বিষাদ বৃক্ষ, মিহির সেনগুপ্ত এবং…। রাণা আলম। মিহির সেনগুপ্ত-স্মরণে ‘সিদ্ধিগঞ্জের ভাটিকুমার’।
“শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?”
-শঙ্খ ঘোষ
সময়টা ১৯৭০। দেশ ছেড়ে ভারতের সীমান্তের দিকে পালাচ্ছেন এক হিন্দু পরিবার। গোটা গ্রামে ঘাতক মুসলমান বাহিনী হিন্দুদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই রাতে তারা লুকিয়ে ছিলেন প্রতিবেশী এক মুসলিম বাড়িতে। তার বাড়িও খোঁজা হবে সেই আশংকাতে হিন্দু পরিবার টিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে খড়ের গাদার অন্ধকারে। হানাদার বাহিনী কড়া নেড়েছে আশ্রয়দাতার বাড়িতে।পরিবারের কর্তাকে উঠোনে ফেলে পেটানো হচ্ছে যাতে হিন্দু পরিবারটি কোন দিকে গেছে তা তিনি বলে দেন। ঠিক এইসময়ই খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকা হিন্দু পরিবারটির সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য কয়েকমাসের বাচ্চাটি কেঁদে উঠলো। আতঙ্কে এক সদস্য তার মুখ চেপে ধরলেন।
হানাদার বাহিনী চলে যাওয়ার পরেও তারা আতঙ্কে স্তদ্ধ হয়েছিলেন যদি হানাদার রা আবার ফেরত আসে সেই ভয়ে। ভোর রাতে যখন তারা আশ্রয়দাতার বাড়ি ছেড়ে রওনা দেবেন তখন বোঝা গেল মুখ চেপে রাখা বাচ্চাটা মারা গেছে। চিৎকার করে তারা কাঁদতে অব্দি পারেননি। মরা সন্তান বুকে নিয়ে মা হাঁটা দিয়েছেন সীমান্তের দিকে।
আর বাড়ির উঠোনে তখন গৃহকর্তা মুসলিম মানুষটির মৃতদেহ পড়েছিল। কাফের দের আশ্রয়দাতা হবার অপরাধে হানাদার রা তাকেও কুপিয়ে খুন করে গিয়েছিল।
সেই পালিয়ে আসা পরিবারের এক সদস্যের কাছে এই ঘটনা শুনছি তার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর। সেদিনের কিশোর আজ ষাট ছুঁইছুঁই মানুষ। যেটা অবাক করেছিল সেটা হল তাদের আখ্যানে ঘৃণার অনুপস্থিতি। যারা আক্রমণ করতে এসেছিলেন তারা বহিরাগত মুসলমান। আর তাদের গ্রামের স্বল্পসংখ্যক মানুষ যারা তাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন তারাও মুসলমান। স্বভাবতই আক্রমণকারীদের সংখ্যাই বেশি ভারি ছিল।এই সংখ্যার বৈপীরত্য সত্ত্বেও তারা ওইকজন মুসলমানকে নিজেদের স্বজন মেনেছেন। তাদের ফেলে আসা ঘর-উঠোনের বুনোটের মধ্যে তাদের সাথে কাটানো সুখ-স্মৃতিগুলোও সমানভাবে থেকে গেছে।
দেশভাগ আমাদের কাছে এক অভিশাপের মত। এবং দেশভাগের ফলে বাংলা এবং পাঞ্জাব, এই দুটি রাজ্যের মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাই তাদের সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশভাগের স্মৃতির ছাপ রয়েছে। ১৯৪৭ সালে মাটির উপরে দাগ কেটে যেভাবে রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করেছিলেন তার দাম অগণিত সাধারণ মানুষ এখনও চুকিয়ে যাচ্ছে।
যারা ভিটে মাটি হারিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের আখ্যান আমাদের এক আয়নার সামনে দাঁড় করায়। পার্টিশন স্টাডিজ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা দেশভাগ সংক্রান্ত স্মৃতিকথাকে মূলত দুটোভাগে ভাগ করেন। যারা দেশভাগের ফলে আর্থিকভাবে পথে বসেন নি, সম্পত্তি হস্তান্তরই হোক বা এপার বাংলায় আগাম করে রাখা কোন আর্থিক সঙ্গতিই হোক, তাদের স্মৃতিকথায় নস্টালজিয়ার অংশ বেশি থাকে। আর যারা সব হারিয়ে এক বস্ত্রে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের আত্মচরিতে নস্টালজিয়া কম, লড়াই এর কথা বেশি।
মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’ যখন পড়ি, তখন তার সাথে স্বাভাবিকভাবেই তপন রায়চৌধুরীর ‘বাঙালনামা’র তুলনা চলে আসে। ‘বাঙালনামা’ তার বহর এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক বেশি জাতীয় রাজনীতি আর তার চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ।তার গুরুত্বও আলাদা। সে তুলনায় ‘বিষাদবৃক্ষ’-এ আমরা মানুষের কথা পড়ি। দেশভাগের প্রভাব শুধুমাত্র হিন্দু বাঙালির উপরেই পড়েনি। মিহির সেনগুপ্ত তার লেখাতে নিম্নবর্গীয় মানুষজনের জীবনযাপন, তাদের যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নির্মোহভাবে।
এক্ষেত্রে ‘নির্মোহ’ শব্দটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যারা দেশভাগের শিকার, তাদের আত্মকথায় পক্ষভিত্তিক অবস্থান থাকবে, সেটা খুব স্বাভাবিক। আজ কুড়ি বছর আগে শেয়ালদা স্টেশনে যে বয়স্কা ভিখারিণী ভদ্রমহিলা এক রাতে তার ঘর-উঠোন-বারান্দা ফেলে আসার ঘটনা শোনাতেন, তার কথনে সেখানকার সংখ্যাগুরু মুসলিমদের বিরুদ্ধাচারণ থাকবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এইখানেই মিহির সেনগুপ্ত অনেকের থাকা আলাদা। তার আত্মকথনে ঘৃণা নেই। বরং, হিন্দু-মুসলমান এর সহজ যৌথযাপনের কথা আছে। ঠিক এই কথাই পরবর্তীকালে আখতারজ্জুমান ইলিয়াসের সাথে তার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় শুনবো আমরা।
বাল্যকালে দাদী আম্মার বাড়িতে খিদের মুখে ফ্যানভাত খেয়ে মিহির সেনগুপ্ত লিখছেন,
“ বড় বাহারের নাস্তা বানিয়েছিলেন তিনি সেদিন। পায়েলইয়া মরিচ ঘুষা চিংড়ি আর নারকোল একসাথে বেটে তার বড়া আর আউশের ফ্যানাভাত। সে স্বাদ বোধহয় মরার আগের দিন অব্দি থাকবে। আমরা পাঁচজনে পাশাপাশি বসে হাপুস হুপুস করে খেলাম। কিন্তু জাইত যে কোনহান দিয়া গেল টের পাইলাম না।“
কত সহজে আমাদের যাবতীয় সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন লেখক। সত্যিই তো আমাদের জাত জিনিস টা ঠিক কীরকমভাবে যায়? আর খিদের থেকে বড় জাত আর নেই এটাও ভেদাভেদজ্ঞানে দীর্ণ বাঙালি আজ অব্দি বুঝে উঠতে পারলো না।
বিষাদবৃক্ষে চোখের সামনে সবকিছু শেষ হতে দেখার যন্ত্রণা রয়েছে। রয়েছে অদ্ভুত এক শূন্যতা।যে শূন্যতার একাধিক স্তর রয়েছে। মিহির সেনগুপ্ত এই শেষ হবার পিছনে কার্যকারণ খুঁজেছেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর সামাজিক পালা পরিবর্তনের যোগসূত্র বোঝার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কখনই ‘জাজমেন্টাল’ হবার জায়গায় যাননি। বরং, আমরা তাকে ধরতে পারি এক আপাত নিস্পৃহ বর্ণনাকারী, যিনি তার অভিজ্ঞতার প্রত্যেকটি পাতা নিঁখুতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন অপকপটভাবে। পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন সেই অভিজ্ঞতা বিচার করার ভার।
আমরা বিষাদবৃক্ষের প্রতিটি পাতায় এই সামাজিক পালাবদলের দিনিলিপিকে ধরতে পারি। মিহির সেঙ্গুপ্তের আকৈশোর সঙ্গী দাদী আম্মার দুই নাতি নাতনি স্বাধীন বাংলাদেশে রক্ষণশীল ইসলামিক ধর্মাচরণ করেন। লেখক তার ছোটোবেলার আশ্রয় দাদী আম্মার ধর্মীয় ঔদার্যের সাথে তার নাতি নাতনির বর্তমান অবস্থা মেলাতে পারেন না। কট্টর ইসলামিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাত্তরের রক্তস্নাত যুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের জন্ম তার মাটিতে কট্টরপন্থীদের দাপাদাপির আভাস পাই আমরা। নিম্ন আর্থিকবর্গের মুসলমানদের লোকায়ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কমতে থাকে। পাকিস্তানের কর্তাদের হাত ধরেই দেশে মোল্লাতন্ত্রের শেকড় তখন শক্ত হচ্ছিল।
মিহির সেনগুপ্ত তার কথনে প্রান্তিক নিম্নবর্গীয় মানুষজনের জীবন-যাপন তুলে ধরেছেন খুব নিঁখুতভাবে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাদের লৌকিক আচার, ধর্ম-যাপন এত পরিষ্কার ছবি আর আগে বাংলার কোনো দেশভাগ জনিত আত্মকথনে বিরল। এবং যে কারণে বিষাদবৃক্ষ পার্টিশন লিটারেচার এর মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের দাবী রাখে তা হল দেশভাগে ফলে নিম্ন আর্থিক বর্গের মানুষদের দুর্দশার বর্ণণা। যারা দেশভাগের পর এপার বাংলায় আসতে পারলেন না। শুধুমাত্র পুরুষানুক্রমিক পেশা বা জমির রোজগারের উপর ভিত্তি করে বেঁচেছিলেন তাদের অবস্থা দুঃসহ হয়ে ওঠে। গ্রামের ডাক্তারজেঠু, যিনি একসময় স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালিয়েছেন তিনি পাশের মুসলমান গ্রাম থেকে ভিক্ষে করে ফিরছেন। ঢোকার মুখে কিশোর মিহির সেনগুপ্তের সাথে দেখা। ধরা পড়ে ম্লানমুখে তিনি বলছেন,
“ প্যাডে অনন্ত খিদা, বোজলা? মনে অয় এই ব্রেম্ভান্ডডারে যদি একপাশ দিয়া কামড়াইয়া খাইতে শুরু করি, তয় হয়ত খ্যানেক তৃপ্তি পামু”।
এই প্রত্যেকটি শব্দ আমাদের আঘাত হানে। যে স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে এত আয়োজন, সেই অতি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ফল প্রান্তিক নিম্নবর্গীয় মানুষজনেদের কাছে কতটা পৌঁছেছিল তা নিয়ে মিহির সেনগুপ্ত প্রশ্ন তুলেছেন বারবার। তাদের বাড়ির রাখাল নাগর আলি বলছে,
“বালের আজাদি। প্যাডে নাই ভাত, ল্যাঙ্গে নাই কাপড়, মোরা স্বাদিন দ্যাশের নাগর”।
অকপটতা বিষাদবৃক্ষ বইটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে থাকা প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতা আর নিম্নবর্ণের প্রতি বিদ্বেষের কথা আমরা পড়ি সেখানে। এমনকি সেসময় তার নিজের ভিতরে থাকা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার কথাও তিনি নির্মোহভাবে লিখে গেছেন।
তিনি লিখেছেন যে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানে যেরকম মেশামেশি হয়েছে তার তুল্য দৃষ্টান্ত ভারতের অন্যত্র পাওয়া মুশকিল। আমাদের জারিগান, বিভিন্ন পল্লীগীতিকা তারই প্রমাণ। এবং এই মেলামেশা যারা আটকাতে চাইছে তাদের উদ্দেশ্য কোনোকালেই সাধু নয়।
এইমুহূর্তে দাঁড়িয়ে, ২০২২-এর ভারতবর্ষে আমাদের বুঝতে হবে যে মিহির সেনগুপ্তকে আমাদের আবার নিবিড়ভাবে পড়া ঠিক কীসের জন্য দরকার। আমাদের দেশভাগের স্মৃতিকে উসকে দিয়ে আবার দ্বেষের রাজনীতির চাষ চলছে পুরোদমে। পঞ্চাশের পূর্ব-পাকিস্তানের মতই পোশাক আর ধর্ম পরিচয় দেখে ‘কাফের’ খোঁজার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে গত দুই দশকে। বিভাজনের খেলায় প্রান্তিক মানুষ আরও রিক্ত হচ্ছেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তাদের স্বাছন্দ্য হারাচ্ছে। সবকিছু ঢেকে যাচ্ছে ধর্ম-রাজনীতির কুটিল চালে।
মিহির সেনগুপ্ত এর প্রয়াণের পরেও বাঙালি হয়ত বুঝলো না যে তারা ঠিক কাকে হারালেন। আমাদের একজন মিহির সেনগুপ্ত ছিলেন। যার স্বপ্নে মিশে যেত স্নেহময়ী দাদী আম্মার কবর আর ফেলে আসা বসত-বাটিতে ফেরার ইচ্ছে।
আমরা বাঙালিরা, হয়ত কখনই বুঝবো না যে এই ধর্মের বিভাজনের রাজনীতি আদতে আমাদের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলার চক্রান্ত মাত্র। এবং মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ সেই শেকড়ে ফিরতে চাওয়ার নিরন্তর আখ্যান , যে আখ্যান এখনও সীমান্তের কাঁটাতারের দুইপারের অগণিত মানুষ তাদের বুকের মধ্যে পুষে রেখেছেন।
‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইতে আমাদের, দুইপারের বাঙালিদের একজন মিহির সেনগুপ্ত ছিলেন’। আফশোস এইটাই যে, তিনি চলে যাওয়ার পরেও তা আমরা বুঝতে পারিনি।
“হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাদের লৌকিক আচার, ধর্ম-যাপন এত পরিষ্কার ছবি আর আগে বাংলার কোনো দেশভাগ জনিত আত্মকথনে বিরল। ” এটাই হচ্ছে পরিষ্কার কথা. বাংলার গুণী পাঠক কী লেখক কেউ কিন্তু মিহির সেনগুপ্ত কে এখনো চেনার চেষ্টা নিচ্ছেন না। এটাই দুঃখের।
বিষাদবৃক্ষের অনন্য চমৎকারিত্বের কিছু কথা তুলে ধরায় লেখককে ধন্যবাদ।