তু তাতে ভাইবোনদের হল্লা বন্ধ করার মতো গুরুজন আবার কেউ হয়ে ওঠে নি। বড় ভাই অবশ্য ব্যবসা নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত। মেজভাই চলে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাশিয়ার কিয়েভ থেকে তার বরফপড়া ছবি দেখে শীত ধরে যায় মনে। আর বড় বোন তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। হলে। আব্বা সপ্তাহে একবার করে গিয়ে দেখা করে আসেন। কখনো-সখনো ট্রেনে চেপে আমরাও যাই। আমাদের দেখে পাগলের মতো খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এই দুই তিনজনের অনুপস্থিতিতে বাড়ির হল্লা একটু কম হয়েছে ভাবলে খুবই ভুল করা হবে। একটু দূর সম্পর্কের খালাত ভাই নজিদা তখন মাদ্রাসায় পড়ছেন। জায়গির থাকছেন আমাদের বাড়িতে। ওদিকে একটু গ্রাম থেকে আত্মীয়-স্বজনের আসা-যাওয়া তো লাগাই আছে। বাড়ির এই মাথা-নষ্ট অবস্থার মধ্যে সবচেয়ে আলো বেশি যার ওপর পড়ে সে আমাদের ইতি আপা। ইতি আপা কলেজে পড়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে নাটক করছে মঞ্চে। কলেজ থেকে ছাপা হওয়া ম্যাগাজিনে তার কবিতা যাচ্ছে… বাতাসে চুল উড়িয়ে ইতি আপা মেঘের মতো দমকে ফেলছে এদিক-ওদিক। আর তার যোগ্য বন্ধু ছবি আপা তো যেন সিনেমা থেকে উঠে আসা নায়িকা। এমনকি ছবি আপা যে ঘাড়টা একটু বাঁকা করে তাকায়, সেই তাকানোটাও যেন উত্তমের দিকে সুচিত্রা সেন। আমার এত ভালো লাগে যে চোখ মেলে শুধু তাকিয়েই থাকি। আর এটা দেখে ছবি আপা কী যে দুষ্টামি! আম্মাকে বলত, চাচি, আপনার ছেলে তো আমার প্রেমে পড়ে গেছে.. দেখেন না কেমন টুকুর-টুকুর তাকিয়ে থাকে!
আম্মা বলে, তাইলে তো ভালোই। বউ নিয়া আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না।
লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু এইটুকুতেই কি শেষ! ছবি আপা ততক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, কী রে ছোড়া, করবি বিয়া আমাকে?
আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। কপাল ঘামতে থাকে। নাক ঘামতে থাকে। আর তা দেখে ছবি আপা যেন আরো দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। বলে, চাচি দেখেন দেখেন… হীরকের তো নাক ঘামে… ওরে বাবা… ওর বউ তো ওরে খুব আদর করবে… একদম বউসোহাগী ব্যাটা আপনার!
আম্মা হেসে উঠে যায়। যেতে যেতে বলে, ব্যাটা তো আমার এখনই বউয়ের আদর পাচ্ছে দেখা যায়…!
ছবি আপাও হাসে। কিন্তু আমার রক্ত যেন নাক-কান দিয়ে বেরিয়ে আসবে। ওখান থেকে একছুটে তখন কই যে পালাই। হয় ছাদে যাই না হয় লিংকনদের বাড়ি!
লিংকনদের বাড়ি হলো… আমাদের বাড়ি আর লিংকনদের বাড়ির মধ্যে আলাদা কোনো দেয়াল পর্যন্ত নেই। একটা দেয়ালেই দুই বাড়ির প্রাচীর। ওদের বাড়িতে গেলেই ভিসিআর! ফুল অর কাঁটা…ধীরে ধীরে পেয়ার কো বাড়ানা হে… আর মেরি আপা!
মেরি আপার কথায় না হয় পড়ে আসি।
এখন তো চলছে ছবি আপার কথা। ঠিক চলছেও তো বলা যায় না। মানে এখন চলছে ছবি আপার কাঁটাছেড়া!
আঙিনায় ইতি আপা ওভাবেই বসে আছে। আম্মাও পাশে বসা। আমাকে এই শরীর নিয়েই কয়েকটা টুল এগিয়ে দিতে হলো। কারণ পাড়ার খালা-চাচিরা চলে এসেছে এর মধ্যেই। আর এসেই প্রথমে যে কথাটা বলছে সেটা হলো ছবির সাথে যে এমন কিছু হবে তারা তা জানত!
তা কী হয়েছে ছবির সাথে?
ইতি আপাকেই বলতে হচ্ছে বারবার।
ঘটনাটা এমন ছিল…
ইতি আপা আর ছবি আপা মিলে কলেজ থেকে ফিরেই ঝাঁপ দিয়েছিল পাথরঘাটে। রুমা আপা মেরি আপারা আগে থেকেই ছিল সেখানে। বর্ষার পানি নামতে শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু এখনো ঘাটের আশ-পাশটা জুড়ে কচুরির থোপ জেগে আছে। হেল্লু ছেড়ে আপারা ঠিক করে লুকাচুন্নি খেলার।
লুকাচুন্নি মানে আসলে লুকোচুরি খেলা। নদীতেও এই খেলা দিব্যি যে খেলা যায় তা ইতি আপাদের না দেখলে আমার বিশ্বাস হতো না। তা তারা চারজন মিলে লুকোচুরি খেলতে শুরুও করে দিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে ছবি আপা সবচেয়ে বেশি জেতে। পুলিশ হয়ে তিনবার জেতার পর তাকে জোর করে চোর বানানো হয়। ছবি আপা হাসে তখন। হাসলে যে ছবি আপার টোল পড়ে এটা আমাদের রহনপুরের সবাই জানে। হেসে হেসে ছবি আপা বলে, চোর বানাইলি তো… দেখিস, আমাকে আর ধরতেই পারবি না তোরা!
ছবি আপা দিলো ডুব। পুনর্ভবায় ডুব। তারপর মিনিট কাটে, ঘণ্টা কাটে… ছবি আপাকে আর কেউ পায় না। ইতি আপারা ডাকে ছবি আপার নাম ধরে। প্রথমে ধীরে… তারপর পুনর্ভবাকে অস্থির করে। গুজরঘাট থেকে মাঝিরা চলে আসে। তারাও ডাকে। ল্যাংড়া বাবু ভাই তার ডিঙি বেয়ে আসে। বৈঠা দিয়ে পানি সরিয়ে সরিয়ে দেখে। ঘাটের আশে-পাশের কচুরিপানা সাফ করে দেয় সবাই মিলে। ছবি কোথাও লুকিয়ে নেই। ছবি কোথাও ডুবে নেই। ছবি কোথাও ভেসে নেই। ছবি কোথাও নেই। ছবি পুনর্ভবার কোথাও নেই।
আনতারা খালা মুখে এক খিলি পান চালিয়ে দেয় এরই মধ্যে। মিষ্টি জর্দার কী যে একটা ঘ্রাণ! আমার মুখে পানি চলে আসে। পান চিবাতে চিবাতে আনতারা খালা বলে, ছবির যে চেহারা-সুরত, অর তো এইরকম হইতোই। আঙিনায় বসা অন্যরাও সে কথায় সায় দেয়। আমি বুঝতে পারি না চেহারা-সুরতের সাথে এমন হারিয়ে যাওয়ার কী সম্পর্ক!
বীনা চাচি বলে, কিন্তু তাই বলে এই মাঝদুপুরে?
আনতারা খালা বলে, মাঝদুপুর আর কী! বদমাইশগুলা তো দুপুর পার করে বিকালে চুল ভিজিয়েছে।
আম্মা বলে, কতবার ইতিকে বলেছে কলেজ শেষ করেই নদীতে যাওয়ার দরকার নাই। বাড়িতে কল আছে, কলে গোসল করবে!
বীনা চাচি বলে, কিন্তু সন্ধ্যা হলেও নাহলে এক কথা ছিল, তাই না? আপনারা সবাই অই রকম ভাবছেন ক্যান?
আনতারা খালা ঝ্যানঝ্যানিয়ে ওঠে, নাহলে আর কী ভাবব? ছবি এক ডুবে আরেক পাড়ে গিয়ে উঠছে? তারপর টমাটোর ভুঁইয়ে গিয়ে লুকিয়ে আছে?
ইতি আপা অপরাধীর চোখে তাকায়। বলে, আমরা ওইপাড়েও খুঁজেছি। পাইনি।
আনতারা খালা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, এই, তুই মেয়ে মানুষদের মধ্যে কী করিস রে! যা… ঘরে যা…
আম্মা বলে, যাও। টিভি দেখোগা…
আমি চলে যাই। কিন্তু আঙিনা থেকে মন উঠাতে পারি না। ওদের মধ্যে একটা ফিসফিসানী। আনতারা খালা যা বলছে তা সবাই যেন মেনে নিচ্ছে। কিন্তু আনতারা খালা যা বলছে তা বুঝে উঠতে পারছি না আমি। শুধু বুঝতে পারছি তা খুবই ছমছমে একটা ব্যাপার। কিছু না বুঝেও আমার গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে। একা একা টিভির ঘরে থাকতেও কেমন যেন ভয় লাগছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ওই তো জানলা দিয়ে পুনর্ভবাকে দেখা যাচ্ছে… কিন্তু এই ভরসন্ধ্যার পুনর্ভবাটাকে কেমন যেন অচেনা লাগতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে হঠাৎই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা মাথা বেরিয়ে আসবে। কালিমাখা মাথা। চোখ নাই মুখ নাই নাক নাই ঠোঁট নাই… আছে শুধু অন্ধকার। আমার মনে হতে থাকে আবারও বোধহয় জ্বর আসছে! শরীরের ভেতরে কিছু একটার তাপ যেন বাড়তেই থাকে।
সাধারণত বিটিভির আটটার সংবাদের সময় আমরা খাবার খাই। কিন্তু সে রাতে সব কিছুই অন্যভাবে ঘটতে শুরু করল। আব্বা ছবি আপাদের বাড়ি থেকে ফিরলেন সাড়ে নয়টার দিকে। জানালেন পাথরঘাটে জনা বিশেক লোক নামানো হয়েছে। শুধু পাথরঘাট না, পাশের গুজরঘাট আর উল্টো দিকের সিঁড়িঘাটেও লোক আছে। খোঁজ চলছে।
রাত দশটার ইংরেজি খবর চলতে থাকে টিভিতে। এসময় হঠাৎ হঠাৎ রাজা কনডোমের এড দিয়ে দেয় বলে আমরা সাধারণত ডিডিওয়ান দেখি। কিন্তু কেউ অ্যান্টেনা ঘোরাতে ভুলে গেছে–চ্যানেলের নব ঘোরাতেও ভুলে গেছে। আম্মা মাদুর পেতে ভাত বাড়তে শুরু করেছেন। এসময় পাথরঘাটের দিক থেকে হল্লা আসে। কেমনই যেন শব্দ। অনেক মানুষ এক সাথে কথা বলছে… কাউকে কিছু বলতে হয় না। কিন্তু আমরা বাড়ির সবাই এক সাথে দৌড়ে যাই ছাদে। আব্বার হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট। সেটা পাথরঘাটের দিকে তাক করে মারেন। বলে, বাবু, আছিস নাকি তোরা…
ওদিক থেকে ল্যাংড়া বাবু ভাইয়েরও কণ্ঠ শোনা যায়—চাচা…
‘কী হলো রে? চেঁচাস ক্যান তোরা?’
বাবু ভাইও এবার তার টর্চটা মারে আমাদের দিকে। ঝিঁঝি ডাকছিল এতক্ষণ। আলোয় হঠাৎই চুপ করে যায়। বাবু ভাই বলে, ছবিকে পাওয়া গেছে!
আম্মা বলে, আলহামদুলিল্লাহ!
আব্বা বলে, জ্ঞান আছে?
বাবু ভাই বোধহয় জান আছে কিনা এমন শোনে। তাড়াতাড়ি বলে, জান আছে চাচা। ধুকপুকি আছে… কিন্তু সারা শরীর নীল। নীলে একদম কালো হয়ে গেছে…বাড়িতে নিচ্ছি ওকে…
আম্মা আমাকে কাছে টেনে নেয়। বলে, আনতারা বুবু যা বলছিল তাইলে সেইটাই ঠিক!
আমি বুঝে উঠতে পারি না কোনটা ঠিক। কী বলেছিল আনতারা খালা। তবু আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। ঝিঁঝিরা আবার ডাকতে শুরু করে।
(ক্রমশ)