মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ৭ । অথঃ শিক্ষা ব্যবস্থা । লিখছেন আদিত্য ঢালী
শিক্ষা যে আমাদের দিক বদলে দিতে পারে এই ধারণাই এখনও অধিকাংশ মানুষের হয়নি। কারণ আমাদের কাছে শিক্ষার্জন করার প্রধান কারণ হল শিক্ষাশেষে যাতে একটি চাকরি জুটে যায়। ভালো মাইনে হোক সেটাই আসল কথা। আমারও এই চারিদিক ঘেরা ঘোরাটোপের মধ্যে বসে প্রতিদিন এটাই মনে হয় নোটই যদি গোনবার ছিল তাহলে এত এত দিস্তা দিস্তা পড়ে এত এত নামীদামী ডিগ্রী নেওয়ার অর্থ কি রইল আর! এই ডিপ্রেসনে যখন রোজ আমার চোখ সারাক্ষণ ঢুলুঢুলু হয়ে থাকে, রাগ জমে জমে পাহাড় হয় সেইরকমই এক শুভ মুহুর্তে আমি আবিস্কার করলাম ডিগ্রী অর্জন করার প্রধান কারণ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি পাঠক কিন্তু বিভ্রান্ত হবেন না এই ভেবে যে ডিগ্রী অর্জন করা শিক্ষা অর্জন করা একই জিনিস। শিক্ষা অর্জন করার জন্য নামীদামী স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলেও চলে কিন্তু ডিগ্রী অর্জন করার জন্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আবশ্যক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা অর্জন করেছিলেন আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। কিন্তু মুশকিল হল ডিগ্রী আর শিক্ষার মধ্যে ফারাক খুঁজবেন কীভাবে? আমি ফারাক খুঁজতে পেরেছিলাম। সরাসরি সেই ঘটনার কেন্দ্রে চলে যাই এবারে।
নতুন বাসা নিয়েছি প্রায় মাস ছয়েক হয়েছে। একদম ষ্টেশনের কাছে। কিন্তু অফিস থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। রোজ বাস ধরতে হয় যাতায়াতের জন্য। আমার সকালের ঘুম এই জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটায় বাস থাকে, তাকে ধরার জন্য স্ট্যান্ডে যেতে হয় আরও মিনিট পনেরো আগে। আগে থেকে না গেলে বসার যায়গা পাওয়া যায় না। আর বসার যায়গা না পেলে এই একঘন্টার নড়বড়ে পথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ভিড় বাসে কোমরের যন্ত্রণা নিয়ে যাওয়া একপ্রকার দুষ্কর প্রায়। অগত্যা আগে থেকেই যেতে হয় স্ট্যান্ডে। এই বাসটাকে বলা হয় মাস্টারদের বাস। বাসের অধিকাংশ সহযাত্রীই মাস্টার। ওদিককার যত স্কুল আছে প্রায় সব স্কুলের মাস্টারদের যাওয়ার জন্য এই বাসটিই থাকে, মূলত যারা ট্রেন করে এদিক ওদিক থেকে আসে। এই বাসটা সকালের ট্রেনের সাথে কানেক্টিং। আবার শুধু যারা ট্রেনে করে আসে তারা নয়, ষ্টেশন চত্বরে যারা থাকে তারাও এই বাসটাই ব্যবহার করে যাতায়তের জন্য। যারা লোকাল তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকে। তারা ট্রেন ঢোকার আগেই বাস স্ট্যান্ডে চলে আসেন। বাস ঢুকলেই টুক করে উঠে পরে নিজের কাছে যা যা থাকে যেমন পিঠের ব্যাগ, বাজারের ব্যাগ, রুমাল, জলের বোতল, শীতকালে হলে সোয়েটার সব দিয়ে সিট রিজার্ভ করে রাখে অন্য মাস্টারদের জন্য। মাস্টারদের মধ্যে ইউনিটি দেখার মত। সাধারণত এইরকম ইউনিটি দেখা যায় না। একমাত্র বামফ্রন্ট আমলে মাস্টারদের অ্যাসোসিয়েসনের মধ্যে দেখা যেত। তারপর বামফ্রন্ট চলে যাওয়ার পর সেই ইউনিটিও চলে গেছে। কিন্তু এখানে এসে এই ইউনিটি দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরে মনে হল যে এরা কেউই একই এলাকায় থাকে না। কাজেই একই বিষয় হলেও এদের মাদুরের ব্যবসাতে কোন সমস্যা হয় না। নিজের সব কিছু দিয়ে এরা একে অপরের জন্য সিট আঁকড়ে রাখতে পারে। আর আমরা দু’মিনিট দেরীতে এলে হাপিত্যেশ হয়ে চেয়ে থাকতে হয় কখন একটা সিট ফাঁকা হবে। তো এই হল নিত্য দিনের জার্নির কাহিনী। এইরকমই কোন একদিন দু’মিনিট দেরীতে এসে যখন দেখলাম যে অধিকাংশ সিট ব্যাগ বোতলদের দখলে চলে গেছে মেজাজ খানিকটা খিটকে গেল। কিন্তু উপায় নেই। বাস যদি ছেড়ে দিই ১৫ টাকার বাস ভাড়ার বদলে ৩০০ টাকা খরচ করতে হবে অফিসে পৌঁছানোর জন্য। এদিকের টাকার বড় মায়া। এখানে দিন যাপন করতে গিয়েই মাসের শেষে হাত একেবারে খালি হয়ে আসে। মাঝে মাঝে বাবা মায়ের থেকে হাত পেতেও দু’ একশো টাকা চেয়ে নিয়ে হয়। কাজেই বাস ছাড়ার ভাবনা বাতিলে। কোনরকমে একটা সিটের সাথে কোমরটা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম যাতে কিঞ্চিৎ ব্যথার থেকে নিস্তার মেলে। নিস্তার তো মিলল না উল্টে ব্যথা আরও বেড়ে গেল বাসের ঝাঁকুনিতে আর সিটের সাথে কোমরের ধাক্কায়। বাস থেকে যখন নামলাম সোজা হয়ে হাঁটতে পর্যন্ত পারছিলাম না। তবে এসব নিয়ে ভাবিত হইনা। নিত্যদিনের অভ্যেস। কুঁজো হয়ে একটু হাঁটার পর কোমরটা আস্তে আস্তে সোজা করলেই কিঞ্চিৎ ব্যথা হলেও আবার সোজা হয়ে হাঁটতে পারব।
অফিসে ঢুকে দেখি আজ গড়ের মাঠ। চারিদিক ফাঁকা একেবারে। দেখেই মুখে একটা চওড়া হাসির রেখা দেখা দিল। বাসের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে যেন চলে গেল। বছরে যে ক’টা দিন ব্রাঞ্চ একটু ফাঁকা থাকে, কাজের চাপ একটু কম থাকে, চাইলেই নিচে গিয়ে যখন তখন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আসা যায়। যদিও এহেন দিন ক্বচিৎ কদাচিৎই আসে বছরে। আজ দেখেই বুঝলাম আজ হল সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত দিন। যা অনেকটা বিরোধীদের ভোটারদের মতন ভোট বাক্সে ভোট যাবে বলেও যায় না। ক্বচিৎ কদাচিৎ কয়েকটা যায়। আর তাতেই সান্ত্বনা খুঁজে নিতে হয়। আমাদেরও অভ্যেস হয়ে গেছে। ব্রাঞ্চে ঢুকেই ব্যাগটা টেবিলে ছুঁড়ে মুখ ধুয়ে আগে নীচে চললাম এই আনন্দকে সেলিব্রেট করতে একটা চা সিগারেট দিয়ে। সিগারেট ফুঁকে ব্রাঞ্চে ঢুকতেই ম্যানেজার ঘোষণা দিল “এই আজ কিন্তু টাকা লিফিটিং হবে চল সব গুছিয়ে রাখি। ওরা তো আবার এসে দু’মিনিট দাঁড়াতে পারে না।” ম্যানেজারকে নিয়ে ভল্টে ঢুকলাম। লিফটিং এর টাকা আলাদা করে রাখার পর জিজ্ঞেস করলাম “অল্প করেই কাউন্টারে বের করি ভিড় আজ কিছুই হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।” ম্যানেজার বলল “আরে না না, ভিড় না হোক, আজ ভুলে গেলে আজ তো আঠাশ তারিখ। সেকেন্ড হাফেই সব মাস্টাররা স্যালারি নিতে আসবে। ঢুকে গেছে স্যালারি।”
কাউন্টার ফাঁকা থাকায় কয়েকটা কেওয়াইসি ধরিয়ে দিয়েছে ম্যানেজার। সেগুলিই ঢিমেতালে করছি টুকটুক করে মাঝে মাঝে একটু মোবাইল ঘাঁটছি। ঠিক সেই সময় একটি বাচ্চা মেয়ে এসে কাউন্টারের জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে দিল। আমি মুখ তুলে দেখলাম স্কুলের ড্রেস পড়া আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে সেভেন কি এইটে পড়ে। মাইনোরিটি স্কলারশিপের টাকা তুলতে এসেছে। স্কলারশিপের টাকা সাধারণত পাঁচ ছয় হাজার আসে। আমি হাত বাড়িয়ে স্লিপটা নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে তাকাতেই আমার চক্ষু একেবারে চড়কগাছ। স্লিপ নিয়ে প্রথমেই যেটা দেখি সেটা হল টাকার অঙ্কটা। টাকার অঙ্কটা দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেছে। ৬০০০,২০০,৫০/-। এত টাকা এ জীবনে কেউ তোলেনি এই ব্রাঞ্চ থেকে। আর এই বাচ্চা মেয়েটা এত টাকা তুলবে? তাকিয়ে দেখলাম সাথেও কেউ আসে নি। আবার স্লিপের দিকে তাকালাম। অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা দেখে বুঝলাম স্কলারশিপ অ্যাকাউন্ট। কিন্তু অক্ষরে লেখার যায়গাটা দেখে আবার ভ্রু কুঁচকে গেল। অপরিস্কার হস্তাক্ষরে লেখা ‘ছ হাজার দুশো পঞ্চাশ’। আমি মুখ তুলে খানিকক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম “কত টাকা তুলবে?” খোনা গলায় উত্তর দিল “ছ হাজার দুশো পঞ্চাশ।” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম আবারও একই উত্তর দিল। এবারে জিজ্ঞেস করলাম কত লিখেছ উত্তর এল সেই একই “ছ হাজার দুশো পঞ্চাশ।” আমি তাও বুঝতে পারলাম না যে বানান করে এটা লিখেছে সে কীভাবে সংখ্যায় এরকম লিখল। কিছুক্ষণ পর আমার ব্রেন এটা ডিকোড করতে পারল। ৬২৫০ এর পরিবর্তে গোটাটাকে ভেঙে ৬০০০, ২০০ এবং ৫০ লিখেছে। আমি এরপর ওকে কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কোন ক্লাসে পড়?” মুখ বাড়িয়ে উত্তর দিল “সেভেন।” আমি পুরনো একটা কাগজ আর পেন টা বাড়িয়ে বললাম “এটায় লেখো তো ছয় হাজার দুই শত পঞ্চাশ”। কাগজটা নিয়ে লিখল “ছ হাজার দুশো পঞ্চাশ”। আমি আবার বললাম “না না বানান করে না, সংখ্যায় লেখ।” এবারে আবার সেই একই লিখল ‘৬০০০,২০০,৫০/-’। আমি ওকে কাছে ডাকলাম। পিছন দিয়ে আমার সামনে এলে বললাম “এরকম ভাবে কি ছয় হাজার দুশো পঞ্চাশ লেখে?” জবাব দিল “হ্যাঁ, এইভাবেই তো লেখে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম “কে শিখিয়েছে?” জবাব দিল “স্যার।” আমি কগজের ওপর একক, দশক, শতক হাজার লিখে ওকে কীভাবে ছয় হাজার দুশো পঞ্চাশ লিখতে হবে বলে দিলাম। বলার পর জিজ্ঞেস করলাম “বুঝেছ?” মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি হাসলাম। “টাকাটা পাব না?” আমায় বলল। আমি বললাম “যাও নতুন করে যেভাবে শেখালাম সেইভাবে সঠিকটা লিখে নিয়ে এস আগে তারপর টাকা পাবে।” কিছুক্ষণ পর দেখলাম আবার নতুন স্লিপ হাত বাড়িয়ে দিল। আমি স্লিপ হাতে দেখলাম নারানদা লিখে দিয়েছে। নারানদাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম “কেন লিখে দিলে? আমি তো ওকে নিজে লিখতে বললাম।” নারানদা বলল “আমায় গিয়ে যে কচি বলল লিখে দিতে। ও নিজে পারবে নাকি! ও আপনি বলে দিলেও পারবে না। যেমন মাস্টার তেমনই তো ছাত্র হবে।” নারানদা আমার মুখের ওপর বলে চলে গেল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটির পিছনে ততক্ষণে অন্য একজন এসে দাঁড়িয়েছে। আমি নারানদার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি দেখায় হাঁক দিল “ও স্যার ছাড়বেন তো!” আমি সামনের দিকে ঘুরে তিনটে দু’হাজার টাকার নোট দুটো একশো টাকার ও একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে মেয়েটিকে দিলাম। মেয়েটি টাকা পেয়ে না দেখেই মুড়িয়ে সেটাকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে চলে গেল। আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকাতে চোখে পড়ল নারানদা তখনও লিখে চলেছে আর আমাদের সাবস্টাফ হঠাৎ হাত তুলে সেলিব্রেট করছে কারণ লুডো খেলায় তার ছক্কা পড়েছে।
(ক্রমশ)