নায়িকার ভূমিকায়। পঞ্চম পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য
বাংলায় বিশ শতকের গোড়ায় চলচ্চিত্রের পর্দায় নায়িকার যে নির্মাণ আমরা দেখি , তার সমান্তরালে একটা বড়সড় নির্মাণ চলছিল পর্দার বাইরেও। এক’তো পর্দায় নায়িকারা আসার আগেই থেকে উপন্যাসের নায়িকারা, মঞ্চের নায়িকারা, লিথো–ক্রোমোলিথোগ্রাফের ছবির জগতের নায়িকারা বা তারও আগে পৌরাণিক নায়িকারা একটা ধারনা বুনে দিয়েছিলেন ছায়াছবির দর্শকদের মনে । চলচ্চিত্র নায়িকাদের সেই উত্তরাধিকারে কল্পনা করা হতে থাকে। আবার চলচ্চিত্রের নায়িকারা এই সব উত্তরাধিকারের বাইরে এক অন্য প্রযুক্তি নির্মিত জগতের রূপকথা মানবীও বটে। দেখা-না দেখা বাস্তবের অদ্ভুত মিলমিশ এক। তাই অন্য মাধ্যমের নায়িকাদের থেকে অন্য রকমও। ক্যামেরার “seeing is believing” স্বতঃসিদ্ধ-এর সঙ্গে বাস্তবেও যদি এমন হত’র অলৌকিক যোগসাজশ যেন এই ছায়া মানুষীরা। বই-এর নায়িকারা যে কল্পজগতের বাসিন্দা ছিলেন বা ছবির জগতে যে শুধুই রং তুলির আঁচড়ে নায়িকার চোখে মুখে দেখা যেত নানা রকম ভাবের খেলা , তারা এবার ছায়া ও মায়ায় ঘেরা পর্দার রূপকথায় । তাই পর্দার বাইরেও তাঁদের নিয়ে কথা যে হবেই তা আর আশ্চর্যের কি!
এক কথায় এইসব নিয়ে খুব জটিল এক পরিসরে বিশ শতকের গোড়ায় সিনেমার নায়িকাদের কল্প-বাস্তব অস্তিত্ব। তার সঙ্গে যুক্ত হয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে মহিলাদের সামাজিক ভূমিকা ও তার নানা দিক নিয়ে এই সময়কার সমাজের মাথাদের নানা অবস্থান–প্রতি অবস্থান। একদিকে সিনেমা (প্রচলিত নাম বায়োস্কোপ) নামক নতুন মাধ্যমের নভেলটি, অন্যদিকে সমসময়ে নারীত্বের সামাজিক-রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক নানা গণ্ডি নির্দেশ। নায়িকাদের ভূমিকাকে এইসব কিছুই করে তুলেছিল জটিলতর ।
সামাজিক দিক থেকে দেখতে গেলে এটা হয়ত ঠিক যে বিশ শতকে মহিলাদের নিয়ে কোনো বড় আন্দোলন দেখছে না বাংলার সমাজ। যে কথা আগেই আলোচিত হয়েছিল যে এই সময় জুড়ে প্রায় কোনো সংশোধন আন্দোলনই হচ্ছেনা, যেখানে মহিলাদের প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। এই কথাও এসেছিল, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গবেষকরা দেখিয়েছেন যে এই সময়কার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সমাজ ও তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে ভেঙে নেওয়া হয়েছিল অভ্যন্তরীন (inner) ও বহির্ভাগে (outer) আর নারী/নারীত্বের স্থান ছিল অভ্যন্তরীনে (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৩)। বিধবা বিবাহ বিল (১৮৫৬) অর্ধশতাদ্বীরও বেশি আগে পাস হয়ে গেছে। ব্রাহ্ম বিবাহ বিধি প্রস্তাবনা ও সেই নিয়ে তর্ক–বিতর্ক ও বিবাহ-বিচ্ছেদের ভাবনা নিয়ে সরব হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজ তাও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস(১৮৭২-১৮৮০)। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে স্ত্রী-শিক্ষা ও মোটামুটি ভাবে সর্বসম্মত। কিন্তু বিশ শতকের বাংলা জন পরিসর ও বিশেষত মুদ্রণ সংস্কৃতি তাও মহিলাদের কেন্দ্র করে নানা প্রশ্নে উত্তাল! আগের শতকের বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের বিলম্বিত প্রভাব হিসেবেও তাকে দেখা যায়, আবার কিছু নতুনত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবেও পড়া যেতে পারে এই তর্ক–বিতর্কগুলো।
এই জন পরিসরের তর্ক–বিতর্কগুলোয় একটা বড় অংশ ছিল অন্তঃপুরের (private) বাইরের জগতে (public ) মহিলাদের অবস্থান ঠিক কি হবে তা নিয়ে পুরুষদের দ্বিধা ও স্ংশয়। বাইরের জগতে বেরোনো মহিলাদের নিয়ে শহুরে পুরুষদের একদিকে এই ভয়–উদ্বেগ আবার অন্যদিকে মহিলাদের আধুনিক করার বাসনা এই দোলাচল স্থির করছিল স্ত্রী স্বাধীনতার বা স্ত্রীশিক্ষার সীমানা। একতো স্ত্রী স্বাধীনতার প্রশ্নে বহুবিধ মত উঠে আসতে থাকে। বাইরের জগতে মহিলাদের যদি আসতেই হয় তার সীমানা নির্দেশ খুব জরুরি হয়ে পড়ে। আর বাইরের জগতে যে মহিলারা নিয়মিত তাদের নিয়ে প্রহসন, নক্সা, কার্টুনের এক ঠাট্টা তামাসার পরিসর তৈরি হয়। আবার পুরুষদের যোগ্য সহধর্মিনী হয়ে উঠতে চাইলে ঘরে ও বাইরে দুই-এ মহিলাদের উপস্থিতি সময়ের দাবী এরকম মতও শোনা যায়। ভারতী রায়ের মত গবেষকরা বলছেন, ১৯২০এর দশকের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও বিশেষত মহাত্মা গান্ধী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত ভারতব্যাপী গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন অনেক মহিলাদের বহির্জগতে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়।
স্ত্রীশিক্ষায় অনেকেরই মত ছিল। কিন্তু প্রশ্নটা ছিল কতটা পড়বে মেয়েরা আর সেই শিক্ষা কিভাবে আলাদা হবে পুরুষদের শিক্ষার চেয়ে। বিবাহ এবং সাংসারিক নির্মাণের প্রশ্নেও সরব ছিল মুদ্রন সংস্কৃতি। ১৯২০-৩০ এর দশকে নিয়মিত বেরনো পত্র–পত্রিকা গুলি তো বটেই, ‘জয়শ্রী’, ‘মন্দিরা’ বা ‘সওগতে’র মত মহিলাদের পত্রিকায় লেখিকা ও পাঠকেরা নানা মত নিয়ে আসতে থাকে জন পরিসরে। দাম্পত্য জীবনে মহিলারা কি তাদের স্বামীকে পেতে পারেন না সঙ্গী বা সহচর রূপে এই প্রশ্নও তোলেন লেখিকারা । নব্য শিক্ষিত এই মহিলাদের নিয়ে যুগপৎ ভয় ও উদ্বেগ এবং কামনা ও ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখে পুরুষেরা । আর সেই দেখার চোখ খানিক ধার করে নিয়ে বদলাতে থাকে সাহিত্য কল্পনাও ।
মহিলাদের অবস্থান নিয়ে যখন সমাজ এরকম দ্বিধায় এই সময়ে মেয়েদের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রেখে গড়ে উঠতে থাকে এক নতুন রকমের বাংলা উপন্যাস – ছোট গল্পের জগৎ । সেখানেও নায়িকার নতুন ভূমিকা দেখা যায় । বঙ্কিমে চন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র কুন্দনন্দিনী বা রোহিণীর পর বিংশ শতকের শুরুতে পাঠক পড়ছেন (ও হয়ত মনশ্চক্ষে দেখছেনও) রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী বা ‘গোরা’র সুচরিতার কথা । তার পাশাপাশি শহরে থিয়েটারের বিস্তার নিয়ে আসছে নটীদের জনপ্রিয়তা। কলকাতা বাজার আর্ট বলে পরিচিত ছবির জগৎ আবার নিয়ে এসেছিল শকুন্তলা, দময়ন্তীর মত পৌরাণিক নায়িকাদেরও। তাঁদের ঘিরেও গড়ে উঠছিল নায়িকার কল্পনা। এর পাশাপাশিই নতুন মাধ্যম চলচ্চিত্র নিয়ে এল নায়িকাদের !
নভেল বা নাটকের সঙ্গে সিনেমার নায়িকাদের যোগ টা শুধু সময়ের ব্র্যাকেট বলেই নয়! আমরা জানি যে একটা বড় সংখ্যক চলচ্চিত্র হত সাহিত্য নির্ভর বা নির্মিত হত পৌরাণিক গল্পের অবলম্বনে । এবং চলচ্চিত্রের পর্দায় সেই ছবি মুক্তি পেলে তা নিয়ে জন পরিসরে বসত আলোচনা, বিশ্লেষণের আসর। শ্বেতাঙ্গ ইংরাজি ভাষী অভিনেত্রীরা যখন জন-মানসে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলেন আদর্শ হিন্দু পৌরাণিক নায়িকা হিসেবে, তখনই গণ মাধ্যমে লেখা বেরোতে শুরু করল আদর্শ নায়িকা কেমন হবে তাই নিয়ে । তাই এই সময় শুধু পর্দায় বিভিন্ন চরিত্রাভিনয়ই নয়, চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে যে গণ মাধ্যমের বিভিন্ন বিভাগ সেখানেও নায়িকাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগে ছায়াছবির জগৎ নিয়ে এই লেখালেখিগুলোতে অভিনেত্রীদের নিয়ে একই সঙ্গে প্রচুর কৌতূহল , প্রস্তাবনা ও উচিত-অনুচিতের নির্দেশনামা । পর্দার বাইরের শব্দের এই জগতে নায়িকার কল্পনা ও নির্মাণ চলতে থাকে দর্শক ও পাঠক সমাজে। আর চলচ্চিত্র মাধ্যমের নব্যতার সঙ্গে জুড়ে যায় লিঙ্গ রাজনীতির নানা মাত্রা। সেসব নিয়েই চলে পর্দা ও পর্দার বাইরের নায়িকা কল্পনা।
তথ্যসূত্রঃ
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দ্য নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্র্যাগমেন্টসঃ কলোনিয়াল অ্যান্ড পোস্ট কলোনিয়াল হিস্টরিস, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৩।
ভারতী রায় , “উইমেন ইন ক্যালকাটাঃ দ্য ইয়ার্স অফ চেঞ্জ”, সুকান্ত চৌধুরী সম্পাদিত ক্যালকাটাঃ দ্য লিভিং সিটি (২য় ভাগ), অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫।
স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।