লাদাখি রান্নায় সেরকম তরিবৎ কিছু নেই। দেড়শো-দুশো বছর আগে পর্যন্তও লাদাখের লোকজন আধকাঁচা ঝলসানো বা শুকনো মাংস, ইয়াক আর ছাগলের দুধ-দই-মাখন-চীজ, যব-বাকহুইটের ছাতু, শুকনো খুরমানি-আখরোট-বাদাম, মাখন চা, ছাং এইসবই শুধু খেত। লাদাখের আবহাওয়ায় সমতলের মতো বিভিন্ন তরিতরকারি-ডাল-তৈলবীজ-মিষ্টদ্রব্য বা সমুদ্র-উপকূলবর্তী অঞ্চলের মতো বিবিধ মশলা উৎপন্ন হয় না বলে খাওয়াদাওয়ার পাটও এখানে সাধারণ এবং বৈচিত্রহীন। লেহ বা কাছাকাছির বড়ো গ্রামগুলোতে ধীরে ধীরে নগরায়ণের ফলে জীবনযাপণ এবং রন্ধণশৈলীর অনেক পরিবর্তন হলেও আনেলে-র মত একটু পুরোনো দিনের মানুষেরা এবং প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বসবাসকারী বিভিন্ন ধরনের জনজাতি তাদের রান্নাবান্না সহ সামগ্রিক জীবনযাপনে প্রাচীন জীবনশৈলীর মূলসুরটি আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তবে রান্না বিষয়টি যেহেতু যে কোনো মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই সামগ্রিক জীবনচর্যার একটি নিদর্শন, ধর্ম-শিল্প-ভাষার মতো পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদানপ্রদানের মাধমে তারও প্রসার-বিস্তার-পরিবর্তন ঘটতেই থাকে।
লাদাখের মোট আটটা জনজাতির মাধ্যে এক চাংপা ছাড়া বাকি সব জনজাতিই কোনো না কোনো টোকপোর ধারে চাষের জমি চৌরস করে, গাছ লাগিয়ে, ঘর বানিয়ে, গবাদি পশু পালন করে বিভিন্ন ছোটো বড়ো গ্রামের পত্তন করেছে। চাষের কাজ, উল এবং চামড়া সংগ্রহ, ভার বহন, দুধ এবং মাংসের যোগান, বর্জ্য থেকে সার উৎপাদন এসব কাজের জন্য কিছু ইয়াক, জো, ঘোড়া, গাধা, ভেড়া, ছাগল এসব গৃহপালিত জন্তু সব গ্রামীণ লাদাখি পরিবারেই কিছু না কিছু সম্বল থাকলেও পূর্ব লাদাখের চাংথাং চারণভূমির চাংপা জনজাতিরা শুধুমাত্র পশুপালন করেই জীবন চালায়। এরা চাষও করে না, ঘরও বানায় না — আবহাওয়া এবং তৃণভূমিতে ঘাস ও জলের যোগানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এরা বছরে আট-দশবার স্থান পরিবর্তন করে, প্রতি জায়গায় দেড়-দু মাস করে থাকে। এদের কোন ব্যক্তিগত জমি বা গৃহের মালিকানা নেই, এদের আছে গোষ্ঠীর চারণভূমির অধিকার। পাঁচ-ছটা পরিবার একসঙ্গে থাকে। নিজেদের পালিত ইয়াকের গা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া শক্ত লম্বা লম্বা লোম বা ৎসিপা দিয়ে মোটা সুতো পাকিয়ে তা থেকে নিজেদেরই বানানো কাপড় সেলাই করে তৈরি তাঁবু, রেবো-তে থাকে, ছাগল ভেড়া চড়ায়, ছুরপি-ছাং খায়, কোপোং বাজায় আর জাব্রো নাচ নাচে।
লাদাখে মশলার ব্যবহার কম, আগেই বলেছি। এখানকার সব জনজাতিই মশলা বলতে চিরকাল ব্যবহার করে এসেছে কোজিনিয়াৎ আর কোৎসে। সাধারণ মুদির দোকানে কোজিনিয়াৎ মেলে না। লেহ-র মেইন মার্কেট থেকে মোতি মার্কেট যাওয়ার স্বল্প দুরত্বে রাস্তার ডানধারে রোজই বসে “আরিয়ান নোমাড মার্কেট”। বিক্রেতারা অধিকাংশই মহিলা। আর্যসুলভ টিকালো নাক, নীল চোখ আর সরু সরু অনেকগুলো বিনুনি বাঁধা লালচে চুলের দশ-বারোজন মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়া দোকানিরা সেখানে সারাদিন আরিয়ান ভ্যালীতে উৎপন্ন বিভিন্ন প্রাকৃতিক জিনিষ কেনাবেচা করেন। অস্থায়ী ছাউনির এই বাজারটির চরিত্র অন্তত চারশো বছরের পুরনো। এখানেই খোলা পাথরের পাত্রে বিক্রি হয় কোজিনিয়াৎ আর শুকনো কোৎসে। ছাগলের চামড়ার আবরণে মুড়ে রাখা থাকে চমরী গাইএর দুধ থেকে তৈরি মাখন, কাঁচের পাত্রে থাকে ছুরপি। টিনের পাত্রে রাখা থাকে খোসা ছাড়ানো বাকহুইটের টাটকা আটা। ছোট্ট কাঁচের পাত্রে জাফরান, শিলাজতু। শুকনো মেওয়ার জন্যে অবশ্য দোকান আলাদা, তবে সব দোকানেই অঢেল মেলে শুকনো খুরমানি, খুরমানির বাদাম আর খুরমানি তেল।
কোজিনিয়াৎ এক রকমের পাহাড়ি জিরে। সমতলে অনাঘ্রাত অনাস্বাদিত এই ভেষজ লাদাখেও চাষ করে উৎপাদন করা যায় না। দুস্তর জানস্কর পর্বতমালার আনাচে কানাচে জন্মায় এই গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। পাহাড়ে ইয়াক চড়াতে যাওয়া পশুপালকেরা হেমন্তের শুরুতে খুঁজে আনেন এই দুর্লভ এবং বহুমূল্য মশলা। সেই তুলনায় অবশ্য কোৎসে সহজলভ্য। বাড়ির আনাচ কানাচে জন্মায় এই জংলি পেঁয়াজের গাছ। পেঁয়াজের পাতা, কাণ্ড এবং মূল তুলে নিয়ে পাথরের পাটায় অল্প ছাগচর্বি দিয়ে পিষতে হয়, এক সময়ে চর্বির সঙ্গে কোৎসে পাতাবাটা মিশে গিয়ে একটি অসমসত্ত্ব মণ্ড তৈরী হয়, তাই দিয়ে ছোট ছোট বড়ি বানিয়ে, ভাল করে শুকিয়ে রেখে সম্বৎসর লাদাখী গৃহিণীরা ব্যবহার করেন। প্রবল শীতে শরীরকে উষ্ণতা যোগাতে এই সব মশলা অনবদ্য। তেলের অপ্রতুলতা হেতু ব্যবহৃত হয় ছাগলের চর্বি ও মাখন। পিতলের হাতার গোলাকার তলদেশ আগুনে গরম করে তাতে একটু চর্বি বা মাখন নিয়ে তার মধ্যে কোৎসে অল্প ভেজে মাংস বা সব্জীর স্যুপের মধ্যে দেওয়া হয়। কোজিনিয়াৎ ব্যবহার হয় বাকহুইটের আটা দিয়ে বানানো পিঠে: তেনতেন আর খিসির তৈরির মিশ্রণে। তবে কোজিনিয়াৎ দিলে সে রান্নায় আর অন্য মশলা দেওয়া যায় না, এতই তীব্র এর গন্ধ।
২
আজ থেকে চারশো বছর আগে পর্তুগীজ জ্যেসুইট ধর্মপ্রচারক ফ্রান্সিসকো ডি অ্যাজিভেডো গুগে প্রদেশের খ্রিস্টধর্মীদের প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এসে পৌঁছুছিলেন লেহ শহরে। লেহতে আসার পর দিনই রাজসভায় ডাক পড়ে অ্যাজিভেডোর। সুদূর ভারতভূমি ও পর্তুগাল থেকে তাঁর জন্য কী উপহার এসেছে তা জানবার জন্যে রাজা সেঙ্গে নামগিয়্যালের খুবই আগ্রহ ছিল।
সেঙ্গের বাবা জামিয়াং নামগিয়্যাল চিকতানের সুলতানের সঙ্গে মিলে বালটিস্তানের স্কার্দু-র কাছে খাপলু অঞ্চল আক্রমণ করেছিলেন রাজ্য বিস্তারের স্বাভাবিক প্রণোদনায়। ফেব্রয়ারীর বদলে দু-মাস আগে অকাল লোসার পালন করে ডিসেম্বরের ঠান্ডায় যুদ্ধযাত্রা করেন জামিয়াং। খালৎসী পেরিয়ে লামায়রু থেকে পুরিগের দিকে যাওয়ার সময় ফোতু-লা গিরিপথের কাছে প্রবল তুষারঝড়ে লাদাখি সেনাবাহিনী দিকভুল করে আটকে পড়ে। এখনকার দিনে ফোতুলা-র চওড়া সুন্দর রাস্তা দেখে সেই ভুলভুলাইয়া বোঝাও না গেলেও রাস্তার পাশের ভূপ্রকৃতি একটু নজর করে দেখলেই তা মালুম হয়। সুযোগ বুঝে খাপলুর চতুর এবং সমরকুশল মাগস্পন আলি মীর বন্দী করেন জামিয়াং নামগিয়্যালকে। ওদিকে রাজধানী লেহ তখন অরক্ষিত। আলি মীরের নেতৃত্বে বালটিরা লেহ দখল করে বিজিত জাতির উপর যত রকম নির্যাতন করা যায় নির্বিচারে তা সবই চালিয়েছিল। বৌদ্ধবিহার ভেঙে, মুর্তি ভেঙে, পুঁথি ছিঁড়ে, লোকজনকে হত্যা করে নরক গুলজার। লেহতে এই অভিযান চালাবার সময় আলি মীর তাঁর রাজ্যশাসনের ভার দিয়ে এসেছিলেন কনিষ্ঠা কন্যা গ্যাল খাতুনকে, কিন্তু তিনি রাজপাট সামলাতে সামলাতেই যুদ্ধবন্দী জামিয়াংকে মন দিয়ে ফেলেন। এই গ্যালের বড়বোনের আবার শাদি হয়েছিল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। গ্যাল খাতুন অবশ্য এঁর আসল নাম নয়, আধা তিব্বতি, আধা বালটি নামের এই রাজ্ঞী হয়তো লাদাখী লোকসঙ্গীতের ‘সিলিমা খাতুন’। সে যাই হোক, কনিষ্ঠা কন্যা এমন বিধর্মী অপাত্রে মন দেবার কারণে আলি মীরের মনের অবস্থা কী হয়েছিল সেইটে বলা মুশকিল। কিন্তু বিভ্রাট নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল, তাই রাতারাতিই বিয়ে হয়ে গেলো জামিয়াং আর গ্যালের।
গ্যাল খাতুন অপূর্ব সুন্দরী হলেও, প্রেমটেম হলেও এই বিয়েতে জামিয়াং খুব একটা রাজি ছিলেন না। প্রথমত তখনও তিনি যুদ্ধবন্দী, আর তাছাড়া বিয়ের শর্ত হিসেবে আলি মীর জামিয়াংকে সত্যবদ্ধ করেছিলেন যে জামিয়াং তাঁর আগের পক্ষের বউ ও ছেলেদের ত্যাগ দেবেন, গ্যাল খাতুনই হবেন তাঁর একেশ্বরী, গ্যাল খাতুন আর জামিয়াং এর সন্তানরা সকলেই মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করবেন। বিয়ের পর পরই এক মস্ত ভোজসভা ডেকে আলি মীর ঘোষনা করলেন যে তিনি রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন পেয়েছেন যে সিন্ধু নদ থেকে একটি তেজস্বী সিংহ লাফিয়ে উঠে গ্যাল খাতুনের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে – এর পরই গ্যাল খাতুন সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। এই যে সিংহবিক্রম পুত্র জন্মাবে গ্যাল খাতুনের, তার নামও হবে সিংহ বা সেঙ্গে নামগিয়্যাল, সেই হবে ভবিষ্যৎ লাদাখের রাজা। এইসব ঘোষণা করে আলি মীর পশ্চিম তিব্বতের রাজ্যটুকু ফিরিয়ে দিলেন জামাই নামগ্যিয়ালকে। পশ্চিম তিব্বতের নামগিয়্যাল বংশের যে শাসন অবসান হয়েছে মনে হয়েছিল, তা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। বিধর্মী দুয়োরানীকে নিয়ে যে ততো গণ্ডগোল হলো না, তার জন্য অবশ্য লামাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। অনেক উপহার উপঢৌকন পেয়ে তাঁরাও ঘোষনা করে দেন যে গ্যাল খাতুন আসলে তিব্বতি দেবী শ্বেত তারার মানুষী দেহ। মুসলমান কন্যার দেহে যদি তারাদেবী জন্মান, কারও কিছু করবার তো নেই। এর বহু আগে ভূটানের রাণীও এইভাবেই হরিৎবর্ণ তারা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছিলেন। যুগে যুগে দেশে দেশে দেবতার বা আইডলের জন্ম তো এভাবেই হয়ে থাকে।
এক হিসেবে দেখতে গেলে সেঙ্গে হলেন শাহ–জাহানের দূর সম্পর্কের মাসতুতো ভাই। মাসির না হোক, মেসোর ছেলে তো বটেই। সেঙ্গে নামগিয়্যালের হবার কথা ছিল মুসলমান। কিন্তু তিনি ইতিহাসে বেঁচে রইলেন বৌদ্ধরাজাদের সাম্রাজ্যটিকে রক্ষা করবার জন্যে। যাঁর জন্মের গল্পের সঙ্গে কপিলাবস্তুর রাজপুত্রটির এতো মিল, তিনি যে বড় হয়ে বৌদ্ধধর্মের জন্যে ক্রুসেড লড়বেন এ আর বলে দিতে হয় না। তবে সেঙ্গে নামগিয়্যাল ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, এ বাবদে তিনি তাঁর নামের সুনাম পুরোপুরিভাবে রক্ষা করেছিলেন।
সে যাই হোক, বাংলার মসলিন, সোনা, হাতির দাঁত, চন্দন কাঠ ইত্যাদি নানাবিধ উপহার নিয়ে সেঙ্গে নামগ্যিয়ালের রাজসভায় অ্যাজিভেডো উপস্থিত হলেন। সেই সাক্ষাৎকারের একটি মনোগ্রাহী বর্ণনাও অ্যাজিভেডো তাঁর রোজনামচায় লিখে গেছেন। রাজা ছিলেন দীর্ঘদেহী, তামাটে গাত্রবর্ণ, রাগী চোখ, চওড়া নাক, পুরু ঠোঁট। অ্যাজিভেডোর মতে রাজার চেহারা ছিল খানিকটা জাভান নৃগোষ্ঠীর ধরণের। রাজার উর্ধাঙ্গে ছিল ময়লা লাল কম্বলের কাপড়ের অঙ্গাবরণ, একই কাপড়ের অধোবাস, মাথায় একটা পুরনো পশমের টুপি। কাঁধের উপরে ঝুলে পড়েছে বিনুনী পাকানো কালো চুলের গুচ্ছ। এককানে বড় প্রবালের দুল, আর এককানে ফিরোজা পাথরের। বুকের উপর ছিল মৃত শত্রুদের করোটি দিয়ে গাঁথা মালা, যা দেখে অ্যাজিভেডোর মনে হয়েছিল রাজা তো নয় স্বয়ং মৃত্যুদেবতার থানে তাঁর মুণ্ডপাত করতে আনা হয়েছে। একটা মান্ধাতার আমলের টকটকে লাল কারুকাজকরা পশমিনা গালিচার উপর পদ্মাসনে বসে ছিলেন সেঙ্গে নামগ্যিয়াল। রাজার পাশেই বসেছিলেন রানী স্কাল-জাং-গ্রোল-মা, তিনিও রাজার মতোই সমান ভীতিপ্রদ, মুণ্ডমালাধারিণী। কিন্তু নারীসুলভ মায়াদয়া অবশ্যই তাঁর ছিল, তাঁরই উদ্যোগে অ্যাজিভেডোকে সম্মান জানিয়ে রাজসভায় সাধারণের প্রাপ্য মাখন আর নুন দেওয়া তাতার চায়ের বদলে চীনে পদ্ধতিতে চা দেওয়া হয়েছিল। এই চা খেতে খেতেই অ্যাজিভেডো বুঝলেন যে তাঁর দৌত্যকার্য নেহাৎ বিফলে যায়নি। গুগে প্রদেশের খ্রিস্টধর্মীদের উদ্ধারপ্রকল্প নিয়ে প্রস্তাবনা সাঙ্গ হলে রাজা অ্যাজিভেডোকে উপহার দিয়েছিলেন খানিকটা উৎকৃষ্ট কাঁচা ছাগ-মাংস আর এক ঝুড়ি খোসা ছাড়ানো যব।
৩
কাঁচা মাংস অ্যাজিভেডোকে রাজার সামনেই গলাধঃকরণ করতে হয়েছিল কি না, সে নিয়ে তিনি বিশেষ বাগবিস্তার করেননি। আমরাও বলি, কার্যকালে এমন ঘটনা চেপে যাওয়াই শ্রেয়। ফরাসী নৃতাত্বিক সমাজবিজ্ঞানী ক্লদ লেভি স্ত্রাউস একদা বলেছিলেন, কোন্ খাবার মানুষ খেতে পছন্দ করে এবং কেমন করে রান্না করে, তার পিছনের মূল কারণটি হল তার সংস্কৃতি। তিনি এও বলেন রন্ধন পদ্ধতিই বলে দেবে খাবারটি প্রকৃতির কাছাকাছি, না সংস্কৃতির। স্ত্রাউস সাহেবের মতে সেদ্ধ করা খাবার সাংস্কৃতিক, কারণ সেদ্ধ করে খেতে খাদ্য আর আগুনের মাঝে থাকে পাত্র ও জল। সে তুলনায় ঝলসানো খাবার প্রাকৃতিক , কারণ আগুন আর খাদ্যের মাঝে কেহ নাই, কোনও বাধা নাহি ভুবনে। সে কারণেই অতিথিদের, ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে আগত মানুষদের রোস্ট দেওয়া হয়, আর সেদ্ধ করা খাবার দেওয়া হয় আত্মীয়স্বজনকে, যারা স্ব-সংস্কৃতির অংশ। এই ব্যাখ্যার শেষেই স্ত্রাউস সাহেব আরও বলেছেন এই সংস্কৃতি আর প্রকৃতির কারণেই নরমাংসভোজী জাতিরা যখন নিজের গোষ্ঠীর লোককে খায়, তাঁদের সেদ্ধ করে নেয়, আর বিদেশীদের খাবার সময় ঝলসে খায়।
কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর লেহ-তে কোথায় আর সেই সিংহহৃদয় রাজা যিনি বিদেশী অতিথিকে ছাগমাংস উপহার দেন। সেই সেঙ্গেও নেই, কোভিডের দরুণ সেই লাদাখও আর নেই। বহুদিন ধরে ভাল মাটন খাওয়ার জন্য মনটা উচাটন হয়ে ছিলো। লাদাখি পশমিনা ছাগল তার লোমের জন্য যত বিখ্যাত, মাংসের জন্যে ততোটা নয়। এদের থেকে ভাল উল পাওয়া গেলেও পাহড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো আর শুকনো ঘাস খাওয়ার জন্য এদের মাংস দড়ি পাকানো শক্ত ছিবড়ে, তার উপরে বোঁটকা গন্ধ, স্বাদও সেরকম আহামরি কিছু নয়। আর ভেড়ার মাংস তো একেবারেই স্বাদহীন। লাদাখে ভাল মাটনের জন্য ছাগল আসে শ্রীনগর থেকে। কাশ্মীর উপত্যকা এবং পাহাড়ের সবুজ চারণভূমির পোষ্য নধর আফগানি ছাগল, তার সুস্বাদু রেওয়াজি নরম চর্বিওয়ালা টাটকা মাংস, তার জাইকা-ই আলাদা। পরশুরামের গল্পে কামাখ্যার “গ্রাম-ফেড মটন” ও স্বাদে ফেল। এদিকে গোটা শীতকাল জুড়ে জোজিলা ছিল বন্ধ, তাই টাটকা মাটন পাওয়াই যায় নি। এপ্রিল মাসে রাস্তা খুললেও এতদিন চলছিল কোভিড লকডাউন। অবশেষে সেই সব পেরিয়ে কোভিড রুটিন মেনে ইদানিং মহল্লায় মহল্লায় পাঁঠার দোকান খুলছে। খানিক অপেক্ষার পর মকবুল মিয়াঁর দোকান থেকে পাওয়াও যাচ্ছে প্রার্থিত অমৃত। কাশ্মীরি মাটনের কাট কাশ্মীরি শিল্পীই ভালো করে নামাতে পারবেন।
লাদাখের ঠান্ডা এবং শুকনো আবহাওয়ায় কাঁচা মাংসও ভাল থাকে অনেকক্ষণ। সামনের রাং থেকে নেওয়া বড় বড় টুকরো করে কাটা কিলোটাক মাংসে দিতে হবে নুন মিশিয়ে ফেটানো দই, জাফরান আর পেস্তা-আখরোট-অ্যামন্ড-খুরমানি বাটা। অনেকটা পরিমান গাওয়া ঘি-তে তেজপাতা, বীজ ছাড়ানো কাশ্মীরি লাল মির্চ দেওয়ার পর কুচোন পেঁয়াজ দিয়ে নরম করে ভেজে নিতে হবে। রসুন আর আদা থেঁতো করে মেশাতে হবে পরিমাণমত। গুঁড়ো মশলা এখানে ব্রাত্য, মশলা যা দিতে মন চায় শুকনো খোলায় ভেজে হামানদিস্তায় আধগুঁড়ো করে দিতে হবে। জল দেওয়াও মানা, ঘি ছাড়া অন্য তেলও বাদ। অল্প আঁচে ঘি আর চর্বিতে অনেকক্ষণ ধরে মজে মজে তয়ের হবে আফগানী গোস্ত, যা গত ছ’শো বছর ধরে আফগানিস্তান পেরিয়ে গিলগিট স্কার্দু হয়ে লাদাখি রান্না ঘরে ঢুকে পড়েছে। এর সঙ্গে দিব্য চলবে যবের আটায় বানানো নরম মোটা খামির রুটি।
অসাধারণ লেখা। ক্রমশই প্রত্যাশা বাড়ছে।