মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ৯ । দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস । লিখছেন আদিত্য ঢালী

0

ভোটের মরসুম আসলেই আমরা যারা জনপ্রতিনিধি তারা ভয়ে যবুথবু হয়ে থাকি। প্রমাদ গুনতে থাকি এই বোধহয় চিঠি এল ভোট নিতে যাওয়ার। ভোট নিতে যাওয়ার যা হ্যাপা সে একমাত্র যারা নিতে যায় তারাই জানে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে যারা একবার ভোট নিতে যায় তারা ভগবানের কাছে ভোট ঘোষণা হলেই প্রার্থনা শুরু করে দেয় তাদের নাম যেন না আসে। ভোটের ডিউটি এলে একটা উপরি পাওয়া যায় ঠিকই তা-সত্ত্বেও আমরা ভোটের ডিউটি এলেই আবার ডিপ্রেসনে চলে যাই। এমনিতে সরকার বর্ধিত ডিএ দেয় না, দীর্ঘদিন পাওনা টাকা আটকে রাখে, পেনসন উঠিয়ে দেয়, পিএফের সুদ দিনের পর দিন কমিয়ে দেয় কিন্তু একমাত্র ভোটের ডিউটি পড়লে সেই ব্যক্তিকে ভোট নিতে যাওয়ার আগেই পাওনা দিয়ে দেয়। পাস বই প্রিন্ট করলেই জ্বলজ্বল করে ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে ক্রেডিট হওয়া টাকার পরিমাণ। যদিও সেই টাকার পরিমাণ এতই কম যে ভোট নিয়ে ফিরে আসার পর আপনি যে একদিন ছুটি পাবেন সেইদিন বাজারে গিয়ে সামান্য চুনো মাছ কিনেই ফিরে আসতে হতে পারে। নতুবা আমার মতন নিজের পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে সারা রাত প্ল্যাটফর্মে কাটিয়ে ভোরের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘরে ফিরতে হবে।

চাকরিতে জয়েন করেছি তখন প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ শুরু হয়েছে সবে। অফিসে গরমের তাপ এতই যে পানীয় জল এক ঘন্টার পর আর খাওয়া যায় না। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুলকুল পাউডার মেখে সকালে অফিসে আসি। ব্রেক টাইমে না খেয়ে আরও একবার স্নান করতে বাড়ি যাই। ডিহাইড্রেশন থেকে বাঁচতে অফিসের ড্রয়ার ভর্তি সরকারি বিনামূল্যের ওআরএসের পাতা পরে থাকে। এক বোতল জল তো প্রতিদিন লাগবেই। এরপর ঘরে ফিরে এক গ্লাস গ্লুকোনডির জল। তৃতীয়বার স্নান সেরে এসে মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি দেওয়া কারণ বিছানা রোদের তাপে তখন উত্তপ্ত। অফিস ফেরতা ক্লান্তিতে ধুঁকে ধুঁকে ঘরে ফিরে খানিকক্ষণের বিশ্রাম আর তারপর কোমরের যন্ত্রণার জন্য ফিজিওথেরাপি নিতে যাওয়া। সকালে উঠে নিয়মিত ট্র্যাকশন নেওয়া। এরম ভাবেই চলছে তখন। অনাগত অতিথির মত একদিন ঘেমে নেয়ে পিওন এসে চিঠি দিয়ে গেল। চিঠি খুলতেই চোখ পড়ল গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ভোটের ট্রেনিংএ যাওয়ার নোটিশ। এক নিমেষে মন গরম লাগার থেকেও বেশি খারাপ হয়ে গেল। কারণ তার আগেই আমি জেনে গিয়েছিলাম ভোটের ডিউটি এলে নিয়তিও নাকি পরিহাস করে। ম্যানেজারদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। তার জেরেই তারা বলেছিল “ডিউটি যখন এসেছে তখন তো যেতেই হবে। আর যাবে না কেন? আমরা কতবার গিয়েছি জানো? নতুন অভিজ্ঞতা হবে। ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের তো ভোটে নেবেই। আর না গেলে কিন্তু চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। তোমার নিজের ব্যাঙ্কও কিন্তু তখন তোমার পাশে থাকবে না!” এদিকে আমার ডিউটিতে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। একেবারেই নেই। তার প্রধান কারণ আমার কোমরের ব্যথা। অফিসে সাত ঘণ্টা বসে কাজ করতেই যা কষ্ট হয় সেখানে বারো ঘন্টা বিশ্রামহীন টানা ভোট নিতে আমার অবস্থা যে কী হবে সেটা ভেবেই যাওয়ার ইচ্ছে একেবারে চলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে হয়ত আমার ডিউটি আমি ক্যান্সেল করতে পারব। সমস্ত ম্যাডিক্যাল ডকুমেন্ট দিয়ে নিজের কঠিন অবস্থার কথা জানিয়ে চিঠি পাঠালাম যাতে আমার ডিউটি ক্যান্সেল করা যায়। কোন উত্তর এল না। আমার কুরিয়ার খরচ গেল প্রায় দেড়শ টাকা। প্রথম ট্রেনিং-এ গেলাম না। বাকি সবার ট্রেনিং থাকায় ব্রাঞ্চ সেদিন বন্ধ। ছুটি পেয়ে বাড়ি চলে এলাম। দ্বিতীয় ট্রেনিং-এও গেলাম না। ততদিনে ভেবে নিতে শুরু করেছি বোধহয় ক্যান্সেল হয়ে গেছে। কারণ আমার তো মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে চিঠি দেওয়াই আছে। দ্বিতীয় ট্রেনিং-এর দিন আবার একটা অঘোষিত ছুটি। দু’দিন পর শো-কস নোটিস এল। কেন ট্রেনিংএ যাইনি তার কারণ দেখিয়ে চিঠি দিতে বলা হল। এদিকে আমি তো আগেই সমস্ত ডকুমেন্ট দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি! আবার পাঠালাম। দেড়শ’ টাকা কুরিয়র চার্জ। এদিকে ট্রেনিং-এর অঘোষিত ছুটিও কেটে নেওয়া হল নিজের লিভ থেকে। শো-কসের উত্তর দিয়েও লাভ হল না। নতুন ট্রেনিং-এর তারিখ দিয়ে আবার চিঠি এল। এবারে ম্যানেজার খুব ভয় দেখাল। “প্রথম চাকরি। ওদের হাতে কিন্তু অনেক পাওয়ার। ডিউটি করে এস। নাহলে কিন্তু চাকরিও চলে যেতে পারে।” সত্যি বলতে এবারে একটু ভয় পেলাম। চাকরি চলে যাওয়ার ভয় নয়। সরকারি পরোয়ানা না মানার ভয়। এদিকে আমি জেনেছি ডিউটি করতে না গেলে সরকার আমার বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধি আইনের দৌলতে স্টেপ নিতে পারে। কিন্তু আমি যদি আমার ডিউটিতে না যাওয়ার সঠিক কারণ মহামান্য কোর্টের কাছে দেখাতে পারি তবে সেক্ষেত্রে সাজা হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রকে আমরা সবাই ভয় পাই। আরও বেশি ভয় পাই রাষ্ট্রের রক্ষাকর্তাদের। তারা কতটা রক্ষা করে আর কতটা নীতিপুলিশগিরি করে তা আজকাল সকালের খবরের কাগজ খুললেই বুঝতে পারা যায়।

পঞ্চায়েত ভোট। তখন ‘খেলা হবে’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু খেলার শুরু তখন থেকেই হয়েছিল। আমার অফিস মালিগ্রাম। বাড়ি বাটানগর। আর ভোটের ডিউটি পড়ল কেশিয়ারি। কেশিয়ারি যেতে হয় খড়গপুর ষ্টেশনে নেমে বাস ধরে। ষ্টেশনের বাইরেই বাস স্ট্যান্ড। বাস ধরে যেতে সময় লাগে প্রায় ঘন্টাখানেক। সিঙ্গেল ট্রেনিং-এ যেতে হবে আমায় কেশিয়ারি ব্লক অফিসে। মালিগ্রাম থেকে ভোর ছয়টার বাস ধরলাম। অনুত্তমের দোকান তখন খুলে গেছে। গয়লা এসে দুধও দিয়ে গেছে। কাজেই বাসে ওঠার আগে চা খেতে কোনও সমস্যা হল না। বাস এল সময়ের থেকে দশ মিনিট দেড়ি করে। কিন্তু একি! এই ভোরবেলাতে বাস, ওঠার যায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। পা-দানিতে পর্যন্ত লোক দাঁড়িয়ে আছে। অগত্যা উপায় না দেখে ছাদে উঠে পড়লাম। ভোর বেলা রোদের তেজ তেমন নেই তাই সমস্যা হবে না। মালিগ্রাম থেকে নিকটবর্তী ষ্টেশন বালিচক। বাসে আসতে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট সময় লাগে। ষ্টেশনে এসে দেখলাম টিকিট কাটার লম্বা লাইন। অনলাইন টিকিট কাটার ব্যবস্থা তখনও জানতাম না। একহাত দিয়ে টুকটুক করে কম্পিউটার চালানো টিকিট ক্লার্কের সামনে যখন ভিড় ঠেলে পৌঁছালাম ততক্ষণে ট্রেনের ঘোষণা হয়ে গেছে। দৌড়ে দৌড়ে ফুট ব্রিজ দিয়ে এক নম্বর থেকে যখন চার নম্বর পৌঁছালাম তখন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে। গেটের কাছে দাঁড়ানোর একটু যায়গা পেলাম। বালিচক থেকে খড়গপুর যেতে লোকাল ট্রেনে আধ ঘন্টা লাগে। ষ্টেশনে নেমে বাঁদিকে গেলে বাস টার্মিনাস। টার্মিনাস সংলগ্ন একটা দোকান থেকে দোসা খেয়ে বাস ধরার উদ্দেশ্যে টার্মিনাসে পৌঁছে কেশিয়ারি বাস পেলাম একদম শেষের দিকে। ভাগ্য ভালো বাসে উঠে বসার সিট পেলাম। এদিকে ততক্ষণে গরম বাড়তে শুরু করেছে। বাস চলতে শুরু করলে গরমটা বোঝা গেল না। রেলওয়ে কলোনি পার করে বাস দুদিকে ধু ধু প্রান্তরের মাঝের পিচের রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। দু’দিকের জমি অনুর্বর হওয়াতে চাষ আবাদ এদিকে খুব একটা হয় বলে মনে হল না। কেশিয়ারি বাস স্ট্যান্ডে বাস থেকে নামিয়ে দিল। এখানটা বাজার এলাকা। দোকানপাট ভালোই আছে। বাজারের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে বিডিও অফিস যাওয়ার। হেঁটে প্রায় দশ মিনিট। গায়ে তাপ লাগতে শুরু করেছে। আমি ছাতা খুলে হাঁটতে শুরু করলাম। বিডিও অফিস যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় বেলা দশটা। কিন্তু অফিস একদম ফাঁকা। কেউ আসেনি। এদিকে আমায় আসতে বলা হয়েছিল ঠিক সকাল দশটায়।

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব…

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *