মিহিরের চলে যাওয়া। অভিজিৎ সেন। মিহির সেনগুপ্ত-স্মরণে ‘সিদ্ধিগঞ্জের ভাটিকুমার’।
মিহির চলে গেছে আজ নিয়ে পাঁচ দিন হলো। এই পাঁচ দিনে স্থির ভাবে কোনো কিছুই চিন্তা করতে পারিনি। আমি তার শেষ যাত্রায়ও উপস্থিত থাকতে পারিনি। আমাদের ছেলে-জামাইরা মিহিরকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল রাত দশটা-এগারোটার সময়। গৌতম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কি শ্মশানে যাবেন ঠিক করেছেন? আপনি যদি যান, তাহলে আমি আপনাকে গাড়ি করে নিয়ে যাব।
শ্মশানে যাওয়া আমার পক্ষে অনেকগুলো কারণেই সম্ভব ছিল না। আমরা এখন পর্যন্ত জীবিত তিন ভাই, চার বোন– সবাই যে যার ঘরে চুপচাপ বসেছিলাম বিকেল থেকে, কেউ কেউ সারা দিনই।
সন্ধে নাগাদ খবর এসেছিল, মিহির আর নেই।
আমরা তার আগের পনেরো-ষোলো দিন ধরে এই ঘোষণাটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মিহির অসম্ভব যন্ত্রণা পাচ্ছিল। তার সঙ্গেই ছিল তার নতুন লব্ধ পারকিনসন্সের বিড়ম্বনা। সে কথা বলতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিল। কথা বলতে গিয়ে হামেশাই খেই হারিয়ে গিয়ে নিজেকে এবং শ্রোতাকে অপ্রস্তুত করছিল সে। লোককে চিনতে পারছিল না। বিভ্রান্তি তাকে বিষয়ান্তরে নিয়ে ফেলছিল।
আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম, তার আর নিস্তার নেই। এই অবস্থায় আমরা পনেরো-ষোলো দিন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আশা করতাম কোনো ম্যাজিক আরোগ্যের। অথচ সে-সব আমরা কেউই বিশ্বাস করতাম না। শুধু অপেক্ষা করতাম অনির্বাণ (মিহিরের জামাতা) কিংবা তিতিরের (মিহিরের কন্যা) বিকেল পাঁচটার হোয়াটসঅ্যাপ রিপোর্ট কখন আসবে, যাতে থাকবে মিহিরের সর্বশেষ খবর এবং প্রতিদিনই আমাদের আশার বিপরীত খবর আসত। ফের পরের দিনের জন্য অপেক্ষা এবং ফের আশাহত হওয়া।
হাসপাতালে আমি একদিনই গিয়েছিলাম। সে-যাওয়া বিশেষ থেরাপি শুরুর দু-তিন দিন আগে। সে আমার হাত ধরে থাকল। কাঁদল। আমিও কাঁদলাম। সঙ্গে টুলু (মিহিরের স্ত্রী) ছিল। আমি নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করলাম। তখন পর্যন্ত আমরা আশা করে ছিলাম যে, ডাক্তার কথিত এই বিশেষ থেরাপিতে অন্তত এক-দেড় বছর তার আয়ু বৃদ্ধি হবে। তাই নিজেকে সংযত করে একটু নড়ে বসলাম। বললাম– ‘আমরা একই নৌকায় আছি। অনেক বছর ধরে বেঁচে আছি আমরা। আক্ষেপ বোধহয় কারুরই আর নেই, কী বলিস?’
সে বোধহয় আমার কথাটা শুনতেই পেল না। তখন তার কথার সূত্র হারিয়ে ফেলা, কথার উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব মনে রাখার মতো স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছিল।
সতেরো তারিখ রাত দেড়টা পর্যন্ত চেয়ারেই বসেছিলাম আমি আর আমার স্ত্রী। সম্ভবত আমাদের অন্য ভাইবোনেরা যে যার বাড়িতে এভাবেই বসে ছিল। দাদা একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, ওরা শেষ পর্যন্ত কী ব্যবস্থা করেছে ?
আমি বলেছিলাম, ওরা নিমতলা ঘাটে নিয়ে গেছে ওকে।
শুয়ে আমাদের কারোরই ঘুম আসছিল না।তবুও টের পেলাম শরীর ও মনে স্বস্তি নির্মিত একটা প্রশান্তি ধীরে ধীরে আবৃত করছে সমগ্র অস্তিত্বকে। এক সময় পাতলা একটা ঘুমের আবরণে নিজেকে আবৃত করে ফেললাম। ঘুমের মধ্যে অস্ফূট বা অর্ধস্ফূট সব স্মৃতির স্বপ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করে বিশ্রামকে বিঘ্নিত করতে লাগল। এপাশ ওপাশ করতে করতে ফের পুরোপুরিই জেগে উঠলাম। চোখ খোলা রেখেই অন্ধকারের ভেতরে দেখতে লাগলাম আমার আর দাদার বস্তির একঘরের বাসায় আমি অপেক্ষা করছি। দাদা গেছে বারাসতে দিদির বাড়িতে, সেখানে নাকি পাকিস্তান থেকে মিহির এসেছে।
গোবরার সেই বস্তির ঘরের সামনে একটুকরো সবুজ ঘাসের এক চিলতে জমি ছিল। রাস্তা দিয়ে দাদা মিহিরকে নিয়ে ওই সবুজ জমিটুকুতে নেমে এল। নেমে এলাম আমিও। আমার থেকে দু বছরের ছোটো ভাইকে দেখলাম এগারো-বারো বছর পরে। প্রথমেই চোখ পড়ল পায়ের দিকে। ওর পায়ের থেকে অন্তত দু সাইজ বড়ো এক জোড়া মিলিটারি বুট পায়ে অত্যন্ত মলিন পোশাকে আমাদের ভাই মিহির আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
দাদা মিহিরকে আমার দিকে একটু খানি ঠেলে দিয়ে বললেন– ওকে একটু মানুষের মতো করতে চেষ্টা কর এবার।
সে ঘরে ঢোকার সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াতে আমি বললাম– এই জুতো জোড়া খুলে ওপাশে ফেলে দে। ওতে আমাদের কোনো দরকার নাই।
চোখ ভেজা স্মৃতি।
চাচ্ছি লেখাটা আরো বড় আরো বড় হোক। কাঁদবো আর পড়বো কাঁদবো আর পড়বো।