অক্সিজেন। পর্ব ২৭। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

পথের ইশারা

সোমাদির কাছে যাওয়ার কথা বলেছিল বাচ্চু। ওর সোমাদির দেওরের সাথে জমাটি  বন্ধুত্ব আছে।বাড়িতে যায় মাঝেমাঝেই।একদিন কথা প্রসঙ্গে ও বলল, “পাহাড়ে ওঠার জন্য তোর এত পাগলামী, সোমাদির কাছে গেলে পারিস।”

তখন ও সেভাবে চিনত না সোমাদিকে। “সোমাদি? কে সোমাদি?”

“আমার বন্ধু দীপের বউদি।ওরও তো পাহাড়ের নেশা।এমনিতে ফিজিওথেরাপীর ট্রেনিং আছে বলে থেরাপী করেই উপার্জন করে।কিন্তু আসলে সোমাদি মাউন্টেয়ারিং এর ট্রেনার।ওই ট্রেনিং দিতে গিয়েই তো দীপের দাদার সঙ্গে আলাপ।বিয়ে হয়েছে প্রায় উনিশ বছর। ছেলের বয়স পনেরো।ওর বয়স,তা চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবে।কিন্তু এখনও প্রচন্ড ফিট।”

কুহু  ওর উচ্ছ্বাসে বাধা দিয়ে বলেছিল, “দাঁড়া দাঁড়া । আমায় বুঝতে দে।সুগতদার বউ কী?ওই যে সুগতদা, স্টেটব্যাঙ্কে কাজ করে। ফর্সা লম্বা মতন।আমার সঙ্গে একবার গোপালবাগের পূজোয় ওর বউএর আলাপ হয়েছিল। খুব ভাল ধুনুচি নাচল।গায়ের রঙ কালো। কিন্তু ব্রাইট দেখতে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস।ওর বাড়ির নাম ছিল শ্যামা।এরা সোমা বলে ডাকে। তোর সঙ্গে আলাপ হয়েছে,তাহলে তো মিটেই গেল।সকাল পাঁচটায় মেরি পার্কে গেলে ওকে পাবি।ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যায়, এক দেড় ঘন্টা ক্লাবের ছেলেদের ফিটনেস ট্রেনিং দেয়।প্রতি বছর পাহাড়ে ট্রেক করতে যাবেই।তুই ওর সঙ্গে কথা বলে দ্যাখ।”

যাব যাব ভেবেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর।তাই জানাশোনা সত্ত্বেও যোগাযোগ হয়নি।বাড়ির নানা ঝামেলা, দিদিকে নিয়ে চিন্তা,আর সবকিছুর ওপর পড়াশুনার চাপ। অদ্ভুতভাবে শক্তিদার ক্লাবেই দেখা হয়ে গেল।শক্তিদার কাছে ও গিয়েছিল এসব নিয়েই আলোচনা করতে। বেসিক ট্রেনিং তো নেওয়া হয়েছে।এবার তো ছোটখাটো হলেও একটা ট্রিপ করা দরকার। নাহলে গোটা ট্রেনিংটাই তো মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। সোমাদিও এসেছিল শক্তিদার কাছে কোনও কাজে। সাধারণ কুর্ত্তি আর লেগিন্সেও মহিলার চাবুকের মত ধারালো চেহারাটা নজর এড়াচ্ছিল না।বাড়িতে যেতে বলেছিল সোমাদি। কুহু আর দেরি করেনি, গিয়েছিল। পরের দিনই।

মৈত্রেয়ীদি তখন বাইরে। দেখা করতে গিয়েও ফেরৎ এসেছিল ও।তাই সোমাদির কাছে  যাওয়া। তেমন কিছু আশা নিয়ে যায়নি।কিন্তু ওখানেই শুরুর সঙ্কেত এলো। জুলাই এর প্রোগ্রামটার সূত্রপাত হল ওখানেই। সোমাদিরা ছোটখাটো একটা ট্রিপ করছে।রাহুল স্ফিতি ভ্যালির ইউনাম শৃঙ্গের কথা ভাবছে ওরা।ওর বেসিক ট্রেনিং হয়েছে শুনে সোমাদি ওকে বলেছে বাড়ির মত নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করতে।এখন ও ঠিক নেই।তবে জুলাইয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে ওরা।

মাঝেমাঝে ওর মনে হয় ফুল ছড়ানো থাকে।কুড়িয়ে নিতে হয়।মালা গাঁথে আরেক জন।এই প্রোগ্রামটায় ওর যোগ দেওয়াটা প্রায় সেরকম।

সোমাদির কাছে কথা বলে আসার দু’একদিনের মধ্যেই ফোন করেছিল সোমাদি। যাওয়ার দিন মোটামুটি স্থির হয়ে গিয়েছে।কুড়ি হাজার করে লাগবে মাথাপিছু।ওর কথা শুনে সোমাদি ওকে বলেছে যতটা পারে যোগাড় করতে।বাকিটা আস্তে আস্তে দিলেও হবে। আপাততঃ ওই সামলে নেবে।তাছাড়া ক্লাবের পক্ষ থেকে কাউকে কাউকে এসব ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়ার রীতি আছে।যদি সেখানেও কিছু আর্থিক সাহায়্য ওকে দেওয়া যায়, সোমাদি ষে ব্যাপারটা দেখবে।

মা বলছে “কিছু ভাবতে হবে না। তুই চলে যা।এ’কটা দিনের ঝামেলা আমি ঠিক সামলে নেবো।”

আসলে মূল সমস্যা টাকাপয়সা নয়।বাড়ি কে সামলাবে সেটা ভেবেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।বাবার পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই। দিনদিন আরো খারাপ হচ্ছে। সেখানে মার ঘাড়ে এইবয়সে সবটা দায়িত্ব চাপানো কি উচিৎ হবে?যদিও কয়েকমাস বাকি, তবু চিন্তাটা ওকে জ্বালিয়ে মারছে।

এরমধ্যে আবার অন্য একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে। অনু এক কবির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনু এমনিতেই বড় বেশি আবেগপ্রবণ। এখন ও লাগামছাড়া।বাড়ির কথা শুনছে না।যত্রতত্র ওই কবির সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কোন এক কবিতা পাঠের আসরে অনুর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে।অনুর ধারণা বাংলাভাষায় সে একদিন শ্রেষ্ঠ কবি হয়ে উঠবে।কুহু ভাবছিল ছেলেটাকে একবার দেখা দরকার।শেষপর্যন্ত এক রবিবার সেই সাগর বলে ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করাতে অনু  নিয়ে গেল ওদের।ওর একদম ভালো লাগেনি।বাচ্চু ,পাপুও সঙ্গে ছিল তো।ওদের সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে অনু নির্দ্বিধায় সাগরের সঙ্গে চলে গেল। না চা পান না গল্পগাছা। কিছুই হল না।

পাপু বলল, “যাঃ শালা, অনু আমাদের ফুটিয়ে দিল!”

বাচ্চু বলল “মাইরি বলছি এই সব লিলি মার্কা ছেলেপুলেগুলো একদম সুবিধের হয় না।অনুটাকে পালটে দিল মাইরি।”

কুহু বাচ্চুকে জোরে চিমটি কেটেছিল একটা। “হতভাগা, তোর হচ্ছে!একবার নয় দু’দুবার আমার সামনে তুই ওই শব্দটা বললি?”

পাপু ফুট্‌ কেটেছিল, “ওর চাকরিটা ওই শব্দটার জন্যই নট্‌ হয়ে যাবে একদিন।”

“মাইরি আর কী? তখন তুমি সেটাতে ঢুকবে তাই না?” বাচ্চু উত্তেজিত হয়ে কথাটা বলে ফেলেই ওর দিকে তাকিয়ে জিভ কেটেছিল।

সাগর ছেলেটা দেখতে খারাপ নয়।লম্বা,ফর্সা,চুল উলটে পেছনে হস্টেল করা। দাড়ি আছে। গেরুয়া পাঞ্জাবী আর খোবলানো খাবলানো জিনস্‌ পরে আসা ছেলেটিকে ওর একটুও ভাল লাগল না কেন,বাড়ি এসে এক এক করে ভাবছিল ও। অনুর কাছে যদিও একটা কথাও বলা যাবেনা, কিন্তু নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হওয়া দরকার।

কারণটা কী নিছক হিংসে? মানে অনু এতদিন ওর ঘনিষ্ঠ ছিল।এখন আরেকজন ফিল্ডে ঢুকে যাচ্ছে তাই ছেলেটাকে ও নিতে পারছে না।নাকি ছেলেটার সব মিলিয়ে নিজেকে আঁতেল দেখানোর চেষ্টাটা ওর ভাল লাগেনি?আর একটা ব্যাপারও আছে।সেটা হল ছেলেটার চাহনি। একদম সরল বা ভুলো মানুষের চোখ নয়।বরং বেশ হিসেবি বা চালাকচতুর দৃষ্টি ।কুহুকে তো রীতিমত মাপছিল ও ।তবে এসব অনুকে বলে লাভ নেই ।ও বুঝবে না। এখন তো কৃষ্ণপ্রেমে রাধা হয়ে আছে।

কুহু জুহুকে বলছিল, “আমার কপালটা দেখ। যে দুটোকে ভালবাসি সে দুটোই ভুলভাল সম্পর্কে গেল। একজন আমার দিদি,অন্যজন আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধু।”

জুহু হাঁ না কিছু বলল না।মাঝেমাঝে জুহু এরকম নিরুত্তর থাকে।কুহুর মনে হয় তখন, ও অতবেশি জটিল চিন্তা ধরতে পারছে না।আর একজন কেউ যদি থাকত বেশ হত।এসব কথা শেয়ার করা যেত।

সেই আর একজনের কথা ভাবতে গিয়ে যে মুখটা ভেসে উঠল, সেটা কুহু এমনিতে ভাবেনা।সাদা শার্ট পরা পিন্টুর দাদা।কুহুর ভাবনাতেও লজ্জার ছিটে লাগল এবার।হঠাৎ ওই ছেলেটার কথা মাথায় এলো কেন ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিল না ও।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ২৭। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *