কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ১০। শোভন সরকার

0
গত পর্বে : দেখা গেল বেনারসের দাঙ্গার পেছনে ধর্ম কেবল এক হাতিয়ার হয়ে উঠল রাজনীতির। ধীরে ধীরে বেনারসের নানাবিধ রঙের সমাবেশকে ফিকে করে তোলার অপচেষ্টা শুরু হল। 

এই লাট ভৈরব স্তম্ভ ইতিহাসের এক অত্যাশ্চর্য  সাক্ষী — সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজও এই লাট ভৈরব স্তম্ভ কাশীর বুকে দণ্ডায়মান। কিন্তু এই স্তম্ভটি এলো কোথা থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর বহুকাল ধরেই খুঁজে এসেছেন গবেষক ও ঐতিহাসিকেরা। তাঁদের অনেকেই দাবি করেন এই স্তম্ভ প্রকৃতপক্ষে এক অশোকস্তম্ভ। এর স্বপক্ষে তাঁরা নানাবিধ যুক্তি তুলে ধরেন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে গেলে কাশীতে এরকম এক স্তম্ভের কথা বেশ কিছু পর্যটকের বিবরণে পাওয়া যায়। প্রাচীনতম বিবরণ খুঁজে পাই খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের শুরুর দশকে ভারতবর্ষে আসা পর্যটক ফা-হিয়েনের লেখায়। তিনি এই স্তম্ভকের ঔজ্জ্বল্য লাপিস লাজুলাই-এর মত গাঢ় নীল বর্ণের রত্নের দীপ্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এরপর হিউয়েন সাং ভারতবর্ষ ভ্রমণে আসেন খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে। তিনি বলেন এই স্তম্ভ এত উজ্জ্বল, চকচকে দেখতে ছিল যে তা দেখে তাঁর বরফের স্তম্ভ বলে ভুল হয়েছিল। এর পরের বর্ণনা পাওয়া যায় জঁ-বাতিস্তা টেভার্নিয়েরের লেখায়।   

ইংরেজ মিশনারি শেরিং ঊনবিংশ শতকের ষাটের দশকে বেনারসে আসেন। তিনি এই লাট ভৈরব স্তম্ভকে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি মনে করেন, এই স্তম্ভটি প্রকৃতপক্ষে সম্রাট অশোকের তৈরি। তিনি চেষ্টা করেছিলেন উপরের তামার আবরণ সরিয়ে যদি মূল স্তম্ভটি দর্শনের অনুমতি পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি সেই অনুমতি পাননি। তবুও তাঁর ধারণার স্বপক্ষে তিনি যা বলেন তা অনেকটা এরকম — এক, টেভার্ণিয়ের এর বর্ণনা অনুযায়ী এই স্তম্ভের গায়ে প্রাচীন লিপিতে নানাবিধ লেখালেখি আছে। সেই বর্ণনার সঙ্গে আশোকস্তম্ভের অনেক মিল রয়েছে। দুই, অন্যান্য অশোকস্তম্ভের মত এটিও বেলেপাথরে তৈরি; সেই কারণেই দাঙ্গার সময় এতে যখন আগুন ধরানো হয়, এটি ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তিন, আশেপাশে উপস্থিত বিভিন্ন প্রাচীন খোদাইয়ের নমুনার উপস্থিতি দেখে তিনি মনে করেন এই এলাকায় পূর্বে বেশ কিছু বড়সড় বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শন ছিল।

অন্যদিকে, জন আরউইন দাবি করেন এই স্তম্ভ প্রকৃত পক্ষে অশোকের সময়েরও আগে তৈরি। তাঁর যুক্তির ভিত্তি ছিল এই স্তম্ভের ক্রমনিমজ্জন তত্ত্বের উপর। তিনি জানান যে সম্রাট অশোক তথা মৌর্য যুগের আগে যে সমস্ত স্তম্ভ নির্মিত হয় সেগুলো জলাভূমির আশেপাশের নরম মাটিতে বিনা ভিত্তি-প্রস্তরেই প্রোথিত ছিল। কাজেই ধীরে ধীরে এই স্তম্ভের মাটির নিচে নিমজ্জন হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এর থেকেই তিনি মনে করেন এই স্তম্ভের বয়স সম্রাট অশোকের সময়েরও অধিক। 

   রিচার্ড ল্যানয় বিশ্বাস করেন যে কাশীতে স্তম্ভ উপাসনার চল বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। লাট ভৈরব এমনই এক স্তম্ভ। বিভিন্ন পৌরাণিক ইতিহাসের তুলনা করলে অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। এই ধরণের স্তম্ভকে মহাজাগতিক অক্ষ (cosmic axix) বা অক্ষদণ্ড (axix mundi) হিসেবে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম বা ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাশীতে একেই বলা হচ্ছে জ্যোতির্লিঙ্গ। সম্রাট অশোক তাঁর ধর্মপ্রবর্তনের জন্য স্থাপন করছেন স্তম্ভ। আরউইন বলছেন, বিভিন্ন সময় যে সকল মুসলিম শাসকগণ ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন তাঁরা আগে থেকেই এই প্রাচীন স্তম্ভ উপাসকদের (‘pillar-cult’) কথা জানতেন। তাঁরা মূর্তি-পূজা বিরোধী হলেও মহাজাগতিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে এই স্তম্ভের কথা বিশ্বাস করতেন। তাই আরউইনের ধারণা, এরূপ বিশ্বাস থেকেই মুসলিম শাসকেরা এই ধরণের স্তম্ভকে ধ্বংস করার বদলে একে নিজেদের উপাসনাস্থলের তথা অস্তিত্বের অঙ্গীভূত করে নেয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে এই ধরণের বিশ্বাসেরই এক ফল দিল্লীর কুতুব মিনার।

 

লাট ভৈরবকে ঘিরে ঐক্যের নিদর্শন পাই আমরা লাট ভৈরব বিবাহ উৎসবে। সেও এক মজার ব্যাপার। ‘মৌজ-মস্তি’, ‘ফক্করপন’ তো বেনারসের মানুষের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সমস্ত বিরূপতার, ছক ভাঙার, ভিন্নতার, অদ্ভুতত্বের  মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকেও জীবনের সম্পূর্ণ আনন্দ-রস উপভোগে তারা মশগুল। বেনারসের সংস্কৃতিতে লাট ভৈরবের বিবাহ তাই যা কিছু ছোট, সংকীর্ণ, সীমাবদ্ধকারী তা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসে হয়ে ওঠে কাশীর মানুষের উৎসব। 

প্রতি বছর ভাদ্র পূর্ণিমায় পিতৃপক্ষ শুরুর ‘অশুভ’ লগ্নে বিবাহ হয় লাট ভৈরবের। এখানেও তাঁর ছক ভাঙার নিদর্শন। কিন্তু এই বিবাহের উৎসব ঠিক কবে থেকে এইরূপে শুরু হল সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। খুব সম্ভবতঃ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই উৎসবের বর্তমান চেহারা দেখা যেতে শুরু করে।  

কিছু কিছু স্থানীয় মানুষদের মধ্যে একটা গল্প প্রচলিত আছে লাট ভৈরবের বিবাহ নিয়ে। দেবী শীতলার সাথে লাট ভৈরবের বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের ব্যস্ততা তুঙ্গে, সব কিছু প্রস্তুত। বিয়ের দিন সমস্ত বরযাত্রী বরসহ এসে যথাসময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে বিয়েবাড়ির প্রাঙ্গণে। বরযাত্রীর মধ্যে নিমন্ত্রিত অষ্টভৈরবের সবাই রয়েছে। বর নিজেও ভৈরব — রূপ তাদের রুদ্রসম, ভয়ঙ্কর। দেবী এদের সবাইকে দেখে চমকে উঠল — ভয় পেয়ে গেল। এতেই বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে ছুটে গিয়ে শীতলা দেবী সেই যে দোর দিল, বর ও বরযাত্রী হতাশ হয়ে ফিরে না যাওয়া অব্দি সেই দোর আর খোলা যায়নি। কাশীবাসী এই দুঃখের ঘটনা মনে করে প্রতি বছর লাট ভৈরবের বিয়ের উৎসবের মধ্যে দিয়ে। 

একই রকম ঘটনার অনুরণন দেখি গাজী মিয়াঁর অসম্পূর্ণ বিবাহের দুঃখের গল্পে। সেই প্রসঙ্গে উঠে আসে শহীদ গাজী মিয়াঁকে ঘিরে বেনারসের বুকে গাজী মিয়াঁর বিখ্যাত মেলার কথা। তবে এই ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব বেনারসের বিভিন্ন ছোট-বড় উৎসবের গল্প করতে গিয়ে।

যাই হোক, প্রচলিত লোককথা অনুসারে তো লাট ভৈরবের বিয়ে হল না। তবে কি তার বিয়ের উৎসবে কোন পাত্রী নেই? আছে। লাট ভৈরবের স্তম্ভের কাছেই উত্তর দিকে রয়েছে একটি কূপ — একে বলে ‘ভরত কূপ জননী’, বা কেবল ‘ভরত কূপ’। এই হল পাত্রী। লাল কাপড়ে কনের সাজে সাজানো হয় এইদিন এই কূপকে। সমস্ত চত্ত্বর সেজে ওঠে, গান বাজতে থাকে চিরাচরিত বেনারসি কায়দায়। অন্যদিকে, পাত্র লাট ভৈরব স্তম্ভকে সাজানো হয় হলুদ রঙের রেশমে। বিয়ে হবে আর ‘বারাত’ বেরোবেনা রাস্তায়, তা হয় নাকি? সে এক এলাহী ব্যাপার। লাট ভৈরো প্রবন্ধক সমিতির পৃষ্ঠপোষকতায় অষ্টধাতুর তৈরি লাট ভৈরবের এক মুখোশ তথা ‘মুকুট’কে সাজিয়ে তোলা হয় মন্দির সমিতির অছির বিশ্বেশ্বরগঞ্জে স্থিত বাড়ির সামনে। এই মুকুট খুব বেশি পুরোনো নয়। সজ্জা হলে বিকেল বেলায় লাট ভৈরবকে নিয়ে গিয়ে তোলা হয় রথের উপর। শুরু হয় সে এক অপূর্ব উদ্দাম শোভাযাত্রা। দলে দলে বাড়ির ছেলে-বুড়ো-মহিলারা এসে ভিড় করে দুল্‌হাকে নিজের হাতে বরণ করে নিতে, আশীর্বাদ চেয়ে নিতে। বিশ্বেশ্বরগঞ্জ থেকে সবার প্রথমে লাট ভৈরব চলেন তাঁর ‘ছোট ভাই’ কাল ভৈরবের মন্দিরে। মন্দিরের ভেতরে না ঢুকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে শোভাযাত্রা। সেখানেই কাল ভৈরবের পুরোহিত লাট ভৈরবকে বরণ করে, ভোগ নিবেদন করে। এখান থেকে শোভাযাত্রা যতনবার হয়ে বিশ্বেশ্বরগঞ্জ, তারপর পরপর কাজী মাণ্ডি, বালুবীর, হনুমান ফাটক, লাট ভৈরব বাজার, জালালিপুরা পেরিয়ে কপালমোচন ঘুরে অবশেষে লাট ভৈরবের মন্দিরে এসে পৌঁছায়। শোভাযাত্রার এক আধটু বর্ণনা না দিলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বেনারসের কোন বিয়ের উৎসবের থেকে এটা কোন অংশেই কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই অধিক উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ও রঙিন। কী নেই এই শোভাযাত্রায় — বহু মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এসে জুড়ে যায় এতে। নিজের বাড়ির বিয়ে যেন। অনেকগুলি বিশাল আকারের ডমরু নিয়ে বাজাতে থাকে এক দল বাদ্যকার — সে এক দেখবার ও শুনবার মত অভিজ্ঞতা বটে। সঙ্গে থাকে আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র, দলে দলে লোকের নাচ ও নানা কসরত, হরেক রকম আলো সঙ্গে করে নিয়ে এগিয়ে চলে সেই শোভাযাত্রা। মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পরে মানুষদের দর্শন ও ভোগ-আরতির সুযোগ করে দেওয়া হয়। অনেকেই প্রসাদ হিসেবে সেদিন ‘কারণবারি’ তথা মদ উৎসর্গ করে বা লাটের গায়ে ছুঁইয়ে নিয়ে যায়। 

শোভাযাত্রা লাট ভৈরব মন্দিরে এসে পৌঁছালে লাট ভৈরবের সেই মুখোশ নিয়ে  প্রথমে ভরত কূপের চারিধারে তিনবার প্রদক্ষিণ করা হয়, তারপর তুলসী বৃক্ষের চারিদিকে। এবার সেই মুখোশ লাট ভৈরব স্তম্ভের উপর পরিয়ে দেওয়া হলে পুরোহিত লাট ভৈরব ও ভরত কূপ সহ সেই প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য সমস্ত দেবদেবীর আরতি করেন। তারপর শুরু হয় মন্ত্রপাঠ, পুজো ও হোম-যজ্ঞ। অন্যদিন আমিষ ভোগ হলেও বিয়ের দিন তা নিষিদ্ধ, কেবল নিরামিষ খাবারই সেদিন ভোগের পাতে পরিবেশন করা হয় লাট ভৈরবকে। সঙ্গে অবশ্যই থাকে মদ। গভীর রাত অব্দি চলে এই বিয়ের আচার। যজ্ঞ সম্পন্ন হলে লাট ভৈরব ও ভরত কূপকে ফুলের মালা দিয়ে বর-কনের মতোই একসাথে বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন সকালে হয় খিচুড়ি ভোগ বিতরণ। বিয়ের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হলে সেই মুখোশ আবার ফেরৎ যায় বিশ্বেশ্বরগঞ্জে সমিতির অছির বাড়িতে। 

 

এরপর যখন লাট ভৈরব দর্শনে যাবেন, সেই প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে যদি মানসচক্ষে সমস্ত অণুবিশ্বের (microcosm) ইতিহাস যদি চোখের সামনে এক লহমায় অভিনীত হয়ে যায় তো চমকে উঠবেন না। এই লাট ভৈরব কেবল কয়েক ফুটের এক ভগ্নস্তম্ভ নয়, বরং দীর্ঘ ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী, বহু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যূপদণ্ড আর সর্বোপরি ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাইরে এসে জেগে ওঠা এক ঐক্যের প্রতীক। 

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply