অক্সিজেন। পর্ব ৪১। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

সাফল্যের অক্সিজেন

কুহু আবার তাকাল দর্শকদের দিকে।অনেকক্ষণ ধরে কথা বলায় ওর গলায় একটু চাপ লাগছে।হল একেবারে ভর্তি।এতদিন ও নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিজের কথা বলেছে।আজ এসে দাঁড়িয়েছে নিজের শহরের মানুষের কাছে। এতজন মানুষ এসেছে শুধু ওর কথা শুনতে। টেবিলের ওপরে রাখা জলের গ্লাসে একবার চুমুক দিল ও। তারপর আবার বলতে শুরু করল।এবার ও বলবে অক্সিজেন ছাড়াই  ধবলগিরি জয়ের কাহিনি।

“মানাসুলু গিয়েছিলাম আমি।সরকারি ভাবে তখন যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হই।তাই কোন পয়সা লাগেনি।মানাসুলু পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ।আট হাজার একশো তেষট্টি মিটার,মানে ছাব্বিশ হাজার সাতশো একাশি ফিট উচ্চতা।মানাসুলুতে বিদেশী পর্বতারোহীরা এসেছিলেন।তাদের মধ্যে একজন অক্সিজেন ছাড়াই পাহাড়ে উঠতেন। বিদেশীদের সেজন্য আলাদা প্রশিক্ষক থাকে,ডাক্তার থাকে।এমনকি দেশে অক্সিজেন ছাড়াই বিশেষ চেম্বারে আর্টিফিশিয়ালি ওঁরা হাই অল্টিচ্যুডে অক্সিজেন নেই এমন কন্ডিশান ক্রিয়েট করে ট্রেনিং নেন।ওনারা অক্সিমিটারে সারাক্ষণ অক্সিজেন স্যাচুরেশান মাপতে থাকেন।আমারটাও মেপে দেবেন বলায় আমি রাজি হয়ে যাই। তখনই দেখা গেল আমার অক্সিজেন স্যাচুরেশান আটানব্বই  থেকে নিরানব্বই। আমরা ছিলাম পাঁচহাজারেরও বেশি উচ্চতায়।ওনারা  সেখানে ট্রেনিং নিয়েও ছিয়াশি।  আর মেডিক্যাল সায়েন্স অনুযায়ী ওখানে তিরাশি থেকে চুরাশি অক্সিজেন স্যাচুরেশান হওয়ার কথা।তখন ওঁরা বলেছিলেন তুমি অক্সিজেন ছাড়াই আটহাজার ফিট করতে পারবে।সেই কারণেই আমি সিদ্ধান্ত নিই অক্সিজেন ছাড়াই আমি আটহাজার ফিটের ওপরে উঠব।

মার্চ মাসে আমি অন্নপূর্না ওয়ান শৃঙ্গে ওঠার পরিকল্পনা করি। সেটা সম্ভব হয়না।তারপরে পৃথিবীর চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ, লোৎসে যাবার কথা ভাবি।কিন্তু লোন পাওয়া যায়নি।পরে সিদ্ধান্ত নিলাম ধবলগিরিতে উঠব।সেইমত প্রস্তুতি চলতে থাকে। একজন সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্যে সেপ্টেম্বর মাসে আমি যাই কাটমান্ডু। সেখা্নে পাঁচ ছ’দিন থেকে যাই পোখরা। পোখরা থেকে যাই মারফা। মারফা পশ্চিম নেপালে। সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম। মারফা থেকে ধবলগিরি বেসক্যাম্প যাওয়া খুব শক্ত।আমরা খাড়াই পথ বেয়ে তিনদিনে পৌঁছই।

এবারেও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।অভিযান শুরুর আগেই আমার ভালরকমের জ্বর হয়। কাটমান্ডুতে যাওয়ার দুদিনের মধ্যে জ্বর।প্রায় দশদিন কিছু খেতে পারিনি। প্রচন্ড দুর্বল।অথচ বেসক্যাম্পে পৌঁছে ওই হাই অল্টিচ্যুডে আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।আমার শরীরের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে।সমতলে শরীর খারাপ হয়, কিন্তু উচ্চতায় শরীর ঠিক হয়ে যায়। জ্বরের জন্য এ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে আবার পেটে যন্ত্রনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।মানে গ্যাস্টিকের পেন হচ্ছিল ।সকালে শুধু চকলেট খেয়ে, জ্বর নিয়ে একদম খালি পেটে হাঁটছি আর রাতে জোর করে একটু খাচ্ছি।সকালে উঠে আবার পেটখারাপ, বমি বমি ভাব।

কিন্তু বেসক্যাম্পে গিয়ে শরীরে জোর এসে গেল। খাওয়াদাওয়াও ভাল করে করতে পারছিলাম। আমার পাহাড়ে গায়ে জোর এসে যায়। ওখানে আমরা তিনদিন থেকে আবার ক্যাম্প ওয়ানে যেতে শুরু করলাম। ধবলগিরিতে ভীষণ তুষার ঝড় হয়।ওই আবহাওয়ার জন্য গত তিনবছরে একটার পর একটা অভিযান ব্যর্থ হয়।তিনবছর পর আমরাই সামিট করতে পারলাম ।

ধবল গিরিকে তুষারঝড়ের পাহাড় বলা হয়। সারাক্ষণ ঝড়ো হাওয়া বইছে,আর সেই হাওয়ার সঙ্গে তুষারকুঁচি উড়ছে।ওইরকম অবস্থায় শরীরে অক্সিজেন কমে গিয়ে কখনো লান্সে,কখনো ব্রেনে জল জমে।লান্সে জল জমলে তাকে ডাক্তারির পরিভাষায় ‘হেপ’ বলে।তখন লান্স বিকল হয়ে কাশির সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত বার হয়।কখনও কখনও আবার ‘হেকে’ হয়। সেক্ষেত্রে ব্রেনে জল জমে। ব্রেন কাজ করেনা। তখন হয়ত তার মনে হতে পারে গরম করছে,আর সে গরম জামাকাপড় খুলে ফেলে ।ফলে ঠান্ডায় জমে যায়।অক্সিজেনের অভাবে ফ্রসব্রাইট হয়ে যায়। পাহাড়ে কোন অসুস্থতাই চাপতে নেই। ‘হেকে’ হলে ব্যালান্স কমে যায়। পাহাড় থেকে তখন খাদে পড়ে যাবার ভয় থাকে ।অক্সিজেনের অভাবে রক্ত সঞ্চালন না হয়ে ফ্রস্টবাইট হলে নাকের ডগায়,আঙুলের ডগায় পচ ধরে।তাই উচ্চতায় অক্সিজেন শরীরের জন্য খুব দরকারি একটা জিনিস।

ক্যাম্প ওয়ান থেকে পরের দিন ক্যাম্প টু যেতে হবে। কিন্তু একবার নেমে বেস ক্যাম্প থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আসতে হবে। আমাদের পাহাড়েও অনেক জিনিস নিজেকে বইতে হয়।তাই একবার উঠে আবার নেমে জিনিস নিয়ে আসতে হয়।আর ওভাবেই শরীর আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়।আমার শরীরে যদিও তার দরকার করে না।পাহাড়ের উচ্চতাতেও আমার ওইধরণের কোন অসুবিধা হয়না।

শেরপা সাহেব তাই শুধু আমাকে বললেন “তোমাকে আর নামতে হবে না ।তুমি এগিয়ে ক্যাম্প টু তে যাও। আমি জিনিসগুলো মানে পতাকা,ঠাকুরের ছবি ইত্যাদি  নিয়ে আসছি।” কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম।সবাই বেস ক্যাম্পে নামার পর এমন তুষারঝড় শুরু হল কেউ আর ক্যাম্প টুতে উঠতেত পারল না। আমিও ক্যাম্প থ্রি তে যেতে পারলাম না।একদম একা ওভাবে দু’রাত্রি তিনদিন কাটাই।

ছহাজার তিনশো মিটার উচ্চতায় একদম একা। চারদিকে শুধু বরফ।অন্য ক্যাম্পে হয়ত মানুষ আছে।কিন্তু ওখানে কেউ কারোর নয়। ওয়াকি টকিতে শেরপাদের সঙ্গে কথা বলছি।শেষে ওয়াকি টকির ব্যাটারিও কাজ করছে না। নিজে জল গরম করে খাবার গরম করে খাচ্ছি।স্লিপিং ব্যাগে একা ক্যাম্পে ঘুমোচ্ছি। শেরপা সাহেবরা টেনশানে পড়ে গেছেন।

সবাই বলে ওই উচ্চতায় একা থাকলে হ্যালুসিনেশান হয়।আমি দিব্যি আছি।আমার কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।

তারপর শেরপা সাহেব এলেন।আমি ওয়েদার খারাপ বলে আসতে বারণ করেছিলাম।বাকিরা আরো দুদিন বাদে এলো। কিন্তু ছহাজার তিনশো মিটারে পাঁচদিন থাকাও সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার।একদিন থাকলেই শরীর খারাপ হয়ে যায়।আমি দিব্যি তরতাজা হয়ে গেলাম।ক্যাম্প থ্রী সাত হাজার তিনশো মিটার উচ্চতায়।আমরা  রওয়ানা দিয়েও তুষারঝড়ের জন্য ক্যাম্প টু আর থ্রির মাঝে আটকে গেলাম। সেখানেই সেফ জায়গা খুঁজে তাঁবু খাটানো হল।

পরের দিন আবার আমরা ক্যাম্প থ্রীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।সাত হাজার দুশো মিটারে ক্যাম্প টু’ আর সাত হাজার তিনশো মিটারে ক্যাম্প থ্রীতেই সামিট ক্যাম্প।আর সামিট হবে আটহাজার একশো সাতষট্টি মিটারে। দুপুরে আমরা সামিট ক্যাম্পে পৌঁছলাম।আবার সেইদিনই আমরা সামিটের জন্য উঠতে শুরু করলাম রাত নটায়।মাথার হেডফোনের আলোয় পথ দেখছি। সেদিন ফাইনালি আমি জানিয়ে দিয়েছি যে অক্সিজেন ছাড়াই যাব।

আমার ব্যাগে অক্সিজেন নেই। কিন্তু অন্যদের মত একই স্পীডে উঠছি । সেদিন বুক পর্যন্ত বরফ হয়ে গিয়েছে, আর তুষার ঝড় হচ্ছে।আমাদের ফেরৎ আসতে হল সাত হাজার চারশো মিটার  থেকে। সবাইকার মন ভেঙে গেল ।অভিযান পরিত্যক্ত হবার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা। কিন্তু শেরপা দের লিডার আবার সবাইকে উৎসাহ দিলেন,বললেন, ‘আর একবার চেষ্টা করা হবে।’ তিনি আবার পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন।

পরেরদিন সূর্য উঠল। ওয়েদার ভাল। সেদিন আমরা সবাই রাত ছটায় সামিটের জন্য রওয়ানা দিলাম।সারা রাত ধরে ওঠা হল। ভোর সাড়ে ছটায় সামিট করা গেল। মানে আমরা ধবলগিরির চূড়ায় মানে আট হাজার একশো সাতষট্টি মিটারে পৌঁছে গেলাম। এই ওঠার সময় আমার ব্যাগে খাবার ছিল। জল ছিল। কিন্তু অক্সিজেন নিইনি।

ওখানে গিয়ে ছবি তোলা হল। ভিডিও করা হল।পতাকা টাঙানো হল। দেবতার ছবি কে চকোলেট দিয়ে পুজো করা হল। আবার পতাকা নিয়ে আমরা ফেরত এলাম। কারণ ওখানে দূষণের জন্য পতাকা রেখে আসা হয়না।সন্ধে ছটায় রওয়ানা দিয়ে পরের দিন সকাল সাড়ে ছটায় পৌঁছনো হয়েছে। মিনিট পনেরোর মত থেকে আবার নামা।প্রায় ছাব্বিশ ঘন্টার মত একটানা চলা। ক্যাম্প টু তে এলাম সন্ধে আটটায়।পরদিন আবার ক্যাম্প ওয়ান হয়ে বেস ক্যাম্পে নেমে এলাম।

কুহু ওর পাহাড়ে ওঠার কাহিনি শেষ করার পর হলে এক অদ্ভুত নিস্তব্দতা নেমে এসেছিল।সবাই চুপ করে ছিল বেশ অনেকক্ষণ।তারপর একজন একজন করে প্রায় প্রত্যেকে ওর সাফল্যে খুশি হয়ে হাততালি দিতে শুরু করে।

কুহু চুপ করে দাঁড়িয়েছিল ডায়াসে।বাচ্চু ,অনু ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।নামতে নামতে কুহু ওর মা আর দিদিকে দেখে একবার । বাবা নেই আজ।তাই বোধহয়  মা চশমা মোছার ভান করে নিজের কান্না লুকোচ্ছিল। দিদির দৃষ্টি সেরকমই আনমনা।

কুহু ভাবছিল অনেক পাহাড়চূড়োই অধরা থাকে। কেউ হাত না ধরলে তা অতিক্রম করা যায়না।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৪১। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. কত খুঁটিনাটি জানা যায় এমন একটি উপন্যাস থেকে। কত রকম অসুখ, অসুবিধা পাহাড়ের, একটি শৃঙ্গ জয় সহজ তো নয়। আর শেষ বাক্যটি কি অপূর্ব, জয়ী হয় একজন কিন্তু একটি জয়ের পেছনে থাকে অনেকগুলি মুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *