মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ১৫ । বিবাহ অভিযান। লিখছেন আদিত্য ঢালী

0

একটা সময় ছিল যখন কোনো বিয়ে বাড়ি গেলেই ভাবতাম এই বিয়ে করে নেওয়ার মধ্যেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি শান্তি আছে। বর বউকে দেখে মনে হতো এরাই বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সুখী। কী সুন্দর সেজেগুজে সদাহাস্য মুখ নিয়ে সকলের সাথে কথা বলছে, ছবি তুলছে। কী আনন্দ এদের। আর আমার পরনের জামা ইস্ত্রি না করার ফলে এতটাই কুঁচকে আছে যে বাধ্য হয়ে গোঁজা জামাকে ছেড়ে নিতে হলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন বুঝলাম এদিক পানে তাকানোর কেউ নেই তখন মনে হলো যে কাজে বিয়ে বাড়িতে আসা সেই কাজেই মনোনিবেশ করা ভালো। জামার হাতা গুটিয়ে পেট ভরে খাওয়ার দিকেই অগত্যা মন দেওয়া ভালো। যত দিন গেছে তত এই বোধ তৈরি হয়েছে বিয়ে করলেই সব সুখ আসবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই ঠিকই কিন্তু কিছু অযাচিত ঝামেলা যে আসবে তার সম্পুর্ণ গ্যারান্টি আছে।

যেমন উদাহরণ হিসেবে একটা ঘটনার কথা এখানে বলি। আমার এক ছোটবেলার বন্ধু, যে খুব ভালো ছবি আঁকে, ক্লাস টেন পাশ করার পর তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ ছিল তার একটাও প্রেম হলো না। সে চেষ্টা করা শুরু করল। যে পুকুরেই মাছ ধরতে যায় হয় আগে থেকেই সেই পুকুরের লিজ কেউ নিয়ে রেখেছে নয়ত মাছেরা ওর চারা খেতে আসে না। কেউ কেউ এলেও চারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমার সেই শ্যামবর্ণ, রোগা হাড়গিলে বন্ধু রেসিং সাইকেল কিনে প্রেমিকাদের ছবি এঁকেও প্রেমে সফল হতে কিছুতেই পারছিল না। স্কুল পেড়িয়ে কলেজের গণ্ডিও শেষ হওয়ার মুখে তখন। একদিন আচমকা ফোন করে বলল “কাল সকালে তোর বাড়ি যাব ভাই। একটা ভালো জামা আর জিনস্ নেব। কাল ওকে প্রপোজ করব। আমায় একটু রেডি করে দিস প্লিজ”। বন্ধুদের প্রেম পেতে সাহায্য করবার সময় কোনোদিনও না বলতে নেই। বন্ধুমহলে এটাই রীতি। চুলটুল জেল দিয়ে সেট করে জামা জিনসের সাথে ম্যাচিং করে পড়িয়ে দিয়ে রেডি আমার বন্ধুকে সেদিন পাঠালাম। বিকেলে সে ফিরে এসে বলেছিল হয়ে গেছে। আমার বন্ধুর থেকেও আমার সেদিন বেশি আনন্দ হয়েছিল। যদিও রাতে আবার আমার মত একলা বালিশের কাছে ফিরে গিয়ে আবার মনটা কেমন করে উঠেছিল।

বেশ কিছু বছর আমার সেই বন্ধুর বিয়ে হলো। আমাদের বন্ধু মহলে সর্ব প্রথম। আমরা নেচে নেচে বরযাত্রী গেলাম। চুল দাড়ি কেটে, পাঞ্জাবি পাজামার সাথে পায়ে নাগড়াই পরে সুন্দর করে সেজে ছবিটবি তুললাম। কেউ কেউ বলল এই ছবিতে বিয়ে একদম পাকা। ঘটা করে ফেসবুকেও আপলোড করা হলো ভালো দিনক্ষণ দেখে, কিন্তু কিছুই হলো না। যদিও প্রেম এসেছিল তার বহু পড়ে। হঠাৎ-ই আচমকা। কোনো এক শীতের দিনে বৃষ্টি আসার মতো। কিন্তু সে গল্পের পরিসর ভিন্ন। আমি আবার আমার বন্ধুর কথায় ফিরে আসি। বিয়ের পর অনেকদিন বাদে আমার বন্ধু একদিন এক গ্লাস কড়া রামের পেগ গলায় ঢেলে বলেছিল “বিয়ে কর বুঝবি কত ধানে কত চাল”। সেদিন দুঃখ করে বলেছিল বেচারাকে এখন নাকি রোজ সকালে উঠে মাঠে দৌড়াতে যেতে হয়। কারণ জানতে চাওয়ায় বলেছিল বউয়ের নাকি ইচ্ছে স্বামীকে সরকারি চাকরি পেতে হবে। আরও স্পেসিফিক ভাবে বললে পুলিশে চাকরি পেতে হবে। তাই সকাল হতেই এই কসরৎ। প্রসঙ্গত আমার বন্ধু কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকুরিরত।  তাই শুরুতেই বললাম ঝামেলা বা অযাচিত অচেনা চিন্তা কোন পরিসর থেকে যে এসে যাবে তা হয়ত কেবলমাত্র বিবাহিতরাই বুঝতে পারবে।

আমার বন্ধু কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। যাক বাবা প্রেম নেই। যাক বাবা বিয়ে করার তাড়া নেই। যাক বাবা অযাচিত চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু কদিন আর মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে যখন আমরা বারবার চাই বৃষ্টি নামুক ঠিক সেরকমই বছরের কিছু কিছু সময় আছে যখন বিশেষ করে ছেলেদের মন বারবার করে চায় জীবনে একটা প্রেম আসুক। আমিও সে সময়কে নিজেরব জীবন থেকে বাদ দিতে পারিনি। বারবার বলে এসেছি “কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া”। সেই ভালোবাসা যখন এল তখন আমি চাকরিতে যোগ দিইনি। আমাকে এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়নি তখনও। লুকিয়ে চুড়িয়ে, এসএমএস ফোনে, কলেজ স্ট্রীটের বই পাড়ায় কিংবা উত্তরের গঙ্গার ধারে আমাদের প্রেম দিব্যি চলছিল। আমার বন্ধুর বাণী তখন আর মাথাতেও আসেনি। প্রেমে থাকার আনন্দকে উপভোগ করাই ছিল তখন শ্রেয়। তাই করে গিয়েছিলাম। কিন্তু গরীবের কপালে সুখ আর কদিন টেকে। এক বছরের মাথাতেই লাল মাটির গ্রামে চলে যেতে হল কোনো এক ভোরের মেদিনীপুর লোকালে চেপে।

অফিস জয়েন করেছি প্রায় তিন মাস হয়েছে। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরি একদিনের জন্য। ছুটির দিনে কোথাও যেতে যে খুব একটা ইচ্ছে করে তেমন নয়। এদিকে ইন্দ্রাণী দেখা করার জন্য নাছোড়বান্দা। আমিও হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই। প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো অজুহাতে কাটিয়ে দিই। যত সপ্তাহ পার হয় আগুনের তাপ তত বাড়তে থাকে। আমি তার আঁচ পেলেও নিজেকে সুপারহিরো ভেবে কলার তুলে চলি। জীবনে কত আগুনের উপর দিয়ে পার হলাম এইটুকু আঁচেই ভয় পেয়ে যাব!

এদিকে অফিসে প্রায়ই দেখি বিকেলের দিকে এক ভদ্রলোক আসেন। ব্যাঙ্কের কোনো কাজ তার থাকে না। আমার কাউন্টারের সামনে সে আমার দিকে সহাস্য মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন “ভালো আছেন তো?” আমিও হেসে বলি “হ্যাঁ আছি”। ভদ্রলোক চলে যান। স্থানীয় এক ব্যাঙ্কবন্ধুর সাথে গিয়ে আলাপ করেন। এখানে বলে নেওয়া যে ব্যাঙ্কবন্ধু স্থানীয় একজন লোক। এই ব্যাঙ্কবন্ধু শব্দটাও আমার দেওয়া। ব্যাঙ্কবন্ধু এমন একজন লোক যিনি বিনা পারিশ্রমিকে ব্যাঙ্কের কাজ করে দেন। মূলত তার কাজ থাকে স্থানীয় গ্রামবাসিদের সাহায্য করা। কে লোন নেবে তার সমস্ত ডকুমেন্ট লিখে তৈরি করে দেওয়া। কে লোন শোধ দেবে তাকে সর্বত ভাবে সাহায্য করা। আবার কেউ লোন নিয়ে শোধ না দিলেও তার বাড়ি থেকে টাকা আদায় করে আনা। এসবের পাশাপাশি ব্যাঙ্কের কিছু টুকটাক কাজ করে দেওয়া। এসব কিছু করে সে কিছু মাসিক কমিশন পায়। কিছু সরকারি প্রকল্প আছে সেখান থেকে কিছু টাকা পায় এছাড়া নিজেদের কাজ করে দেওয়ার জন্য গ্রাহকরা খুশি হয়ে যে যা দেয়।

সেই সদাহাস্য ভদ্রলোক প্রায়দিনই আমাদের ব্যাঙ্কবন্ধুর সাথে আলাদা করে ডেকে কথা বলে। আর সেই ব্যাঙ্কবন্ধুবাবুও আমায় ডেকে মাঝে মাঝেই বাড়ির কথা, আমার এলাকার কথা, পরিবারের কথা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে। আমিও উত্তর দিয়ে দিই কিছু না বুঝেই। এদিকে প্রেমের সমুদ্রে তখন একের পর এক ঢেউ আসতে শুরু করেছে। শুরুর দিকে ঢেউ সামলাতে পারলেও যতদিন এগোচ্ছে ঢেউ-এর বেগ এত বেড়ে যাচ্ছে যে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। একসময় বুঝলাম এরকমভাবে হবে না। এই ঢেউ-এর জোয়ারে আমি ভেসে যদি এমন চলতে থাকে। বাড়ি ফিরে ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা করতেই হবে। এবারে আর দেখা না হলে আমার অতীতের আর প্রেমগুলোর মত এই প্রেমটাও মাঝপথে ফাঁকি দিয়ে পালাবে। ঠিক হলো একদিন ছুটি নিয়ে আসব। সারাদিন শহর চষে বেড়াব। অফিসে জানালাম ছুটি নেব। শুরুর দিকে একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেও আমার জেদের কাছে বিশেষ পাত্তা পেল না। কারণ আমি মনে করি ছুটি নেওয়া আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ প্রয়োজনে ছুটি নিতেই হবে।

যেদিন বাড়ি ফিরব সেদিন ব্রাঞ্চ থেকে বেরবার আগে সেই ব্যাঙ্কবন্ধুবাবুটি আমার কাছে এসে বলল-

— আজকে বাড়ি যাবেন নাকি?

— হ্যাঁ। এই তো বেড়বো।

–ওহ আচ্ছা।

–কেন কিছু বলবেন?

–না সেরম কিছু না। একটা কথা ছিল আসলে…

–বলুন না।

–না না সেরম ইম্পোর্টেন্ট কিছু না। আপনি ফিরে আসুন তারপর বলব।

–বলতে পারেন কিন্তু আজই।

–না না আজ না। আজ থাক। আজ আপনার তাড়া আছে। আপনি সব সেরে নেন জলদি।

–ঠিক আছে।

–আপনি কবে আসছেন আবার?

–এই তো কাল বাদে পরশু চলে আসব আবার।

–ঠিক আছে সাবধানে যান আজ। এলে কথা হবে।

সেদিন ফিরে এলাম। পরদিন মাঞ্জা মেরে দাড়ি ট্রিম করে, চুল কেত দিয়ে আঁচড়িয়ে, পাঞ্জাবি পরে দীর্ঘ কয়েকমাস পর দেখা করতে গেলাম। মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম যে হয়ত মানাতে বোঝাতে আমাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিন্তু সেসবের কিছুই করতে হল না। দেখা হওয়ার সাথে সাথেই আমরা একে অপরের দিকে দেখে, মুচকি হেসে, অতীতের কথা সব ভুলে গেলাম। তারপর হাত ধরাধরি করে এদিক সেদিক ঘুরে, পেটপুরে খেয়ে, কয়েকশো সেলফি তুলে বাড়ি ফিরে এলাম। নতুন করে আবার যেন প্রেমের জোয়ার এল মনে। কিন্তু আবার আগামীকাল সকালে উঠে বেরোতে হবে মনে পরতেই চোখে ঘুম চলে এল। আমি একে ডিপ্রেশনের ঘুম বলি।

পরদিন সকালে অফিস যাচ্ছি। বাসের জানলায় মাথাটা বারবার করে ঠোক্কর লাগছে আর আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। হঠাৎ শব্দ করে ফোনে একটা মেসেজ এল। ঘুম চোখে খুললাম। তাতে লেখা “কাল কত দিন পর একটা ভালো দিন কাটালাম আর তুমি একটা ছবিও দিলে না আমাদের!” আমি ভাবতে লাগলাম ছবি কোথায় দেওয়ার কথা বলছে? একেই চোখে ঘুম মাথাও ঠিকঠাক কাজ করছে না। বাস বাম্পার পার হওয়ার সময় মাথায় এত জোড়ে লাগল যে তক্ষুনি বিদ্যুৎ বেগে ব্রেন কাজ করে দিল। ছবি দিতে বলছে মানে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে বলেছে। আমি বিন্দুমাত্র দেরি না করে যেখানে যেখানে ছবি আপলোড করা যায় সব জায়গায় করে দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই একটা লাভ সাইনের ইমোটিকন এল ফোনে।

অফিস জয়েন করে গেছি তখন বেশ কিছুদিন হলো। একদিন দুপুরে টিফিনে আমি ব্যাঙ্কবন্ধুটি দুজনে মিলে সুখটান দিচ্ছি সেই সময়ই উনি বললেন-

–আহ! আপনি সেদিন আপনার আর ম্যাডামের ছবিটা স্টেটাসে দিলেন বলে আপনাকে আর বলাই হলো না।

–হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি তো বলেছিলেন কী বলবেন। বলুন না এখন।

–আরে কি আর বলব আপনাকে। ঐ যে বিকেলের দিকে ধুতি পরে মাঝে মাঝেই একজন আসত না মনে আছে আপনার?

–হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে তো। আমার কাউন্টারের কাছে এসেও দেখা করে যেত আমার সাথে।

–হ্যাঁ উনিই। উনি আমার গ্রামের লোক। ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য আমাকে ধরেছিল। আপনাকে পছন্দ হয়েছিল। আমায় এসে বারবার কথা বলতে বলছিল। আমি সেদিন ঐ কথাই আপনাকে বলতে গিয়েছিলাম। পরদিন দেখলাম আপনার আর ম্যাডামের ছবি। আমার আর বুঝতে কিছুই বাকি রইল না। তাই আর কিছু বলিনি। ওনার বাড়ি গিয়েও বলে এসেছি স্যার এখন বিয়ে করবে না। আর করলেও ওনার নিজের ঠিক করা আছে।

আমি এরপর কী বলব না বুঝে ওনার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। উনিও বুঝলেন আমি কিছুটা অপ্রস্তুতে পড়েছি তাই আর কিছু না বলে অন্য কথা বলতে শুরু করলেন। কিছু সময় পর, তখন টাকা গুনে গুনে মেলাচ্ছি হঠাৎ ইন্দ্রাণী ফোন করল-

–হ্যালো…

–হ্যাঁ বলো।

–বলছি একটা কথা ছিল।

–বলে ফেলো।

–বলছি মানে …

–আমতা আমতা না করে সোজা কেসে ফেলো।

–না মানে বলছি যে…।

–বলে ফেলো বললাম তো।

–আসলে বলছি যে এখনই কিন্তু বিয়ে করব না।

–আমি তো বলিনি সে কথা।

–না মানে আমি বললাম। কয়েকটা বছর যাক।

–হ্যাঁ অবশ্যই। আমি শহরে ফিরি তারপর ভাবব।

–একদম একদম। আমিও গুছিয়ে নিই নিজেকে একটু।

এরপর এই নিয়ে আর কথা হয়নি। এখনও অবধি আমার শহরে ফেরাও হয়নি। বিয়ের কথা হয়। তবে সেই অভিযান কবে থেকে শুরু হবে তা এখনও আমরা জানি না। শুধু ইদানিং মাঝে মাঝে এক গ্লাস কড়া রামের পেগ খেলেই আমার সেই বন্ধুর কথা মনে পড়ে।  যে বলেছিল “বিয়েটা কর তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল”। আমার মনে হয় আমি বিয়ে না করেই তার অনেকটা বুঝে ফেলেছি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *