মিহির সেনগুপ্ত – এক নিরন্তর প্রব্রজনা। ভাস্কর দাস। মিহির সেনগুপ্ত-স্মরণে ‘সিদ্ধিগঞ্জের ভাটিকুমার’।
জীবনের উদয় আর অবসানের মধ্যে প্রথাগত গার্হস্থ্য ও ব্যতিক্রমী সারস্বত সাধনার সমাপনে মিহির সেনগুপ্ত নামের গল্পটি শেষ হয়েছে। স্বাধীন ভারতের সমবয়সী মানুষটি দেশটার মতই যুগপৎ অস্থিরতা ও স্বস্তি, অর্জন ও অপ্রাপ্তি, স্বীকৃতি ও উপেক্ষার অবসানে আমাদের জীবনে তাঁর ইন্দ্রিয়গোচর অস্তিত্বের ইতি টেনে চলে গেলেন গত ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে। এই সময়ের পরিসীমায় তাঁর কাছ থেকে পাওয়া সৃষ্টিকর্মের ভর নির্ধারণ যতটা হয়েছে, এখন হয়ত তার থেকে আরও বেশি হবে। সে প্রক্রিয়ায় আমি একেবারে জল-অচল মানুষ। তাই আমি বরং এই সুযোগে তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের আদলটির আভাস দিয়ে তাঁর স্মরণের কাজটি শুরু করি।
পেশার প্রয়োজনে সপ্তাহে পাঁচদিন বিকেলে চেম্বারে বসতে হয়। শুরুর আগে রোগীদের নামের কাগজটি দেখে নেওয়ার কাজটা করে নেওয়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তালিকায় থাকা শিশু আর বয়স্কদের কিছুটা অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্তটি রিশেপশনের কর্মীর বদলে আমি নিলে বাকিদের মধ্যে বিক্ষোভের প্রকাশ কিছুটা সংযত হয়, ফলে শান্তি বজায় থাকে। ২০২০র জানুয়ারির এক বিকেলে তাতে একটা নামে চোখ আটকাল। বিষাদবৃক্ষের লেখকের নামটা জানা ছিল, জানা ছিল তাঁর নিবাসটি আমার বাড়ির থেকে বেশি দূরে না। মিহির সেনগুপ্ত নামটি দেখে সংশয় হল, উনি নাকি? আশঙ্কা (অসুস্থ বলেই না আসা!) এবং আশাকে সত্যি করে যে মানুষটি ঢুকলেন তাকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় নি। কেবল তাঁর মুখে তখন তাঁর পরিচিতির স্বীকৃতিতে লজ্জিত হাসি, যেন এটি তাঁর প্রাপ্যের অতিরিক্ত কিছু। পরে দেখেছি আনিসুজ্জামান, তপন রায়চৌধুরি, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত প্রমুখ মহীরুহের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে চলা মানুষটি সর্বত্রই নিজেকে অকিঞ্চিতকর প্রমাণে ব্যস্ত, যদিও অন্যদের অভিবাদনে নিজের স্বরূপটি তিনি গোপন করতে পারেন নি। ভাগ্যিস! তাঁর চিকিৎসায় কিঞ্চিত সাফল্য হয়ত এসেছিল আমার। দিন দশেক পরই তাঁর দ্বিতীয় আবির্ভাব। হাতে তাঁর লেখা চার পাঁচটি বই। তার একটি বই ‘কাহ্ন বাসুদেব’-এর প্রথম পাতায় আমার উদ্দেশ্যে লেখা ‘সুলেখক এবং মূল্যবান তথ্যজ্ঞ সদ্য পরিচিত অনেক কালের স্বজন ডাঃ ভাস্কর দাস অনুজ প্রতীমেষু, – মিহির সেনগুপ্ত। ২১/১/২০’। আপ্লুত শব্দটা সম্ভবত সেই প্রথম আমাকে তার সর্বশক্তি দিয়ে আচ্ছন্ন করেছিল। প্রথম দুটি বিশেষণে মিহিরদার মুল্যায়নে ভুল থেকে গেলেও আমাকে সদ্য পরিচিত অনেক কালের স্বজন ঘোষণায় কোন ভুল হয় নি তাঁর। সেই প্রথম দিনেই মনে হয়েছিল দাদার সঙ্গে দেখা হল। ওনারও হয়ত তাই। সেই সুবাদে আমার নামের গা থেকে ডাক্তার আর দাসের বাহুল্য খসে গিয়ে অচিরেই আমি হয়ে ঊঠলাম শ্রেফ ভাস্কর। আর উনি মিহিরদা।
সময়ের মাপে দীর্ঘদিনের বিনিময়, এমনটা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু অসুখের চর্চা আর তা থেকে মুক্তির নিদান – ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্ক এই বৃত্তের বাইরে বে্রিয়ে যখন গল্প গান আলোচনার সুখের উঠোনে পদচারণায় মেতে ওঠে, তখন সে বিনিময়ে অন্য মাত্রা যোগ হয়ে গেছে বলে নিশ্চিত হতে পারি। তার দাবীতেই একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম। মনে পড়ে আমাদের গানের অনুষ্ঠান ছিল এক স্থানীয় সভাঘরে। আমারও একটি কি দুটি গান গাওয়ার আছে। দাদাকে আসার অনুরোধ করেছিলাম, তা রাখতে আমার গাড়ি পাঠানোর প্রস্তাব সবলে নাকচ করে দীর্ঘ রাস্তা টোটোয় চেপে এসে গান শুনে গেলেন। ঠাট্টা করে বলেছিলাম, জেদ করে টোটো চেপে এলে, কোমরের ব্যাথা বাড়লে আমাকেই তো চিকিচ্ছে করতে হবে, ভিজিটও তো দেবে না! বলা বাহুল্য ততদিনে আপনি-র দূরত্ব ঘুচে গেছে। উত্তরে মিহিরদার সকৌতুকে বলেছিলেন, ভিজিট দেব কি? নেব তো! বাড়ি গিয়ে ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’ গানটা আবার শুনিয়ে আসবে। স্টেজে সেদিন ওই গানটাই গেয়েছিলাম। পরে মিহিরদার বাড়ি গিয়ে ওঁর গলায় ‘ভাঙা দেউলে মোর কে আইলে আলো হাতে’ – অতুলপ্রসাদের এই গানটি শুনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এ মানুষের সামনে গান গাইতে মুখ খোলার মারত্মক ভুলটা কখনও করব না।
একতলার ঘরে বসার ব্যবস্থার মধ্যস্থিত টেবিলের ওপর কটি বই সবসময়েই থাকত। অন্যগুলো পাল্টে গেলেও, একটি বই উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমহীন। সেটি রাজশেখর বসুর মহাভারত। বস্তুত, তাঁর সৃষ্টির বড় অংশ জুড়ে মহাভারতের উপস্থিতি। কখনও প্রত্যক্ষভাবে সেখান থেকে তুলে আনা চরিত্র নিয়ে লেখায়। আর অন্যত্র সেই মহাকাব্যের নির্যাসলব্ধ প্রজ্ঞার প্রয়োগে। তবে এ নির্যাসের আত্তীকরণে অন্যনতা ছিল মিহিরদার স্বভাবজ। তাই কাহ্ন বাসুদেবের কৃষ্ণ প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা ‘আমি কৃষ্ণ বিষয়ে যতটুকু তথ্যের আভাস পেয়েছি, তাতে তাঁকে একজন ব্যক্তিকল্পে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে গ্রহণ করতে পারিনি।’ আর সে চরিত্রের বিন্যাসবিচার তাঁকে লিখিয়েছে ‘বাল্য, কৈশোর থেকে প্রয়াণ অবধি একটানা কৃষ্ণ-কাহিনির বিন্যাস মহাভারতকার করেননি। ফলে মহাভারতের কৃষ্ণ আর ব্রজের কৃষ্ণ দ্বিবিধ মাত্রায় গতি পেয়েছে।…গোকুলে যিনি ‘কাহ্ন’ কুরুক্ষেত্রে তাঁকেই কৃষ্ণ রূপে গ্রহণ করা আর প্রচার করা একটু যেন গায়ের জোরের ব্যাপার হয়ে যায়।’ এই আবহে কৃষ্ণ চরিত্র অবলম্বনে তাঁর ভাষায় ‘কল্পন্যাস’ একটি নতুন দিশা দেখায়। অভ্যস্ত চিন্তার বাইরে বেরিয়ে মহাকাব্যের চরিত্র বা ঘটনাবলীর নবতর সংস্করণের প্রকাশ মিহির সেনগুপ্তকে সকলের মাঝে বিশিষ্ট করে রাখে।
মিহিরদার বাড়ির আড্ডায় চায়ের সঙ্গে যে ‘টা’-এর উপস্থিতি, তাতেও একটু বিশিষ্টতার ছাপ থাকত। বিস্কুটের সঙ্গে সাহেবি ধাঁচে পেস্ট্রি বা পুডিং-এর টুকরো, আবার তার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ শুকনো ফল, যেমন কিসমিস, আখরোট, কাজুবাদাম, খেজুর – এসবের অবাধ প্রবাহ থাকত। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম আরবি রুচির দখলদারি তোমার মধ্যে এল কেমন করে? খুব জোরে হেসে বলেছিলেন ‘হেইডা কি কইলা? গা ঘষাঘষি কি শুধু সাহেবদের সঙ্গেই হয়েছে? তার আগের পাঁচশো বছরের ইতিহাস কি ভুলে যাচ্ছ?’
ভুলে যাওয়া নয়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটির স্মরণ, আপাততুচ্ছ ঘটনার মানসিক প্রতিঘাতের অভিজ্ঞানের নির্ভুল বিবরণ তাঁর সাহিত্যকর্মের আর একটি খুঁটি। তাঁর জালালি উপন্যাসের শুরুতেই পাচ্ছি তার স্বীকারোক্তি। ‘স্মৃতিচর্চার আলেখ্য নির্মাণ, আমার বড়ো প্রিয় বিষয়। তা এমনই একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, লেখালেখির অন্য কোনো শাখায়, আকাঙ্ক্ষা হলেও ঢুকতে পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি, খানিকটা এগোবার পর, কলমটা যেন নিজস্ব স্বাধীনতায়ই স্মৃতিচারণের পথ ধরে।‘
এই ভূমিকায় তাঁর সফলতা কিন্তু ঈর্ষা করার মত। বস্তুত, বিশ্বসাহিত্যে স্মৃতি আলেখ্য একটা বিশিষ্ট জঁ’র-এর স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর ‘মহামাতৃকার জনপদ’ গ্রন্থের প্রকাশকের নিবেদনে দেবজ্যোতি দত্ত বলছেন ‘সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের প্রচলিত ধারার গল্প উপন্যাস ইত্যাদির ব্যতিরেকী যে সাহিত্য বাস্তব বিষয়বস্তু নির্ভর করে রচিত হয়ে চলেছে, বংলা সাহিত্য সংসারে তার অধুনাকার অবস্থান নিতান্ত নগণ্য নয়। বস্তুত সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই এই ধারাটি ভিন্ন ধরনের মৌলিকতার সৃজনশীলতা দাবি করে।’ সেই মৌলিক সৃজনশীলতার বিস্ফোরণই তো তাঁর বিষাদবৃক্ষ! দেশভাগ স্বাধীনতাকামী বাংলার জীবনে বৃহত্তম দুর্ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম বাংলায় আসা হিন্দু বাঙালির স্রোতের সংগ্রাম ও পরিণতি এ পর্বের অনেক গল্প উপন্যাস চলচ্চিত্রের বিষয়। বিষয় বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হওয়া মুসলমান সমাজও। কিতু দেশভাগের মূল সুরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা, যেমন সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া হিন্দু বাঙালি, যেমন মিহির সেনগুপ্ত নামের এক কিশোর ও যুবক, তার পরিবারের বিপন্ন দিনযাপনের ব্রতকথার আখ্যান আমরা পেলাম তাঁর বিষাদবৃক্ষের ছায়ায়। ৪৭-র ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া মানুষটি ওই দেশেই তাঁর ইস্কুল আর কলেজ জীবনের অনেকটা কাটান বরিশালে। ১৯৬১তে জাতীয় বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছুদিন ব্রজমোহন দত্ত কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। তারপর সেখানকার পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই ১৯৬৩তে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান। ওপারের পড়াশোনা স্বীকৃতি পায় নি এপারে। তাই ইস্কুল পর্যায় থেকেই আবার পড়াশোনা শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক হয়ে প্রথাগত পড়াশোনায় ইতি টানেন। তবে আসল পড়াশোনা যেন তারপর থেকেই শুরু হয়। ব্যাঙ্কের চাকরির ফাঁকে পড়ার নেশায় এক সময় হাতে আসে তপন রায়চৌধুরির ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর আত্মচরিত’। আর এই বই তাঁর লেখকসত্তার আগল খুলে দেয়। ছেচল্লিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম লেখা ‘ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি’ – লেখাটি সমাদৃত হয়। পরের লেখা ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ ২০০২ সালে বাংলাদেশের শ্রুতি আকাদেমী পুরস্কার পায়। এই বই ও ‘বিষাদবৃক্ষ’, যা ২০০৫এর আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত, এগুলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবঅল্টার্ন হিস্ট্রির পাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বিষয়টি শ্লাঘাউদ্রেককারি। কিন্তু নিজের পিঠ চাপড়ানোর থেকে শতহস্ত দূরে থাকা মানুষটি লেখেন, কে জানে হয়ত বিশ্বাসও করেন ‘আমার সুকৃতি এই যে, প্রকৃতিগতভাবে আমার মধ্যে কালিদাসীয় ভাষায় বললে বলতে হয়, একটা ‘অশিক্ষিত পটুত্ব’ আছে। বিন্দুমাত্র সারস্বত পুঁজি ব্যতিরেকেই আমি এমন মহান পন্ডিত মানুষদের স্নেহ আকর্ষণ করতে পারতাম যে সমমনস্ক বন্ধু-বান্ধবদের পর্যন্ত মনে হত যে আমি একটা বিরাট পড়াশোনা করা লোক।’ ( ‘হরপ্পা’, আনিসুজ্জামান স্মরণ ই-পুস্তিকায় ‘একজন ঐহিক তীর্থংকর যেমন দেখেছি, পৃ ২৯) বিবৃতিটিকে বারবার ভুল প্রমাণ করে এরপরে ‘ধানসিদ্ধির পরনকথা’, ‘গোধূলি সন্ধির রাখাল’, ‘চক্ষুষ্মতী গান্ধারী’, ‘কাহ্ন বাসুদেব’ ইত্যাদির পাতায় পাতায় গভীর অধ্যয়ন ও জীবনবোধের পরিচয় রেখে গিয়েছেন মিহিরদা।
নিবন্ধের শুরুতে যে ব্যাতিক্রমী সারস্বত সাধনার কথা লিখেছিলাম, তার উজ্জ্বল উদাহরণ ‘বিষাদবৃক্ষ’। দেশভাগের পর এক ঘোষিত ইসলামি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বিধাগ্রস্ত চলন, একসময়ের শিক্ষিত সুস্থির পরিবারগুলির সর্বার্থে অধঃপতন, সেই সমীকরণের গন্ডি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা এক নতুন অর্বাচীন শ্রেণীর সঙ্গে বিনিময়ের সূত্রে তৈরি হওয়া এক অন্যরকম সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্পর্ক – তাকে উপজীব্য করে যে বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা ইতিহাসের কোলে স্থান পাবার দাবি রাখে। ‘যারা পঞ্চাশের ছিন্নমূল কাফেলা, তাঁদের জীবনভর দুঃখ সংগ্রাম, হারিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নিয়ে নির্মাণ হয়েছে কত লেখা, ছবি, ছায়াছবি। আজও উপমহাদেশ জুড়ে বন্ধ হয়নি তার হাহাকারি চর্চা, রোমন্থন। কেউ সামগ্রিকতায়, কেউ ব্যক্তিক খন্ডিত গন্ডিতে অব্যহত রেখে চলেছেন সেই দুঃস্বপ্নের ব্রতকথা।‘
‘এই বিষণ্ণ ব্রতকথা যদিও ব্যক্তিক উত্থান পতনের কথায় অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু এই বিষাদ বৃক্ষ এবং বিষাদিনী নদীর সন্তানেরা সবাই তার অংশী।’ অংশী তো তিনি ছিলেন নিজেই। নচেৎ অমন হ্রদয় নিংড়ানো কথার বুনোটে সে দলিলের প্রামাণ্য নক্সিকাঁথাটি তিনি রচনা করলেন কি করে! তবে স্মরণেই কর্তব্যের শেষ নয় বোধহয়। তাই তাঁর মনে হয়েছিল ‘হয়ত একদিন আমাদের এই জনপদের কারুর কোন উত্তর পুরুষ, কোনদিন এই মহাবৃক্ষের যে শিকড়ে নৌকার কাছিগুলো বাঁধা ছিল, তার সন্ধান পাবার জন্য, আকূল হয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পৌঁছবে…আর সেদিনই হয়ত এই অভিশাপের কাল শেষ হয়ে বুড়ি পিসিমাদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে, বাস্তুঠাকুর আবার আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবেন এক জ্যোতির্ময় বিকাশে।’
এই জ্যোতির্ময় বিকাশের রুপাবলোকনের যে ‘পবিত্র লোভ’ তাঁর অন্তর্গত সত্তার মধ্যে সতত প্রবহমান, তার প্ররোচনায় অনেককাল পরে আবার এসেছিলেন জন্মভূমিতে, তার গ্রাম, তার পুকুরপাড়, তার সকালসন্ধের কাছে। দেখেছিলেন শুকিয়ে ওঠা পুকুর, উজার হয়ে যাওয়া বাগান, অশ্বত্থ শিকড়ের চারিয়ে যাওয়া আক্রমণে পরাজিত অট্টালিকার অন্তর্জলি যাত্রা, আর তাদের একদা গর্বিত অধিবাসিদের প্রেতার্ত উপস্থিতি। একদা বহতা খালটি পড়ে আছে কাদার দড়ির মত। বাস্তুঠাকুরের প্রতিষ্ঠা দর্শনের পরাহত ইচ্ছা নিয়ে গ্রামজীবনে তাঁর এই প্রব্রজ্যা কোন আলোকমালায় তাঁকে পৌঁছে দেয় নি। তবু জীবনের ধ্রবপদটির উন্মোচন একদিন হবেই –‘বাস্তুঠাকুর দিবেন বর/ধানে চাউলে ভরবে ঘর/ ধান দিবেন না দিবেন কড়ি/মাঝ খাডালে সোনার লড়ি…।‘ সেই তাড়িত আকাঙ্ক্ষার আহ্বান তিনি শুনেছেন, শুনিয়েছেন জীবন জুড়ে। তাঁর সাহিত্যকীর্তির এটাই বোধহয় ধ্রুবপদ।
প্রিয় বন্ধু, সুহৃদ ও শিক্ষক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গে মহাভারতের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছিলেন ‘সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়, উন্নতির অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়।‘ প্রবেশ প্রস্থানের সীমায় বাঁধা জীবনের উদযাপন তাঁর কাছে ছিল স্বল্পায়ু ঝিঙাফুলের সুবাস সমৃদ্ধ। ‘ মানুষ জনম আহা ঝিঙাফুলের কলি/ সাঁঝ্যে ফুট্যে বিহানে মলিন/ যে জন বছরঅ দিন বাঁচিবে/ সেহতো ফুরতি করিবে/ মরিলে সে তো মাটির মিলন।’ নিয়ম মেনেই জীবনান্তে মাটির মিলনে শেষ হল মিহিরদার প্রব্রজ্যা।
বৃক্ষটির পতন হল, বিষাদটুকু বুকে নিয়ে আমরা রয়ে গেলাম।
আপনাদের সাহায্য মিহির সেনগুপ্তকে দিন দিন আমার মতো পাঠকের কাছে পৌঁছে সমাদৃত করে তুলছে ও তুলবে এবং আপনারাও সমাদৃত হবেন এই আশা পোষণ করি।