অক্সিজেন। পর্ব ১৯। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

মনেরও মন্দিরে

বাচ্চুদের বাড়ির পর্দাটা সিন্থেটিক কাপড় কেটে হাতে বানানো।পরিবেশটা খুব সুবিধের নয় ।চারপাশে নোংরা।কুহুকে ঢুকতে দেখে এক মহিলা টুক করে ভেতরে সেঁধিয়ে গেলেন।বাচ্চুর মা কি? গলির যে বাচ্চাগুলো বাচ্চুদের বাড়ি চিনিয়েছে তারা হই হই করে কুহুর পেছন পেছন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল।কুহু পেছন ফিরে তাকাতেই আবার বেরিয়ে গেল।

একটা ময়লা লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এলো  বাচ্চু।“তুই আবার আসতে গেলি কেন?আমাকে ফোন করে  নিলে পারতিস।”

“এখানে না এলে তোকে বিশ্বরূপে দেখব কিকরে ?লুঙ্গি পরে বুড়ো দাদু মনে হচ্ছে। এখন তাহলে কী করব বল ? বেরিয়ে যাব?” কুহু মুখভার করে তাকায়।বাচ্চুর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে দেখে ফিক্‌ করে হেসে ফেলে বলে , “ঝিন্‌ঝিনি ফিরে এসেছে।একাএকা মামার বাড়ির গাঁয়ে বেড়াতে গিয়েছিল।কাউকে কোন খবর দেয়নি।এসেই যথারীতি অজয়ের পেছনে সেঁটে গিয়েছে।”

বাচ্চু এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে বলে “ওর ঝিন্‌ঝিনি নামটা পালটে অজয়া করে দিলে ভাল হয়।দাঁড়া মাকে ডাকি।”

একা একাই একটা টুলে বসেছিল কুহু।একটু পরেই সেই ভদ্রমহিলা একটা পরিষ্কার শাড়ি পরে কুহুর সামনে এসে দাঁড়ান।“তুমিই কুহু?তোমার কথা অনেক শুনেছি।”

ঘরের ভেতরে দিনের বেলাতেও  টিউব জ্বলছে।বেশ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।কুহু বলে , “আমার নামে নিন্দে করেছে খুব, তাই না?”

উনি হেসে বলেন, “না । বলেছে তোমার পাহাড়ে যাওয়ার কথা।ওরও খুব ইচ্ছে হয় । কিন্তু আমাদের তো…।বুঝতেই পারছ।”

ঠিক তখনই বাচ্চু ঠোঙা হাতে ঘরে ঢোকে আর মায়ের দিকে কট্‌কট্‌ করে তাকায়।ওর মা নিজেকে সামলে নেন।

ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “সিঙারা নিয়ে এলাম ।চা খাবি তো?”

“খাব।আমি কিন্তু বিনা দরকারে আসিনি।তোর কাজকর্মের একটা খোঁজ এনেছি। আমার সঙ্গে চল।যেতে যেতেই সবটা বুঝিয়ে দেব।”

“দাঁড়া।চা আসুক।”

“সে দাঁড়াচ্ছি।মোদ্দা কথা চাকরিটা তুই করবি কিনা বল।”

“দেখতে হবে।আমি হয়ত চাকরিতে যেতে চাইছি।চাকরিটা হয়ত আমাকে নিতে চাইছে না।”

কুহু হেসে বলে , “আবার ?তুই কি কোনদিন শুধরোবি না?”

“শুধরোতে তো চাই, সুযোগ পাচ্ছি কই?”

“আবার কথা? যাবি কিনা বল।”

“যাব। সিঙারাটা খেয়ে নিই।”

কদিন আগেই বাচ্চুর অবস্থার কথা ও জানতে পারে।তারপর থেকেই ওর মাথার মধ্যে বাচ্চুর কথা ঘুরছিল।পিন্টুর মাকে ও বলেছিল কথাটা। কেননা ওদের এবং ওদের আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই ব্যবসার মালিক।যদি কোন কাজ খালি থাকে,এবং বাচ্চু সুযোগ পায়।অদ্ভুত ভাবেই একটা ফল ফলেছে।পিন্টুর মা ওদের আজ যেতে বলেছেন।তাই ও বাচ্চুকে নিতে এসেছে।

সাইকেল নিয়ে দুজনে পিন্টুদের বাড়ির কাছাকাছি হতেই বাচ্চু অবাক হল।

“ওমা , এখানে তো আমি আগেই এসেছি। এ বাড়িতেই তো,…।”

“হ্যাঁ।এখানেই তো আমি আসি। এই ট্যুশানিটা তো তুই আমায় দিয়েছিলি।তবে তোকে আনার ব্যাপারে একটা কথা বলি,সমস্যাটা আমি পিন্টুর মার কাছে তোর নাম না করেই বলেছিলাম।তিনি আসতে বলেছেন।”

পিন্টুদের বাইরের ঘরের এমন একটা গর্জাস ব্যাপার আছে, বেশ সঙ্কোচ হয়।বাচ্চু বসেছিল একটু শিঁটিয়ে। তাতেই ও বুঝল এর আগে ছেলেটা এবাড়িতে ঢোকেনি। পিন্টুর মা ওদের একটু বসিয়ে রাখলেন। কেননা ওনার জামাইবাবুর অফিসে কাজ। তিনি না এলে কথাবার্তা হবেনা।শরবৎ মিষ্টি কাজুবাদাম সব খাওয়ার পরও তার আবির্ভাব ঘটল না। তিনি নাকি বিশেষভাবেই ব্যস্ত।তাই তার ছেলেকে পাঠিয়েছেন। ছেলে তো সর্বক্ষণ নীল জিনস্‌ আর সাদা শার্ট পরে।

আজও একই পোশাকে ঢুকল ছেলেটা। কেমন যেন অন্যমনস্ক চাহনি।কুহুর খুব হাসি পাচ্ছিল। সেই বৃষ্টির দিনে ,গল্প বলার দিনে ,একে দেখেছে তো।পিন্টুর দাদাভাই। এ আবার কী বিজনেস চালাবে? সেটা বন্ধ হয়ে যাবে  না তো? বাচ্চুর বয়স, পড়াশুনা ইত্যাদি জানার পর বাচ্চুকে সহানুভূতি সুলভ মনোভাবে একটা কথা বলল ছেলেটি। শুনে ওর বেশ ভাল লাগল।

“আপনি আপনার পড়া ছাড়বেন না।কিছু অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।কলেজ টাইম বাদ দিয়ে বাকি সময়ে যাতে আপনাকে কাজ দেওয়া হয়, সেটা আমি দেখে নিচ্ছি ।”

মাঝেমাঝে ওর মনে হয় সবকিছুই নিয়তি নির্দ্ধারিত। ছেলেটির বাবা এলে হয়ত বিষয়টা এদিকে গড়াত না।এরকম সুবিধে বাচ্চু পেত কী?

বাচ্চু বলছিল, “হ্যাঁরে ক’পয়সা দেবে জানা হল না।”

ও বলল, “শুরু দেখে মনে হচ্ছে সবই ঠিকঠাক হবে।বায়োডাটা জমা দিয়ে দেখ।”অফিসে ডাকলে পোশাক ঠিকঠাক পরে যাওয়ার কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল ও।

জুহু হঠাৎ কথা বলতে শুরু করল।“শোন কুহু,এই মানুষটাকে চিনে রাখো।এ খুব ভাল মনের মানুষ।”

“তো?আমার কী করার আছে?”

“এই তোমাদের দোষ। কী বলতে চাই না বুঝেই আলটপকা মন্তব্য কর।”

“যা যা বলতে চাও বলে ফেলো তাহলে।”

গলার আওয়াজে বিরক্তি মিশেছিল হয়ত জুহু বোবা হয়ে গেল একেবারে।কতবার সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে জুহুকে কথা বলানোর চেষ্টা করল ও।হল না।একটা কথা ও বলল না জুহু।

বাড়ি ফিরেই মন খুব খারাপ হয়ে গেল। বাবার আবার জ্বর এসেছে আর মা সেই নিয়ে  সমানে চিন্তা করে চলেছে।আসলে জ্বরের সঙ্গে অন্য অসুবিধাগুলোও আছে। এই সেদিন নার্সিংহোম থেকে ফিরেছে।বাবার করোনা হলে ওদেরও হবে যে সেটা স্বতঃসিদ্ধ।দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। বাবার যা শরীরের অবস্থা,করোনা হলে বাবাকে বাঁচানো যাবেনা।আর করোনা যে অদ্ভুতভাবেই হচ্ছে, কেন, কিভাবে হচ্ছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না,মীরা কাকীমারা তার প্রমাণ।

বাড়ি ফেরার পরেই ফোনটা এলো। পিন্টুর মা কথা বলে, ধরিয়ে দিলেন ফোনটা। সেই ছেলেটির গলা,“নমস্কার।আপনার বন্ধুর নাম্বার নেই,তাই বাধ্য হয়ে  আপনাকেই বলছি। ওনাকে কাল একবার আমাদের ধর্মতলার অফিসে বারোটা নাগাদ যেতে বলবেন। ঠিকানা আপনার অ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।ওখানেই ফাইনালি সব সেটেল হবে।বাবার সঙ্গে আমিও থাকব।”

অসম্ভব ঠান্ডা শান্ত গলা। কুহুর মনে হচ্ছিল ওই আওয়াজ ওর চেনা অনেক আগে থেকেই। কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই ও হাত পা ধুল। খেল। তারপর কোন কথা না বলেই বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল । ওর মনে হচ্ছিল কথা বললেই আওয়াজটা ভ্যানিস্‌ হয়ে যাবে।

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ১৯। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *