অক্সিজেন। পর্ব ৭। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

শ্রীহীন শ্রীমন্তী

বাসস্ট্যান্ড থেকেই টোটো নিয়েছিল ও। মিহিরদার গলাটা টোটো থেকেই শুনতে পাচ্ছিল। দিদির চাপা প্রতিবাদও কানে আসছিল।

ও এসব শুনতে চায়নি। তবু শুনল। মিহিরদা চিৎকার করে বলছে, “বেরো,বেরো বাড়ি থেকে। তোর মুখ দেখতে চাইনা।”

কুহু টোটো থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে এগোল দরজার দিকে। শ্রী হীন বাড়ি একটা। ভাঙা ভাঙা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দরজার কড়া নাড়িয়ে ডাকল ও, “দিদি, দরজা খোল। আমি এসেছি।”

দরজা খুলে এসে দাঁড়াল মিহিরদা। ময়লা পাজামা, খালি গা। গায়ের ওপর গামছা ফেলা। ওকে দেখে থমকে গেল। তারপরেই খুব নিস্পৃহ ভঙ্গিতে সরে দাঁড়াল একপাশে।

ঘরের ভেতরের তক্তপোশে চুপ করে বসেছিল দিদি। ওকে ভেতরে ঢুকতে দেখেও নড়ল না। আস্তে আস্তে গিয়ে ও দাঁড়াল দিদির কাছে। সারা ঘরে একটা গুমোট গন্ধ। জানলার পাল্লা খুলে দিল কুহু। পেছনের ঘেরা বারান্দার দরজাটাও খুলে দিল। একটা স্টোভ, কড়া, হাঁড়ি। ইঁটের ওপর কাগজ পেতে মশলাপাতি, রান্না খাবার রাখার ব্যবস্থা।

ও এসেছে মিনিটখানেক হল। দিদি তবু তাকাল না ওর দিকে। ঘরের এককোণে দড়ি টাঙিয়ে সেই দড়িতে পাটপাট করে রাখা হয়েছে দিদির কাপড়, শায়া, ব্লাউজ। দেওয়ালের গায়ের হুকে টাঙানো হ্যাঙারে মিহিরদার কিছু পোশাক। দেওয়ালের একপাশে তাকের প্রথম ধাপে আয়না চিরুনী, পরের তাকে বাসন ইত্যাদি। কোণে দাঁড় করানো একটা সুটকেস ছাড়া ঘরে আর কোন জিনিস নেই। এই সুটকেসটা নিয়েই দিদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রং চটে যাওয়া কালচে লাল সুটকেসটা দিদি প্রথম ট্যুশানির টাকা জমিয়ে কিনেছিল। না ওদের বাড়ির কোন জিনিস দিদি সেদিন সঙ্গে নেয়নি। একটা আলপিনও না।

দিদির ডাক নাম কেকা। ভালো নামটা মনে পড়ল ওর, শ্রীমন্তী। ঘরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথাটা আবার ভাবছিল ও। শ্রী রাখার একটা চেষ্টা এ ঘরেও আছে। তবে সবটা ছাপিয়ে প্রকট হয়ে আছে অর্থাভাব।

ঠিক একবছর আগে লক্ষ্মীপুজোর দিন রাত আটটা নাগাদ দিদি বাইরে বেরিয়েছিল। আর ফেরেনি। স্যুটকেসটা সম্ভবতঃ সারাবার নাম করে আগেই চালান করেছিল। চিঠি লিখে চাপা দিয়ে রেখেছিল ডেস্কটপের টেবিলে। চিঠিটা প্রথমে নজরে আসে ওর।

মাকে ও বলেনি কিছু। সারাদিনের উপোসের পর পুজো শেষ হলে ফলপ্রসাদ ভাগ বাটোয়ারা  করে এবাড়ি ওবাড়ি পাঠিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসেই মার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “কেকা কোথায়? ওকে দেখছিনা তো।” পুজো চলাকালীন বেচারি মা কোনদিকে নজর দেয়নি।নাহলে দিদির অনুপস্থিতি এত সহজে মায়ের নজর এড়াত না।

ও মিথ্যে করে বলেছিল, “জয়শ্রীদি ডেকে নিয়ে গেল। এক্ষুণি আসবে। তুমি সারাদিন উপোস করে আছ, কিছু খাও।” মুখের চেহারাটা যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রেখেছিল ও। নাহলে মায়ের উপোস সেদিন কাটত না।

বাবা, মা, ও, তিনজনে বসে ফলপ্রসাদ খেয়েছিল। মা বারবার বলেছিল, “দিদিরটা গুছিয়ে রেখেছিস তো। ও আসার আগেই আমায় খাইয়ে দিলি।”

মার পুজোর পোশাক ছাড়া, ঠাকুর ঘরের যাবতীয় কাজ শেষ হলে, যখন,“ কেকা কখন আসবে? একবার ফোন করে দেখতো।” কথাটা ঘনঘন বলতে শুরু করল, ও নিঃশব্দে চিঠিটা মার হাতে দিয়েছিল। মার পড়া শেষ হবার আগেই বাবা ছিনিয়ে নেয় চিঠিটা।

দিদির ঘরে  যতবার ও এসে দাঁড়িয়েছে, সিনেমার শটের  মত ওই  ছবিটা সামনে ভেসেছে। ওনিয়ে আর ভাবেনা ও। সেদিন রাতে দিদির চিঠি প্রাপ্তির থেকেও ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল একটা। বাবার সেরিব্রাল এ্যাটাক হয় বাথরুমে। বাবাকে নিয়ে নার্সিংহোম আর ঘর করতে হয়েছিল কদিন। দিদির খোঁজ করতে পারেনি ওরা।

জানলা খোলার পর ঘরের মধ্যে একটা অনুজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। একটা ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্কের ছবি, সে আলোতে, এ ঘরের সবকিছুতেই কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে দিদির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ও। হাত রাখে দিদির চুলে। পিঠের পেছনে লেপটে থাকা বিনুনীটা কেমন যেন ক্ষীণ দেখায়। গলার দুপাশের গর্তে আঙুল ডুবিয়ে তুলে নেয়। ছিঃ! দিদি এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছে যে কন্ঠার পাশে হাত ডুবে যায়।

ঠিক তখনই ঘরে ঢোকে মিহিরদা, “আমি আর পারছি না। কুহু, তোমার দিদিকে নিয়ে যাও। আমি এবাসার ভাড়া টানতে পারব না।”

কেকা তাকায়। স্বাভাবিক ভাবে বলে, “ওর কথা ছেড়ে দে। মাথাগরম হলেই আবোলতাবোল বকে।”

“মানে? আমার কাজ চলে গেল। এই লকডাউন পিরিয়ডে কী খাওয়াব তোমায়? তুমি কুহুর সঙ্গে চলে যাও।”

“না। আর একবারও ওকথা বলো না। আমি কাজ নেব। ট্যুশান করব।”

“আর নাটকবাজি করো না। যাও কুহুর সঙ্গে ফিরে যাও। খেতে জুটছে না। যত সব সিনেমার ডায়লগ ঝাড়ছে।”

আর দাঁড়ায় না মিহিরদা। একটা জামা গলিয়ে চটি পায়ে দিয়ে খটখটিয়ে বেরিয়ে যায়। দিদি থমকায়না। ওর পাশে এসে বসে।একগাল হেসে বলে, “ভয় পাস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

দিদির সঙ্গে মায়ের মিল এই এক ব্যাপারেই। অসম্ভব জেদ দুজনেরই। দিদি চলে যাওয়ার প্রায় মাসদুয়েক পরে বাজারে পাপু  দিদিকে দেখে ফলো করে দিদির ঠিকানা সংগ্রহ করে। ওই খবর দিয়েছিল ওকে। মাকে ঠিকানাটা জানাতে গিয়েছিল ও। মা বলেছিল, “আমি শুনব না। ওটা তোর কাছেই থাক। তোর বাবাকেও বলবি না। এটা আমার এব্যাপারে শেষ কথা।” ও যে দিদির কাছে আসে মা হয়ত বোঝে। কিছু জানতে চায়নি। আসলে সেদিনের পর থেকে দিদির নাম ওদের বাড়িতে আর কেউ করেনা।

তক্তপোশের ওপর কাঠ হয়ে বসে থাকা দিদিকে সহজ করার জন্য কুহু বলে,  “কিরে চা করবিনা?”

দিদি এবার হাসে। “চা ,দুধ ,চিনি, কিছুই নেই যে। এক কাজ কর সামনের দোকান থেকে দু কাপ চা নিয়ে আয়। বলবি লিখে রাখতে। পরে দিয়ে দেব।”

সেদিন দিদির বাড়ি ফেরৎ কলেজে যেতে যেতে ভাবছিল ও,  দিদির মধ্যে এখন কিসের বাস? প্রেমের না জেদের?

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৭। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *