অক্সিজেন। পর্ব ২৬। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

গত পর্বের পর

পুতুল মানুষ, মানুষ পুতুল

টুপুর জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছিল শিপ্রার, চিন্তাটা মিটেছে ।হঠাৎ করেই একটা মেল এসেছে ওর অফিস থেকে।ওদের দিল্লী ব্রাঞ্চের জন্য কিছু ছেলেকে ওরা রিক্রুট করবে। টুপু ওখানে যেতে চাইলে অফিসে দেখা করতে পারে।

টুপু একটু দ্বিধাগ্রস্থ ছিল। শিপ্রাই সাহস দিয়েছে।“তুই আগে যা, কাজ শুরু তো কর,পরে ছাড়ার চিন্তা।”অফিসে শেষঅবধি তার কথা শুনেই গেল ও। ফিরল অবশ্য খুশি হয়েই। বেশ কয়েকজন যাচ্ছে।তাদের মধ্যে ওর বন্ধুরাও আছে।অফিস থেকেই ওদের থাকার ব্যবস্থা করছে। দিল্লী বলে বাড়তি কিছু টাকাপয়সাও পাবে।অনেকদিন বাদে খুবই খুশি খুশি লাগছিল ওকে।

রিনির কথা আর জানতে চায়নি ও।যা হবার তাই হয়।ক্ষতস্থানের চামড়া ছিঁড়লে রক্তপাত অবধারিত।তার থেকে বিস্মৃতি ভাল।একটা চিন্তা অবশ্য শিপ্রার মাথা থেকে যাচ্ছেনা।এই করোনা পিরিয়ডে ছেলেটাকে যেতে দেওয়া কী ঠিক হল? হয়ত হল, হয়ত হল না।

যতীন যদিও খুব চিন্তায় ফেলছে আজকাল।গতকাল পাড়ায় বুলার বিয়ে ছিল।একে চারপাশে করোনার ভয় ,ওদের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। লোকজন তেমন বলেনি।এবাড়িতে শুধুমাত্র শিপ্রাকে বলেছে।সকাল বেলায় যতীন পাড়ার রকে গিয়ে বসে। সেদিন হঠাৎ পাঞ্জাবী পাজামা পরে নীচে নামল। জানতেও চেয়েছিল শিপ্রা “কোথায় যাচ্ছিস?”

ও অমনি অম্লানবদনে বলল ‘বিয়েবাড়ি।’

শিপ্রা সব শুনে নিয়ে একধমক দিয়ে বলেছিল, “ খবর্দার যাবি না। তোকে নেমন্তন্ন করেনি তো।”

তারপরে বাড়িতেই ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, ও বুলাদের বাড়ি গিয়ে সকাল থেকেই বসে আছে। লজ্জা না করে শিপ্রা গিয়েই হাত ধরে ফেরৎ এনেছি্ল।

বুলার মা অবশ্য বারবার বলেছে, “ছোট থেকে দেখছি।ও আমার ছেলের মত।ওকে রাতে তোমার সঙ্গে নিয়ে আসবে।”

শেষে অস্বস্তি হলেও সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিল ওকে।ভাগ্যিস গিয়েছিল।ওর হাসিমুখে নেমন্তন্ন খাওয়া শিপ্রার দীর্ঘদিন মনে থাকবে।

এদিকে সজলবাবুর  হাঁকডাক দিনদিন বাড়ছে। বৌদির সঙ্গে খুব ভাব জমিয়েছে। সারা শীতকাল বউদি ওকে দিয়ে চুনোচানা মাছ আনিয়েছে।একদিন তো বউদি নিজেই ওকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে বসল।তার রাগ হয়।কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। গানের ঘরেই ভুল করলে বকুনি দেবে ভেবেছিল ও।সুরেলা গলায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে এত চমৎকার গাইল, যে শিপ্রাই আউট হয়ে গেল।

ওই একটা ব্যাপার, খুব ভালো গায়। ভারি সুন্দর গলা। যেমন পুরুষালি ভারী আওয়াজ, তেমনি সুরেলা কন্ঠ । গায়কিতেও ভুল থাকে না। গান শেখার ব্যাপারেও ভীষণই সিরিয়াস। তবে গানই তো সব নয়। এভাবে কোন বাড়ির অন্দরে ঢোকা কিছুতেই মানতে পারা যায় না।…।

শিপ্রার সঙ্গে বউদির এনিয়ে রাগারাগিও হয়েছে।বউদি নাছোড়।বক্তব্য একেবারেই সোজাসুজি। “আমাদের ভালবেসে পুঁইশাক থেকে গলদা চিংড়ি সব নিয়ে আসছে।সবাইকার নাটকের টিকিট কেটে নাটক দেখাচ্ছে,তাকে দুটো ডালভাত খেতে বলাতেই ভারী দোষ হয়ে গেল না?আসলে আমি তো কোন মানুষ না।রান্না করার রাঁধুনি। ঠিক আছে এবার থেকে একদম বোবা হয়ে থাকব।”

বউদির কথার তোড়ে চুপ করে যেতে বাধ্য হয়েছিল ও।ফলে দিনদিন সজল বাবুর অগ্রগতি বাড়ছে।আর ও চুপচাপ দেখে যাচ্ছে।শীলাকে নিয়েও ঝামেলা লেগেই আছে। কিন্তু যতীন শীলাকে খুব পছন্দ করে ।

সেদিন শীলা ওকে বলেছে ,“যতীন বলল, তোমার মেয়েকে নিয়ে এসো। ও এলে আমরা দুজন খেলা করব।”

শিপ্রার তখনই মনে পড়েছিল ছোটবেলায় যতীনকে নিয়ে ওর খেলা করার কথা। গানের স্কুলে ছোট ছোট ভাইবোন গান শিখতে এলেও ওদের ছোটবেলার কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে কুহুর দিদি কেকার কথা।বড় ভাল গান গাইত মেয়েটা।ক্লাস নাইনে উঠে দুজনেই গান ছেড়ে দিল।

কুহুর সঙ্গে দেখা হবার দিনকয়েক বাদে কেকার সঙ্গেও দেখা হয়েছিল ওর।তবে কেকা ওকে দেখে গুটিয়ে গিয়েছিল কেমন। যে মেয়েটাকে ও ব্লাউজ করতে দেয় সেই নন্দার বাড়িতে এসেছিল কেকা।কাপড়ের ফলস বসিয়ে জমা দিয়ে পয়সা নিয়ে গেল।ঠিক সেই সময়েই বানানো ব্লাউজ নিতে গিয়েছিল শিপ্রা।ও একটিও কথা বলেনি ওর সঙ্গে।তবে ভেবেছে, এবার একদিন নন্দার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যাবে ওর কাছে।ছোট ছোট মেয়েদের কিছু গানের ট্যুশানি ওকেই ছেড়ে দেবে শিপ্রা ।এবাড়িতে এসেই শেখাবে নাহয়।তাহলে হারমোনিয়ামের সমস্যা থাকবে না।

বাড়ি,বাবা ,মা ,বোনকে ছেড়ে বড় কঠিন লড়াই লড়ছে মেয়েটা।এক স্বার্থহীন লড়াই।কাউকে কাউকে তো পাশে দাঁড়াতেই হবে।সে মানুষটা নাহয় তিনিই হলেন।

বেশ কিছুদিন হল অদ্ভুত  একটা টিউশানি শুরু হয়েছে ওর।মেয়েটার বয়স চোদ্দ বছর। একেবারে পুতুলের মত দেখতে।কিন্তু একদম কথা বলেনা।গুজরাটি ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে।ছোট থেকেই এরকম কিনা তাও জানা যায়নি।মামার বাড়ির দাদু দিদার কাছে থাকে।তারা মাইনে দেন,চা কফি স্ন্যাক্স্‌ খাওয়ান।কিন্তু বেশি কথা বলেন না। মা বাবাকে এ যাবৎ কোনদিন দেখেনি ও।

বাড়িতে মেয়েটিকে  সবরকমের ট্রেনিং দেওয়া হয়।দেরিতে হলেও প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাস করেছে।তবে সবটাই ইংরাজী মাধ্যমে।ওর প্রাইভেটের ইতিহাসের দিদিমনি শিপ্রার কাছে গান শিখতে আসে।এই গানের টিউশানিটায় সেই যোগাযোগ করিয়ে দেয় ।তার কাছেই ওর কথা কিছু কিছু জেনেছে শিপ্রা।

পড়াশুনা আর করবে না।এবার গান শিখবে।সুরে বসা গলা। শিপ্রার কোন পরিশ্রমই হচ্ছে না। তবে গিয়ে শেখাতে হয়।মাসে একহাজার টাকা দিচ্ছে।কথা না বললেও পুরো সহযোগিতা করে  শেখানোর ব্যাপারে।শিপ্রার যাতায়াত বাসে। করোনার সময় ক্লাস করতে পারেনি।ওরা ফোন করে ডাকতে, যাচ্ছে আবার।ওকে দেখে একগাল হাসল এবার!

শিপ্রার খুব কৌতুহল হয় মেয়েটার ব্যাপারে।তবে প্রকাশ করেনা ও।ওর অতীত জেনে কী বা হবে। বর্তমানে তো কোন অসুবিধা নেই।তবে ওই মেয়েটাকে দেখার পর ওর একটা উপলব্ধি হয়েছে।লোকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের কথা বলে।মানুষের জীবনের থেকে বড় আশ্চর্য কিছু আছে কী?অথচ কেউ সেসব নিয়ে অবাক হয়না।

(ক্রমশ)

সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
+ posts

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক। চন্দননগরের একটি হায়ারসেকেন্ডারি স্কুলের দীর্ঘদিনের অর্থনীতির শিক্ষিকা ছিলেন।

১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়। ২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথমে কবিতা পরে গল্প প্রকাশিত হয়। ‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তাঁর বড়দের এবং ছোটদের জন্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। ছোটোদের এবং বড়োদের জন্য তাঁর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ২৬। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *