খড়কুটোর জীবন : পেট নাদুরের প্রতিবেদন । পর্ব ৭ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
ছোটো থেকেই আমি পেট নাদুরে। খিদে পেলেই মায়ের আঁচল ধরে রান্না ঘরে ধরে নিয়ে যেতাম। খাবার বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু পছন্দ ছিলো না। এজমালি পরিবারে যা হতো তাই খেতাম। তবে জ্বর-জারি হলে সাগু, বার্লি, দুধ, পাঁউরুটি একটু জুটে যেতো। কাকারা কলেজ ফেরার পথে নিয়ে আসতো টক-ঝাল সল্টেড লজেন্স। মরসুম বিশেষ কমলা বা আঙুর পেতাম।
গ্রামের পথে হেঁকে যেতো নানান খাবার নিয়ে ফেরিওয়ালার দল। সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাক্স ভরে অনেকেই আনতেন আইসক্রিম। সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে বাঁধা থাকতো চোঙা। মেসিন আর ব্যাটারী মাঝের রডে চটের থলেতে। মাঝে মাঝে মাইক্রোফোনে ঘোষণা – ‘আপনাদের মাঝে চলে এসেছে চাপড়ার সুবিখ্যাত মল্লিক কোম্পানির আইসক্রিম। জলমালাই , নারকেল মালাই, পেপসি, বেলমালাই নিয়ে যান খুবই অল্প দামে। ও দাদা, ও বৌদি আপনার ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিন। শুধু পয়সা নয়, টিন ভাঙা, লোহা ভাঙা, প্লাস্টিকের বা চাল, গমের বদলে নিয়ে যান এই গরমের বন্ধুকে। প্রাণ শীতল হয়ে যাবে।’ ঘোষণা শেষে বাজতো প্রচলিত গান। কখনো ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’ বা ‘ও পুলিশ তোমার হাতকড়াটা পড়াও আমার হাতে’ বা ‘হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া, মুজকো মিলা দো’ — নানান গান। আমরা ছুটতাম সেই সাইকেলের পিছনে পিছনে। মাঝে মাঝে পয়সার জন্য মায়ের কাছে কান্নাকাটি। অবশেষে চোখের জল আর জলমালাইয়ের মধুর মিলন। স্যাকারিন-এর মিষ্টি স্বাদে স্বাদকোরকের পরিতৃপ্তি। লাল, সাদা, হলুদ, সবুজের সেই কাঠি লাগানো বরফ চুষে চুষে জিভ হয়ে যেতো বর্ণিল। স্কুলে গিয়ে কতদিন বন্ধুরা চুষেছি একই বরফ। জাতপাত, রোগবালাই সেই আনন্দ স্বাদে কোথায় দূর হয়ে যেতো। হাইস্কুলে পড়তাম যখন স্কুলের গেটের দু’দিকে আইস্ক্রিম বেচতো শরিফদা আর পচাদা। তাদের কাছে মিলতো কুলফি বা প্লাস্টিকের প্যাকেটে রঙিন বরফ জল। এখন কত ব্রান্ডের আইসক্রিম। আমূল, বাসকিন রবিন্স, কোয়ালিটি, ওয়ালস, ক্রিম বেল, মাদার ডেয়ারি – কত না তার নাম। পৃথিবী জুড়ে কত না বিখ্যাত আইসক্রিম পার্লার। কেপটাউনের দ্য ক্রিমারি, স্যান ফ্রান্সিস্কোর হামফ্রে স্লোকাম্ব আইসক্রিম, সাওপাওলোর ভিপিটেনো জেলাতেরিয়া — কত না নাম। কিন্তু বাল্যের সেই বরফ কাঠি আজো আমার কাছে শীতল বিলাসের শ্রেষ্ঠ উপাদান।
কাচ লাগানো টিনের বাক্সে আসতো তিলেখাজা। তিল, দুধ আর গুড় বা চিনির সেই মিশ্রণ মুখে ফেললেই ঘটতো স্বাদের বিস্ফোরণ। চোখ বুজে কিছুটা চর্বণ আর কিছুটা চোষণ। সারা শরীরে বয়ে যেতো আনন্দ শিহরণ। খাজাওয়ালা ভেঁপু বাজাতেন আর হাঁকতেন – ‘তিলেখাজা দারুণ মজা / খেলে পরে ছেলে-বুড়ো হবে তাজা।’ এই তিলেখাজা নিয়ে প্রচলিত গান —
‘হায় রে মজার তিলের খাজা খেয়ে দেখলি না মন কেমন মজা;
লালন কয়, বেজাতের রাজা হয়ে রইলাম এ ভুবনে,
ভাবলি নে মন কোথা সে জন ভাজলি বেগুন পরের তেলে,
গুনে পড়ে সারলি দফা করলি রফা গোলেমালে।’
— লালনের নামে চললেও এগান আসলে পরবর্তী সময়ের কোনো অখ্যাত গায়কের রচনা। কিন্তু তিলেখাজার এমন স্তূতি সত্যই অপূর্ব।
বড়ো পলিপ্যাকে আসতো দিলখুশ পাঁপড় ভাজা। আইসক্রিমের মতো মাইক বাজিয়ে চলতো বিকিকিনি। ধান, গম, চাল, পাট, বিভিন্ন ভাঙাচোরায় ভরে উঠতো ফেরিওয়ালার সাইকেলের ক্যারিয়ারের দু’দিকে বাঁধা বাঁশের ঝাঁকা। মাইকে ঘোষণা হতো – ‘আপনাদের মাঝে চলে এসেছে বাদকুল্লার সুবিখ্যাত দিলখুশ পাঁপড় ভাজা। তাড়াতাড়ি চলে আসুন। চলে গেলে আর পাবেননা।’
আসতো শোভন পাপড়ি। লোকনিরুক্তিতে যা শোনপাপড়ি। জনৈক কবি মজা করে লিখেছিলেন —
‘বরফি মিঠে, জিলাবি মিঠে, মিঠে শোনপাপড়ি,
তাহার অধিক মিঠে কন্যা, কোমল হাতের চাপড়ি।’
এই শোনপাপড়ি মুখে দিলেই মিষ্টি স্বাদ দিয়ে মিলিয়ে যেতো। মফস্বলে অনেক শোনপাপড়ি কারখানা ছিলো। সেখানে শোনপাপড়ি তৈরি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। প্রথমে বেসন আর ময়দার মিশ্রণ বড়ো কড়াইতে ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া হয় । তারপর চিনি, জল আর দুধ মিশিয়ে সিরাপ বানিয়ে ময়দা ও বেসনের মিশ্রণটা মিশিয়ে কাঠের পাটায় নাড়াচাড়া করে ফুলিয়ে নিয়ে পিস পিস করে কেটে নেওয়া হয়। আমরা শোনপাপড়িকে বলতাম ফেসো।
লাঠির মাথায় পলিথিন জড়ানো চিট লজেন্স নিয়ে আসতো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। আঠালো সেই লজেন্স টেনে টেনে তিনি বানিয়ে দিতেন ফুল, পাখি, বাইক, ঘড়ি। চুষে চুষে সেই ঘড়ি খেয়ে দম নিতাম। ভদ্রলোকের হাতে থাকতো ঘণ্টা।
লক্ষী দিদিমণির অঙ্গনওয়ারী স্কুলে পড়তাম যখন ফেরার সময় পেতাম ভুট্টা গুঁড়োর লাড্ডু। দুই হাতে দুই লাড্ডু নিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। প্রাথমিক স্কুলে দেওয়া হতো পিস করা পাঁউরুটি। বাড়ি নিয়ে এসে দুধ দিয়ে ভিজিয়ে খেতাম। তখন তো আর মিড ডে মিল ছিলোনা। বাড়ি থেকে নিয়ে যেতাম মুড়ি বা চাল ভাজা। মুড়িকে অনেকেই বলতো ভুজো। সেই ভুজো বন্ধুরা ভাগ করে খেতাম। একদিন বন্ধু ফকির হালসানা নিয়ে এলো কাটখোলায় ভাজা মুড়ি। যা বানানো হতো কড়াইতে চাল নেড়ে নিয়ে। সেই খাবার পাতে ছিলোনা কোনো জাতপাত। অনেকেই বাড়ি থেকে নিয়ে আসতো পেয়ারা, কুল, চালতা বা পাকা পেঁপে। কাঁচা-মিঠে আম থাকতো প্রায় সবার প্যান্টের পকেটে। আম ছাড়ানোর জন্য থাকতো ঝিনুক ঘষে বানানো বিশেষ অস্ত্র। লঙ্কা আর লবণ বেটে বানিয়ে আনা হতো বিশেষ মশলা। কাঁচা আমের সঙ্গে নুন-ঝাল মশলা সঙ্গে হুসহাস শব্দে জমে উঠতো গ্রীষ্মের দুপুর। টিফিনে কেনা হতো তরমুজ, শাক-আলু বা ফুটি কাকড়। আখওয়ালা বট গাছের গায়ে হেলিয়ে রাখতো আখের বোঝা। বোঝা থেকে টেনে টেনে হাঁসুয়া দিয়ে পিস করে দিতো গোটা আখ।
গ্রামের মুদি দোকানগুলো ছিলো আমার ফুড সাফারির কেন্দ্রভূমি। কানমোড়া, প্রজাপতি, লেড়ো, বাকড়, লম্বু, হরলিক্স — নানান কিসিমের বিস্কুট খাওয়ার চল ছিলো। পাঁচ আনা পিস একধরনের গোল বিস্কুট কিনতাম প্রচুর। এক টাকার কিনলে পুরো বন্ধু মহলের মুখ রক্ষা হয়ে যেতো। মারি বিস্কুট খেতাম চায়ে ডুবিয়ে। যতই বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইন হোক – ‘আপনার মারি যে চায়ে ডুবে গেলো।’ লেবুর কোয়ার আকারের লেবু লজেন্স, কাঠি লজেন্স, মাছ লজেন্স, টিকটিকি লজেন্স, হজমি গুলি, মুখ লাল, রাংতায় মোড়ানো আচার — লালা ঝরানো কত না উপাদান। চর্বণ এবং চোষণ পূর্বক অমৃতরস গলধঃকরণ হতো। আর একটা আকর্ষণ ছিলো আমূল দুধের গুঁড়ো। চেটে চেটে খাওয়া এবং স্বপ্ন দেখা বড়ো হয়ে অনেক অনেক দুধ কিনে খাবো।
আমাদের হাইস্কুলের সামনে এক দাদু বিক্রি করতো মটর সিদ্ধ মাখা। সিদ্ধ মটরের সঙ্গে পেঁয়াজ-লঙ্কা কুচি, সর্ষের তেল, লবণ আর চানাচুর এর মিশ্রণে তৈরি হতো জিভে জল আনা কাগজের মোড়কে সে উত্তম আহার। মুড়ির সঙ্গেও আমরা সেটা মেখে খেতাম। ন্যাঙা দা বিক্রি করতেন ঝালমুড়ি, সঙ্গে বাপুজি কেক, পাঁউরুটি, কলা, লাড্ডু, ঘুগনি । মাঝে মাঝে বিলিতি আমড়া বা পেয়ারা। সে আমড়া অনেক সময় কাসুন্দি দিয়ে মাখা। আজ কতদিন হয়ে গেছে সব। রসনা বিলাসে কতই না খাণ্ডব দহন হলো। তবু পুরনো সে কাসুন্দি আজো চাখতে ইচ্ছে করে ঘেঁটে যাওয়া জীবনে।
(ক্রমশ)